খোলা হাওয়া- আতঙ্কতন্ত্র by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
২৩ বছর আগে স্বৈরশাসনকে বিদায় জানিয়ে আমরা যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, এত দিনে তা রূপ নিয়েছে আতঙ্কতন্ত্রে।
ধান-পাট-গমের
পাশাপাশি বাংলাদেশের বড় উৎপাদন এখন আতঙ্ক। ফসল উৎপাদনের জন্য অবশ্য
নির্দিষ্ট মৌসুম থাকে, কিন্তু আতঙ্ক উৎপাদন করা যায় সারা বছর। দিন-রাতের
যেকোনো সময়। এই আতঙ্কের শিকার স্কুলের ও স্কুলের বাইরের শিশুরা, খেটে
খাওয়া মানুষেরা; পথচারী অথবা পরিবহনশ্রমিকেরা; ট্রেন অথবা বাসযাত্রী অথবা
অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে হাসপাতালের পথে রওনা হওয়া রোগীরা। এক বছর থেকে
ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে আতঙ্কের তীব্রতা এখন এতটাই যে, পথে বেরোলে প্রাণ
নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবে কি না, এ কথাটাও জোর দিয়ে কেউ বলতে পারে না, এমনকি
শুক্রবারেও। একসময় টেস্ট ক্রিকেটে তৃতীয় অথবা চতুর্থ দিনটি থাকত
বিশ্রামের দিন। সত্তর-আশির দশকের দিকে বিশ্রামের এই দিনটি বাতিল করে দেওয়া
হয়। আমাদের হরতাল-অবরোধের ব্যাপকতা যে রকম বাড়ছে, তাতে
আতঙ্ক-খেলোয়াড়েরা শুক্রবারটাকে আর বেশি দিন হয়তো সম্মান দেখাবে না।
সপ্তাহের ছয় দিন বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে যাদের চিত্তসুখ হয়,
শুক্রবারেও নিশ্চয় তাদের হাত নিশপিশ করে।
এই আতঙ্ক-খেলোয়াড়েরা ধরাছোঁয়ার বাইরের মানুষ। পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। তারা সুরক্ষিত ঘরে বসে খেলার ছক কষে; আদেশ দেয়, টাকাপয়সার জোগান দেয়। মাঠে আতঙ্ক উৎপাদনের জন্য তারা নিয়োগ করে আতঙ্ক-শ্রমিকদের। এই শ্রমিকেরা বোমা ফাটায়, ককটেল ও গান পাউডার ছুড়ে মারে, আগুন লাগায়। সারা দেশের শহরে-বন্দরে-গঞ্জে এই শ্রমিকদের পদচারণ; মিডিয়ায় তাদের সবাইকে দেখতে একই রকম লাগে। কৃষিকাজের মতো তাদের উৎপাদনপদ্ধতিও সর্বত্র একই রকম। এখন টিভি খুললেই দেখা যায় কোথাও না কোথাও সহিংস মিছিল হচ্ছে, টায়ার পোড়ানো হচ্ছে, ককটেল ফাটানো হচ্ছে। কোনো টিভি চ্যানেল যদি ক্যামেরা ও প্রতিবেদক-সংকটে ভোগে, তাহলে সমস্যা নেই। এক মাস আগের ছবি চালিয়ে দিলেই চলে। এখন বাংলাদেশের চোখজুড়ে শুধু একটাই ছবি—আতঙ্ক উৎপাদন-প্রক্রিয়া ও তার অভিঘাতের ছবি। আতঙ্ক যদি রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য হতো, তাহলে আমাদের বার্ষিক গড় আয় এত দিনে হাজার হাজার ডলারে পৌঁছে যেত। যদিও গড় আয়ুর ঘরে বড়সড় টান পড়ত, যেহেতু আতঙ্ক উৎপাদনের একটা উপকরণ মানুষের প্রাণ। গত এক মাসে অন্তত ৩০টি তরুণ প্রাণ আতঙ্ক-সন্ত্রাসের বলি হয়ে অকালে ঝরে পড়েছে।
প্রথম আলোয় একটি ছবি দেখে মনে হয়েছে, এ রকম ছবি যে দেশে ছাপা হয়, সে দেশের মানুষ বোধ হয় মানুষ নামের যোগ্যতা হারায়। আগুনে বাবাকে হারিয়ে একটি শিশু নিষ্পলক তাকিয়ে আছে—তার কষ্ট, যন্ত্রণা, হারানোর বেদনা, অসহায়ত্ব একটি বর্ণনা-অসম্ভব অনুভূতি হয়ে তার দৃষ্টিকে ঢেকে দিয়েছে। এই শিশুটির চোখের দিকে যদি আমাদের আতঙ্ক-খেলোয়াড়েরা তাকাত, তাহলে তাদের পাথরের মতো হূৎপিণ্ডে নিশ্চয় কিছুটা চিড় ধরত। কিন্তু তারা যে পত্রিকা পড়ে অথবা টিভি দেখে, সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
আতঙ্কতন্ত্র এখন তরুণদের বিধ্বংসী হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান দিই, পরিবর্তনের রাজনীতির ঘোষণা দিই, কিন্তু প্রতিদিন হাতে-কলমে অসংখ্য তরুণকে তালিম দিই, কীভাবে ঠান্ডা মাথায় যাত্রীভর্তি বাসে আগুন লাগাতে হয়। যে আতঙ্কটি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, তা হচ্ছে এই হন্তারকের দলে নাম লেখানো তরুণদের নিয়ে। এরা কি আর কোনো দিন সুস্থ জীবনে ফিরে যাবে? যারা রাস্তায় নেমে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তারা কি আর কোনো দিন শৃঙ্খলাকে সম্মান করবে? শিক্ষাকে ভালোবাসবে? গুরুজনকে মান্য করবে? মাদকের নেশার মতো ধ্বংসের নেশা থেকে ফেরত আসাটা কষ্টসাধ্য, অসম্ভব না হলেও। কিন্তু আমরা কি সেই মানবিক সমাজ তৈরি করেছি, যে সমাজ এই তরুণদের পুনর্বাসনের সময় ও বিনিয়োগ দেবে? ধ্বংস থেকে সৃষ্টির পথে এদের নিয়ে আসতে পারবে?
