মৃত্যুদণ্ড দেশে বিদেশে যুগে যুগে- ধর্মীয় মতামত বিতর্ক ও নতুন ধারা by শফিক রেহমান

বিশ্বের প্রায় সব ধর্মের সূচনা হয়েছিল প্রাচীনকালে। তারপর সামাজিক বিবর্তনে মানুষের চিন্তাধারা যুগে যুগে বদলে যেতে শুরু করে। সমাজ রাষ্ট্র ও ধর্ম বিষয়ে এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গিয়েছে। এমনকি যারা ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তাদের মধ্যেও নিজেদের ধর্ম বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা এসেছে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ চেয়েছে ধর্মের আওতায় থেকেও পরিবর্তিত যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। আর তার ফলে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে এবং একই ইস্যুতে বিভিন্ন মত প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। এসব মতামত বিবেচনা করে ধার্মিক মানুষরা নিজেদের সিদ্ধান্তে এসেছেন।

বৌদ্ধ ধর্ম
খৃষ্টপূর্ব ৫২৮-এ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার শুরু করেছিলেন নেপালের রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম। তার এই ধর্ম ৫০০ খৃষ্টাব্দ অবদি শুধু ইনডিয়ান সমাজে নয়, মধ্য ও পূর্ব এশিয়াতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ পঞ্চশিলাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জীবননাশ থেকে বিরত থাকতে। এতে লেখা হয়েছে, প্রত্যেকেই শাস্তিকে ভয় পায়। প্রত্যেকেই মৃত্যুকে ভয় পায়। ঠিক তোমারই মতো। সুতরাং তুমি কাউকে হত্যা করবে না অথবা এমন কিছু করবে না যার ফলে কেউ নিহত হতে পারে।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে আরো লেখা হয়েছে, তাকেই আমি ব্রাহ্মণ বলব যে অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং সকল প্রাণীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ছেড়ে দিয়েছে। সে কাউকে হত্যা করে না। সে অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যায় সাহায্য করে না।
অনেক বৌদ্ধ, বিশেষত পশ্চিমে, মনে করেন, শুধু বাক্যে বোঝানো হয়েছে, কোনো আইনগত পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিরোধী তাদের ধর্ম। তবে পুরাকালের বইয়ের ব্যাখ্যা প্রায়ই বিতর্কের সৃষ্টি করে। এই ব্যাখ্যাও বৌদ্ধ ধর্মে বিতর্কিত হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ দেশে কিছু অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ৮১৮ খৃষ্টাব্দে জাপানের সম্রাট সাগা মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও কিছু জমিদার তাদের এলাকায় মৃত্যুদণ্ড চালু রেখেছিলেন। ১১৬৫ খৃষ্টাব্দে জাপানে আবার মৃত্যুদণ্ড চালু হয়। এখনো তাই।

অবশ্য সম্প্রতি কিছু বিচারক মৃত্যুদণ্ড সই করতে রাজি হননি। এ ক্ষেত্রে যুক্তিস্বরূপ তারা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে ভুটান ও মঙ্গোলিয়া মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। শ্রীলংকা এক সময়ে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করলেও আবার সেটা চালু করেছে। থাইল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ড বরাবরই চালু ছিল এবং আছে। তবে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকদের মতে এ বিষয়ে মতভিন্নতা আছে।

বুদ্ধ তার বাণী দিয়ে খুনি এবং অপরাধীদের যে সংশোধিত করেছিলেন সে বিষয়ে বৌদ্ধ পুরাণে অনেক কাহিনী আছে। যেমন, আঙ্গুলিশালা ৯৯৯ জনকে হত্যার পর নিজের মা এবং বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধের প্রভাবে তিনি অনুতপ্ত হন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
ইনডিয়াতে বৌদ্ধ সম্রাট অশোক (৩০৪-২৩২ খৃষ্টপূর্ব) শাসন আমলে মৃত্যুদণ্ড ছিল। কিন্তু জীবন রক্ষার জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আপিল করার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল। সব পশুপ্রাণী হত্যা সম্রাট অশোক নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে।
এক শ্রেণীর বৌদ্ধ পণ্ডিত মনে করেন, কোনো রকম সহিংসতার সাথে বৌদ্ধ ধর্মের সহ-অবস্থান সম্ভব নয়। বিশেষত যুদ্ধ এবং মৃত্যুদণ্ড বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতিবিরোধী।
তারা একটি কাহিনীর উল্লেখ করেন।

