ওয়ার্ল্ডকাপ হ্যাংওভার

এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে অনেক বেশি ব্যয়বহুল। টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে আগের বিশ্বকাপগুলোর ব্যয়ের তুলনায় ব্রাজিল বিশ্বকাপে ব্যয়ের একটি পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে। স্পোর্টস বিজনেস জার্নাল জানিয়েছে, আয়োজন শেষে সব মিলিয়ে ব্রাজিলের খরচ গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১৫০০ কোটি থেকে ২০০০ কোটি ডলারে। টিভি স্বত্ব, টিকিট, কর্পোরেট স্পন্সরশিপ আর মার্কেটিংয়ের লাভ রাখবে ফিফা। আর পর্যটকদের ব্যয় থেকে ব্রাজিল রাখতে পারবে আনুমানিক ৫০ কোটি ডলার। এটা খুব একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতি নয় ব্রাজিলের জন্য। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যয় করেছিল ৬০০ কোটি ডলার। পক্ষান্তরে উন্নত অবকাঠামো আর আধুনিক স্টেডিয়ামসমৃদ্ধ দেশ জার্মানি (২০০৬), ফ্রান্স (১৯৯৮) ও যুক্তরাষ্ট্রের (১৯৯৪) বিশ্বকাপ আয়োজনে দেশগুলোর ব্যয় হয়েছিল ১০০০ কোটিরও কম। ২০০২-এর আসরে যখন এশিয়ার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল সেবার তাদের ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে ৫০০ কোটি ও ২৫০ কোটি ডলার। ব্রাজিলের মতো তাদেরও তৈরি করতে হয়েছিল একাধিক নতুন স্টেডিয়াম। ব্রাজিলের সমস্যাগুলোর একটি হলো: ফিফার বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী প্রতিটি আয়োজক দেশকে ন্যূনতম ৪০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসহ ৮টি স্টেডিয়াম থাকতে হবে। যার মধ্যে উদ্বোধনী খেলার জন্য ৬০ হাজার ধারণক্ষমতা ও ফাইনাল খেলার জন্য কমপক্ষে ৮০ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়। শুধুমাত্র এই বাধ্যবাধকতাই মেটানো যথেষ্ট কঠিন। তারপরও ব্রাজিল কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বের কাছে নিজেদের ১২টি শহরের পরিচিতি তুলে ধরার লক্ষ্যে ভেন্যু রেখেছে ১২টি। প্রত্যেকটির ন্যূনতম ধারণক্ষমতা কমপক্ষে ৪০ হাজার। ২০০৯ সালে ব্রাজিলের ফুটবল কনফেডারেশন প্রাথমিকভাবে অনুমান করেছিল, বিশ্বকাপের জন্য ১২টি স্টেডিয়াম সংস্কার ও নতুন করে তৈরি করতে খরচ হবে ১১০ কোটি ডলার। শেষমেশ স্টেডিয়ামের পেছনে মোট বাজেট গিয়ে দাঁড়ায় ৪৭০০ কোটি ডলার। ৯টি স্টেডিয়াম নতুন। আর তার মধ্যে ৭টি স্টেডিয়াম পুরোনো স্টেডিয়াম ভেঙে সেখানেই নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। ৪টি স্টেডিয়ামের শহরগুলোর কোন দল ব্রাজিল সকার লিগের ফার্স্ট ডিভিশনে নেই। মানাউসে একটি দল আছে যারা সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে। তাদের খেলাগুলোতে গড় দর্শক উপস্থিতি হয় ১৫০০’র মতো। মানাউসে এখন নতুন যে স্টেডিয়াম আছে তার ধারণক্ষমতা ৪২,৩৭৪। এর পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সবমিলিয়ে এ স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ৪টি খেলা অনুষ্ঠিত হবে। মানে গারিঞ্চা ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের পেছনে সার্বিক ব্যয় হয়েছে ৯০ কোটি আর স্টেডিয়ামটির ধারণক্ষমতা ৭০ হাজার। ফোর্টালেজা, রেসিফে ও সালভাদর প্রত্যেকটি শহরেরই ফার্স্ট ডিভিশনে খেলা দল রয়েছে। তাদের খেলাগুলোতে গড় দর্শক উপস্থিতি থাকে ১৫ হাজার। আর টিকিটের মূল্য থাকে মাত্র ১০ ডলার। রেসিফেতে বিশ্বকাপের নতুন স্টেডিয়াম