রাতে ক্রসফায়ার দিনে পুরস্কার

রাতে পুলিশের ক্রসফায়ারে মারা গেছে দুই যুবক। পুলিশের দাবি, তারা পেশাদার ছিনতাইকারী। তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে জড়ো হতে গিয়ে পুলিশের মুখোমুখি হয় তারা। পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে দু’জন নিহত হয়। পালিয়ে যায় তাদের কয়েক সঙ্গী। রাত পোহানোর পর দিনে গোয়েন্দা পুলিশের এ টিমকে পুরস্কৃত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রমজান মাসের নিরাপত্তা নিয়ে আয়োজিত এক সভায় এ ঘোষণা দেয়া হয়। সভায় রাজধানীর ৪৯টি থানার ওসি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পুরস্কার হিসেবে গোয়েন্দা পুলিশের (পূর্ব) অবৈধ মাদক উদ্ধার ও প্রতিরোধ টিমকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে। সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে অজ্ঞাত ছিনতাইকারী হিসেবে পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া দুই যুবককে শনাক্ত করেছে তাদের পরিবারের সদস্যরা। নিহত দুই যুবক হলো রমজান আলী ওরফে জাভেদ (৩৭) ও জাকির হোসেন ওরফে আকমল (৩৫)। রমজান সায়েদাবাদ বাস মালিক-শ্রমিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক। আর জাকির সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের শ্রমিক লীগের নেতা। নিহত দুই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের দাবি, শ্রমিক লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে সংগঠনের সভাপতি খায়রুল হক ডিবি পুলিশকে টাকা দিয়ে তাদের হত্যা করিয়েছে। পুলিশ জানায়, শনিবার মধ্যরাতে ডিবির (পূর্ব) অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও প্রতিরোধ টিম বিশেষ অভিযান চালাতে গিয়ে দেখে- মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির পূর্ব দিকের রাস্তার ওপর দু’টি মোটরসাইকেলসহ ৬ থেকে ৭ জন লোক অবস্থান করছে। ডিবির দলটি মাইক্রোবাস থামিয়ে তাদের সমবেত হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে গাড়ি থামানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। পরে ঘটনাস্থল থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় টহল পুলিশ তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল থেকে দু’টি মোটরসাইকেল ও দু’টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে ডিবি পুলিশের ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো চ-৫১-৬২৭১) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় ডিবির এসআই নৃপেন কুমার ভৌমিকের করা পৃথক দুটি মামলায় (নং ২৬ ও ২৭) বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের সময় পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা সরকারি পিস্তল থেকে ২৩ রাউন্ড ও দুই কনস্টেবল তাদের সরকারি শটগান থেকে ১০ রাউন্ড গুলি করেন। তবে পুলিশের দাবি, তাদের নয়, সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই যুবক নিহত হয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, নিহত দুই ব্যক্তিকে কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। নিহত রমজানের মাথায়, গলায়, পেটের নিচে ও ঊরুতে মোট পাঁচটি এবং জাকিরের মাথায়, বাম পায়ে ও পেটে তিনটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, নিহত দুই যুবক পেশাদার ছিনতাইকারী। তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। তাদের ‘প্রিভিয়াস ক্রিমিনাল ডাটা’ সংগ্রহ করা হচ্ছে। অপর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, নিহত রমজানের বিরুদ্ধে ৯৩টি ও জাকিরের বিরুদ্ধে ৪২টি মামলার তথ্য পেয়েছেন তারা। রমজান আলী জাভেদকে সবাই ‘রমজান ডাকাত’ বলেই চেনে।