এক চোর ধরা পড়ার পর রাজার সামনে দুটি বিকল্প ছিল। এক. তাকে ক্ষমা করে দিয়ে সংশোধনের পথে নিয়ে আসতে সচেষ্ট হওয়া এবং সেজন্য তাকে অর্থসাহায্য করা। দুই. তাকে শাস্তি দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বধ্যভূমিতে নিয়ে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা, যেন সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে চুরি করা থেকে বিরত থাকে।
রাজা দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নেন।
কিন্তু এতে বিপরীত ফল হয়।

চোররা যখন বুঝল ধরা পড়লে তাদের মৃত্যুদণ্ড হবে তখন তারা যে ব্যক্তির কাছ থেকে চুরি করছে তাকে এবং ঘটনার সকল সাক্ষীকে হত্যা শুরু করে। এভাবে ওই রাজার রাজত্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে চুরির সাথে হত্যার সংখ্যা দ্রুত অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার ফলে ওই রাজত্বে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বৃটিশ পুলিশ নেহায়েতই বাধ্য না হলে অপরাধীদের মোকাবেলায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না। ফলে বৃটেনে অপরাধ সংশ্লিষ্ট নিহতের সংখ্যা কম থাকে। অন্য দিকে আমেরিকান পুলিশ তুলনামূলকভাবে আগেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। ফলে আমেরিকায় পুলিশি অভিযানে হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়।

ক্যাথলিক কৃশ্চিয়ান
মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে কৃশ্চিয়ান ধর্মে বহু রকমের মতামত আছে। কেউ মনে করেন, যিশু যে ক্ষমার বাণী প্রচার করেছিলেন তার সম্পূর্ণ বিরোধী মৃত্যুদণ্ড, কারণ এটি প্রতিহিংসার বাস্তবায়ন। সুতরাং এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।
আবার কেউ মনে করেন, ওল্ড টেস্টামেন্ট আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।
মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা মনে করিয়ে দেন, যিশু বলেছিলেন, এক গালে চড় খেলে আরেক গাল বাড়িয়ে দিতে। তারা মনে করিয়ে দেন, পরকীয় প্রেমে অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এক নারীকে যখন পাথর ছুড়ে মারা হচ্ছিল তখন যিশু সেটা বন্ধ করেন। মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা বলেন, এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, শারীরিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন যিশু।
কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও কৃশ্চিয়ানরা আছেন।
আবার কিছু কৃশ্চিয়ান আছেন, যারা সম্পূর্ণভাবে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অসম মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও নন।
রোমান ক্যাথলিক চার্চের সেইন্ট টমাস একুইনসে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করেছিলেন অপরাধ সংখ্যা কমানোর পন্থা রূপে- প্রতিশোধ রূপে নয়।
পোপ দ্বিতীয় জন পল বলেছিলেন, সাধারণত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। তবে, সমাজকে রক্ষা করার জন্য কোনো দুর্বৃত্তের মৃত্যুই যদি একমাত্র উপায় হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
ক্যাথলিক এনসাইকোপিডিয়া (১৯১১ সংস্করণ) বলেছে, ক্যাথলিক চার্চের নীতিমালাবিরোধী নয় মৃত্যুদণ্ড। অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা এবং ঐশ্বরিক অনুমোদন রাষ্ট্রের আছে।