তৈরির আগে থেকেই ছিল তিনটি বড় ও বহুমুখী স্টেডিয়াম। এ শহর নিবাসীদের এতটা উচ্চমূল্যে টিকিট কেনার ক্রয়ক্ষমতা নেই যা দিয়ে এসব স্টেডিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব। আর নির্মাণ ঋণ তো আছেই। সাও পাওলোতে সংস্কারযোগ্য মরুম্বি স্টেডিয়ামটি ফিফার মানদণ্ড মেটাতে না পারায় এটাকে বিশ্বকাপ থেকে বাদ দেয়া হয়। স্থানীয় আয়োজক কমিটি মরুম্বিকে সংস্কার করার পরিবর্তে নতুন স্টেডিয়াম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১১ সালের মে মাসে ফিফা স্টেডিয়াম পর্যবেক্ষণ সফরের পর নতুন স্টেডিয়ামের নকশার সঙ্গে আরও কিছু সংযোজন করে। যার ফলে মূল খরচের ৩০ শতাংশ বেড়ে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৬৫ কোটি ডলারে। ২০১৪’র শুরুর দিকে একটি ক্রেন ধসে স্টেডিয়ামের ভালো একটি অংশ বরবাদ হয়ে যায়। এরপর কাজ বন্ধ থাকে বেশ কিছু দিন। রিও ডি জেনিরো’র বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়াম সেই ১৯৫০-এর বিশ্বকাপের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে প্যান আমেরিকান গেমসের জন্য ২০ কোটি মিলিয়ন ডলারের সংস্কার করা হয়। ফিফা’র বিচারে ওই সংস্কার যথেষ্ট ছিল না। প্যান আমেরিকান গেমসের পর মারাকানা স্টেডিয়াম আংশিক ভেঙে ফেলা হয়। এরপর আবার নতুন করে নির্মাণে ব্যয় হয় ৫০ কোটিরও বেশি। নতুন করে নির্মাণের জন্য ভেঙে ফেলা হয় একটি স্কুল, একটি জিমনেশিয়াম, একটি ওয়াটার পার্ক আর লাতিন আমেরিকার প্রথম আদিবাসী জাদুঘর। পার্কিংয়ের জন্য জায়গা করতে ওই স্থানটি সমান করে ফেলা হয়। কিন্তু ১২ই জুন যখন বিশ্বকাপের আসরে পর্দা উন্মোচন হয় তখন আহামরি সংখ্যক গাড়ি সেখানে দেখা যায়নি। ৭০০ পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। প্রথম ১০০ জনকে করা হয় বন্দুকের মুখে। তাদেরকে দু’ঘণ্টার দূরত্বে রিও’র পশ্চিম দিকে আবাসের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। বাকি পরিবারেরা প্রতিবাদ জানিয়ে মামলা করে। এর ফলে তারা অপেক্ষাকৃত উন্নত জায়গায় যেতে সমর্থ হয়। খেলার বাইরে বিশ্বকাপের জন্য যেসব অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ করতে হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নতুন বাস লেন নির্মাণ। খেলোয়াড়, কর্মকর্তা আর ফুটবল ভক্তদের দ্রুত যাতায়াতের জন্য এয়ারপোর্ট আর হোটেল থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত এসব নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও বিমানবন্দরগুলোতে নির্মাণ করা হয় নতুন রানওয়ে আর টার্মিনাল। আর নিরাপত্তা ব্যয় ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নিজ বাড়িঘর ছাড়া হতে হয়েছে আনুমানিক আড়াই লাখ দরিদ্র ব্রাজিলিয়ানকে। এছাড়াও দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত শিক্ষা আর যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভুগছে ব্রাজিল। বিশ্বকাপের এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে যে ব্রাজিল জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছিল তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বিশ্বকাপের আসর। তারপরই ব্রাজিল সরকারকে বিশাল অঙ্কের বিল পরিশোধ করতে হবে। আর সেটা করতে হবে যাবতীয় বন্ডহোল্ডার আর জনগণকে। বিশ্বকাপ উন্মাদনার হ্যাংওভার হতে আর খুব বেশি দেরি নেই।

No comments

Powered by Blogger.