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহত জাবেদের বোন রুনা বেগম দাবি করেন, ‘তার ভাই রায়েরবাগের দোতলা মসজিদের পাশে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় ওই বাসা থেকে জাবেদের বন্ধু খোকন তাকে ডেকে নিয়ে যায়। এর ১ ঘণ্টা আগে জাবেদকে খোকনের বান্ধবী রূপা ফোন দেয়। রূপার সঙ্গে জাবেদের সম্পর্ক ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় মোবাইলে কথা হতো। এ নিয়ে তার ভাবি ঝর্ণা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। তিনি আরও বলেন, বিকাল বেলায় বের হওয়ার পর থেকেই জাবেদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। দিন গড়িয়ে সারারাত তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। রুপার ফোন পেয়ে জাবেদ মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি এলাকায় যায়। ওই বাসায় আগে থেকেই সায়েদাবাদের শ্রমিক লীগ নেতা খাইরুল ও বাবু ছিল। ওই বাসায় যাওয়া মাত্রই খাইরুল ও বাবু ডিবি পুলিশকে ফোন করে জাবেদকে তাদের হাতে তুলে দেয়। পরে খাইরুল, খোকন ও বাবুর প্ররোচনায় ডিবি পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে। রুনার দাবি, তার ভাইকে হত্যায় ডিবি পুলিশ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে। রুনা জানান, টেলিভিশনের স্ক্রলে ডিবি পুলিশের ক্রসফায়ারে দু’জন মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তারা হাসপাতালের মর্গে গিয়ে ভাইকে শনাক্ত করেন।
জাবেদের স্ত্রী নুসরাত জাহান ঝর্না বলেন, ‘সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল মালিক ও শ্রমিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তার স্বামী। কাঁচপুর, দাউদকান্দি ও হোমনা রোডের প্রধান লাইনম্যান ছিলেন তিনি। সমিতির সভাপতি খায়রুল হক ও তার দুই সহযোগী বাবু ও খোকন টাকার ভাগ চাইতেন। ভাগ না দেয়ায় তারা একবার জাভেদকে মারধরও করে। এ কারণেই তারা ডিবি পুলিশকে ভাড়া করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাকে ডেকে নিতে রূপাকে ব্যবহার করা হয়। তিনি রূপাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। বলেন, রূপাকে গ্রেপ্তার করলে এটা ক্রসফায়ার না হত্যাকাণ্ড তা বেরিয়ে আসবে। ছিনতাইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার স্বামী একজন ধার্মিক ছিলেন। ডিবি পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে এখন ছিনতাইকারী বানাচ্ছে। আমার স্বামী যদি আইনের চোখে কোন অপরাধ করতো তাহলে পুলিশ তাকে আদালতে সোপর্দ করে বিচার করতো। কিন্তু তাকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো। আমি যে এখন বিধবা হলাম। কিছুদিন পর আমার এইচএসসির রেজাল্ট। আমার কি হবে? আমি খুনি ও খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করবো।
নিহত জাবেদের নারায়ণগঞ্জের মৌচাক এলাকায় বিসমিল্লাহ ফার্নিচার নামে একটি দোকান রয়েছে। পার্টসের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। শ্যামপুরের দোলাইরপাড় এলাকায় একটি অফিসে বসতেন। তার পিতার নাম আবদুল মান্নান। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ থানার নুনেরটেক এলাকায়। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ।
অন্যদিকে জাকির হোসেন আকমলের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন জানান, শনিবার সকালে অন্যান্য দিনের মতোই জাকির তাদের ডেমরার বাসা থেকে বেরিয়ে যান। দুপুরের পর থেকে তার মোবাইল বন্ধ ছিল। সকালে তিনিও টেলিভিশন দেখে হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর লাশ শনাক্ত করেন। তিনি বলেন, আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আমার স্বামীর মতো ভালমানুষ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। স্বামী জাকির ডেমরা এলাকায় কাপড় ব্যবসা করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে তার যাতায়াত ছিল। তিনি শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিনতাই করতে পারেন না। তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। নিহত জাকিরের পিতার নাম হারুন মৃধা। তানিম নামে ছয় বছরের একটি সন্তান রয়েছে তার। গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের কাউখালীর কাউন্দিয়ায়।

No comments

Powered by Blogger.