প্রটেস্টান্ট কৃশ্চিয়ান
আমেরিকায় সকল ধরনের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা যারা সবচেয়ে আগে করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন প্রটেস্টান্ট কৃশ্চিয়ানদের একটি শাখা, দি রিলিজিয়াস সোসাইটি অব ফ্রেন্ডস বা কোয়েকার (Quaker) চার্চ।
সাদার্ন ব্যাপটিস্টরা খুন ও দেশদ্রোহিতার দায়ে দণ্ডিতদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করলেও তারা বলেন, সেখানে যেন কোনো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা অথবা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য না থাকে।
বৃটেনে ১৯৮৮-তে অ্যাংলিকান বিশপদের ল্যামবেথ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, যেসব সরকার মৃত্যুদণ্ড দেয় তাদের বিরুদ্ধে চার্চ বলে... প্রতিটি মানুষের ঐশ্বরিক সম্মান যেন রক্ষা হয়... ন্যায়বিচারও করতে হবে... সুতরাং মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প ব্যবস্থা বের করতে হবে।
ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চ এবং অন্যান্য মেথডিস্ট চার্চও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। তারা বলেন, সামাজিক প্রতিশোধ নিতে কোনো মানুষকে মেরে ফেলা উচিত নয়। মেথডিস্ট চার্চ আরো বলে, মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয় অসমভাবে গরিব, অশিক্ষিত, সংখ্যালঘু এবং মানসিক রোগাক্রান্ত অথবা আবেগপ্রবণ মানুষরা। ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চের সম্মেলন সকল সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা যেন অবিলম্বে সকল মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করে।

মেথডিস্ট চার্চ ঠিকই বলেছিল। বাংলাদেশে যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তাদের অধিকাংশই গরিব অথবা নিম্নশ্রেণীর। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও উচ্চশ্রেণীর মানুষের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে হাতেগোনা, যেমন- রিমা হত্যা মামলায় মনির-এর এবং রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যা মামলায় সামরিক অফিসারদের।
আরেকটি প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায় ইএমসিএ ১৯৯১-এ তাদের নীতিমালা ঘোষণায় বলে, মৃত্যুদণ্ডের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিশোধ নেওয়া। কিন্তু শুধু অনুশোচনা ও ক্ষমার মধ্য দিয়েই শান্তি আসতে পারে- সামাজিক ক্ষত সারাতে পারে।
কমিউনিটি অব ক্রাইস্ট নামে আরেক প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায় ২০০০-এ তাদের বিশ্ব সম্মেলনে ঘোষণা করে, শান্তির চার্চ রূপে আমরা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। ন্যায়বিচার ও ক্ষত সারানোর জন্য বিকল্প পথ আমরা খুঁজতে চাই... আমাদের চার্চের সবাইকে অনুরোধ করছি, তারা যেন তাদের নিজেদের দেশে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করেন।
মেননাইট কৃশ্চিয়ানরাও (চার্চ অব বৃপরেন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস) তাদের প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছেন।

মরমোন কৃশ্চিয়ান
মরমোন কৃশ্চিয়ানরা (দি চার্চ অব জিসাস ক্রাইস্ট অব ল্যাটার ডে সেইন্টস) মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে না- মৃত্যুদণ্ড উৎসাহিতও করে না। মরমোনরা বলেন, দেশের আইনের ওপর সেটা নির্ভর করবে।

হিন্দু ধর্ম
হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শিক্ষাগ্রন্থে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং বিপক্ষে বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে অহিংসার বাণী প্রচারিত হয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে আত্মা অবিনশ্বর... মৃত্যু কেবল দৈহিকভাবে হতে পারে। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, খুনের কারণে এবং ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের সময়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

ইসলাম ধর্ম
মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে মুসলিম জ্ঞানীজনদের মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে। প্রায় সব মুসলিম দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। তবে সেটা কার্যকরের পন্থা হয় ভিন্ন। যেমন- ইরান ও ইরাকে ফাঁসি দিয়ে। সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ করে। কিছু মুসলিম দেশে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতি ছিল।
কিছু মুসলিম দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ-এর (দিয়া) মাধ্যমে বাচতে পারেন। অতি সম্প্রতি এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে ইরানে, যেখানে শেষমুহূর্তের ঠিক আগে নিহত ব্যক্তির আত্মীয় ক্ষমা করে দেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তকে।
মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে মুসলিমরা প্রায়ই কুরআনের একটি বাণী (৫:৩২) উল্লেখ করেন। সেটা হলো :
খুনের জন্য অথবা দেশে অনিষ্ট ছড়ানোর জন্য (রাষ্ট্র কর্তৃক) মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এ ছাড়া, কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে খুন করে তাহলে সেটা হবে সকল ব্যক্তিকে খুন করার মতো (অপরাধ) এবং কেউ যদি কোনো ব্যক্তির প্রাণ রক্ষা করে তাহলে সেটা হবে সকল ব্যক্তির প্রাণ রক্ষা করার মতো (কাজ)।
If anyone kills person- unless it be (a punishment) for murder or for spreading mischief in the land- it would be as if he killed all people. An if anyone saves a life, it would be as if he saved the life of all people. (Quran 5:32)
মুসলিম জ্ঞানীজনরা বলেন, দেশে অনিষ্টের (Mischief in the land) মানে হতে পারে এমন সব কর্মকাণ্ড যার ফলে সারা দেশ অথবা জাতির গভীর ক্ষতি হতে পারে। দুর্নীতি, যুদ্ধ প্রভৃতি কারণে এই ধরনের ক্ষতি হতে পারে। মুসলিম দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্যপ্রমাণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

বর্তমান যুগে অধিকাংশ কৃশ্চিয়ান যেমন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন তেমনটা মুসলিমরা করেননি। তদুপরি কিছু মুসলিম দেশে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় এবং সেই ছবি পত্রিকা ও ইন্টারনেটে প্রকাশ করায় মুসলিমরা সাধারণত চিত্রিত হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী এবং প্রাচীনপন্থী রূপে।

ইহুদি ধর্ম
ইহুদি ধর্মে নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করা হয়। তবে সেই দণ্ড দেওয়ার আগে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি নির্দেশে বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডের মামলায় তিনজন নয়- অন্ততপক্ষে ২৩ জন বিচারককে থাকতে হবে।
দ্বাদশ শতাব্দীর ইহুদি জ্ঞানী ব্যক্তি মুসা ইবনে মায়মুন বলেন, একজন নিরপরাধের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার চাইতে এক হাজার অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া শ্রেয়।
মুসা বিন মায়মুন (Maimonides) যুক্তি দেন, সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয়ে একজন অভিযুক্তকে মেরে ফেললে আমরা একটা পিচ্ছিল পথে পড়ে যাবো এবং শেষ পর্যন্ত বিচারকের অভিরুচি মোতাবেক দণ্ড হবে।
It is better and more satisfactory to acquit a thousand guilty persons than to put a single innocent one to death... that executing a defendant on anything less than absolute certainly would lead to a slippery slope of decreasing burdens of proof, until we would be convicting merely, according to the judges caprice.
নয় শ বছর আগে মুসা বিন মায়মুন যা বলেছিলেন, সেটা বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে সরকার দ্বারা অনুরুদ্ধ অথবা আদিষ্ট অথবা প্রভাবিত হয়ে বিচারক তার অভিরুচি অনুযায়ী রায় দিয়েছেন।

ইহুদি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ইসরেল-এ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারে শুধু একটি কারণে। সেটি হলো : মানবতার বিরুদ্ধে কোনো নাৎসি যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
ইসরেলের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত বেসামরিক আদালতে শুধু একজনেরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কয়েক হাজার ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়েছিলেন জার্মান নাৎসি লেফটেন্যান্ট কর্নেল এডলফ আইখম্যান (Adolf Eichmann)। ১৯৪৫-এ যুদ্ধের পর তিনি আর্জেন্টিনাতে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। ১৯৬০-এ ইসরেলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ তাকে বুয়েনস এয়ার্সে খুজে বের করার পর অপহরণ করে ইসরেলে নিয়ে আসে। যুদ্ধ অপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে তার বিচার শুরু হয় ১৯৬১-তে জেরুসালেমের আদালতে। তখন আর্জেন্টিনা তীব্র আপত্তি করে বলেছিল, আইখম্যানকে অপহরণ করে ইসরেল আর্জেন্টিনার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করেছিল।
ইসরেলি সরকারের ঐকান্তিক ছিল বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করার যে আইখম্যানের বিচার হচ্ছে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে। বিশ্বের টপ মিডিয়া এই বিচারকাজ দেখার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিল এবং ৭৫০ দর্শক রিপোর্টারের আসন ছিল।

ওপরের নির্দেশ
৫৬ দিন শুনানির পরে। শত শত নথিপত্র পেশ করার পরে এবং ১১২ জন সাক্ষীর (যাদের অধিকাংশ ছিলেন গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুর মুখ থেকে বেচে আসা) স্যা দেওয়ার পরে তিনজন বিচারক একমত হয়ে আইখম্যানের মৃত্যুদণ্ড দেন। ট্রায়ালের পুরো সময়টায় হাই সিকিউরিটির মধ্যে আইখম্যানকে আদালতে একটি বুলেটপ্রুফ গ্লাসের খাচায় রাখা হয়।
আইখম্যান তার ডিফেন্সে বলেন, তিনি ওপরের নির্দেশে কাজ করেছিলেন এবং যেহেতু তিনি ওপরের কর্তাব্যক্তিদের আদেশ মেনে চলার শপথ নিয়েছিলেন। সেহেতু তিনি সব সময়ই সেটা মানতে বাধ্য ছিলেন। আইখম্যান আরো বলেন, ইহুদিদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুলার, হেইডৃচ, হিমলার এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে হিটলার।
বিচারকরা তার এই ডিফেন্স (ওপরের নির্দেশ) নাকচ করে দেন। তারা রায়ে বলেন, আইখম্যান শুধুই যে ওপরের নির্দেশ মেনে কাজ করেছিলেন তা নয়- তিনি সম্পূর্ণভাবে নাৎসি সরকারের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং গণহত্যায় একটি প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন- গুলি চালিয়ে নয়, হত্যার আয়োজনে নিজের অফিস ডেস্কে বসে অংশ নিয়ে।

১৫ ডিসেম্বর ১৯৬১-তে আইখম্যান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তিনি সুপৃম কোর্টে আপিল করেন। তার দণ্ড বহাল থাকে। শেষ চেষ্টায় তিনি ইসরেলি প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। কিন্তু সেটাও নাকচ হয়ে যায়। ৩১ মে ১৯৬২-তে মধ্যরাতে ইসরেলের রামিয়া জেলখানায় ফাসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। শেষ খাবার হিসেবে কিছু খেতে চাননি আইখম্যান। তিনি এক বোতল ওয়াইন চেয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি কালো টুপি মাথায় পরতে চাননি।
চার ঘণ্টার মধ্যে একটি গোপন স্থানে আইখম্যানের দেহ পোড়ানো হয়। তারপর ইসরেলি নেভির একটি পেট্রল বোটে তার দেহভস্ম নিয়ে যাওয়া হয় ভূমধ্যসাগরে এবং সেখানে আন্তর্জাতিক পানির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়।
এডলফ আইখম্যানের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড থেকে দুটি বিষয় শিক্ষণীয়। এক. হত্যার অপরাধে বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে করা উচিত এবং দুই. উপরের নির্দেশ মেনে চলাটা হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিফেন্স হতে পারে না।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে যেসব একস্ট্রা জুডিশিয়াল মার্ডার হচ্ছে তার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দ্বিতীয় শিক্ষাটি নিতে পারেন।
সাইমন ওয়েজেনথাল, অস্টৃয়ার ইহুদি যিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন নাৎসি অপরাধীদের খুজে বের করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে। তিনি আইখম্যানের মৃত্যুদণ্ডের পরে বলেন, সারা বিশ্ব এখন বুঝতে পারবে ডেস্ক মার্ডারার বলতে কি বোঝায়। এখন আমরা জানি, কাউকে খুন করতে মানসিক বিকারগ্রস্ত হতে হয় না- কোনো ব্যক্তি তার ডিউটি বা ওপরের নির্দেশ পালনের জন্য বিশ্বস্ত অনুচর ও আগ্রহী হয়েই খুন করতে পারে।
Faicbook.com/shafik Rehman Presents

No comments

Powered by Blogger.