এখন আমাদের আতঙ্কতন্ত্রের পূর্ণ উৎপাদন হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়াকে কেন্দ্র করে। আমাদের যদি গণতন্ত্র থাকত, তাহলে এই পালাবদলটা হতো একটা উৎসবের আমেজে। প্রকৃত গণতন্ত্রে ক্ষমতায় যাওয়া হচ্ছে জনসেবা ও দেশসেবার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ। যেখানে দেশ বড়, সেখানে পদ্ধতি নিয়ে কোনো তর্ক হয় না, ঝগড়া হয় না। তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ভালো, নাকি নির্বাচনকালীন একদলীয় অথবা বহুদলীয় সরকারপদ্ধতি ভালো, এ নিয়ে একটি দেশের ভবিষ্যৎ জিম্মি করার চিন্তাও তখন কেউ করে না। প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে পদ্ধতি-নির্বিশেষে নির্বাচন হতো, নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতো, বিনা বাক্যব্যয়ে নির্বাচনের ফল সবাই মেনে নিত, সংসদ প্রাণবন্ত ও কার্যকর হতো। প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে প্রতিবাদ হতো, সমালোচনা হতো, সংশোধন-সংযোজন হতো, দেশের প্রশ্নে নানা ইস্যুতে ঐকমত্য হতো। টেবিলের দুই দিকে বসে বিস্তর আলোচনা হতো। নীতি ও কর্মপরিকল্পনা এবং প্রকল্পের ধারাবাহিকতা থাকত। সত্তর-আশি পেরোনো রাজনীতিবিদেরা পার্কে বসে পত্রিকা পড়তেন, আড্ডা মারতেন আর প্রয়োজনে উপদেশ-অভিমত দিতেন; তাঁদের জায়গা তাঁরা ছেড়ে দিতেন তরুণদের কাছে। প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে দলের ভেতর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতো এক নম্বর কাজ। ফলে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে দলের, নির্বাচনের, নানা কমিটির প্রার্থী ও সদস্য নির্বাচিত হতো। সবচেয়ে বড় কথা, প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে আতঙ্ক-অনিশ্চয়তা-আত্মঘাতী-প্রবণতা থাকত না।
কিন্তু বাংলাদেশের দুঃখী কপালে গণতন্ত্রের সুখ লেখা নেই; যা আছে, তা আতঙ্কতন্ত্র। আতঙ্কতন্ত্রে দলগুলো থাকে স্বৈরতান্ত্রিক। তৃণমূলকে প্রয়োজন পড়ে শুধু ভোটের সময়। আতঙ্কতন্ত্রে সাংসদ হওয়া এক বিশাল প্রাপ্তির নাম; শুল্কমুক্ত গাড়ি থেকে নিয়ে নানা পদ-পদবি পাওয়া, মন্ত্রী-ভিআইপি হওয়া আর ব্যবসা-বাণিজ্য-বিদেশভ্রমণের প্রচুর সুযোগ পাওয়ার এক চাবিকাঠির নাম। ঢাকায় কেউ রাজউকের ১০ কাঠার প্লট পেলে যে রকম তাঁকে ভাগ্যবান বলতে হবে, বড় দলের সংসদ সদস্য পদে মনোনয়নটাও যেন তা-ই। সে জন্য ‘মনোনয়নবঞ্চিতরা’ রাস্তায় নামেন, হরতাল করেন, ধ্বংসযজ্ঞ চালান। যদি এমন হতো যে সাংসদ হওয়া মানে ২৪ ঘণ্টা জনসেবার কাজে লেগে থাকা, নাওয়া-খাওয়া ভুলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ-দারিদ্র্য নির্মূলের কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়া, তাহলে ছবিটা নিশ্চয় উল্টো হতো। অথবা কে জানে, দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে মনোনয়নবঞ্চিতরা প্রতিবাদ মিছিল করে ঘোষণা দিতেন, আগামী পাঁচ বছরে মনোনয়নপ্রাপ্তদের থেকে তাঁদেরই বেশি দেখা যাবে মাঠের কাজে, মানুষের সেবায় ইত্যাদি।
গণতন্ত্রের অনেক আবশ্যকতার মধ্যে নির্বাচন তো মাত্র একটি। নির্বাচনের পর সংসদ রয়েছে; সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও হাতভর্তি উন্নয়নের নানা কাজ রয়েছে; সর্বোচ্চ মানের বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতিসহ ১০০ রকমের সামাজিক-রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপার রয়েছে; দলগুলোকে গণতন্ত্রচর্চার মডেলে রূপান্তরের বিষয়টি রয়েছে, দলগুলোর ভেতর তৃণমূল থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্বচ্ছ যোগাযোগ ও কথোপকথনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, ছায়া সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সরকার ও বিরোধী দলের ভেতর ক্রমাগত সংলাপ ও জাতীয় ইস্যু এবং নীতির প্রশ্নে ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, নেতা-নেত্রীদের ভেতর সৌজন্য ও সৌহার্দ্যেরও দরকার রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আমাদের দেশে যে রকম আন্দোলন শুরু হয়, তাতে মনে হয়, নির্বাচনই যেন গণতন্ত্রের একমাত্র শর্ত। নির্বাচনে জিতে গেলে তো হলোই, তখন পাঁচ বছর শুধু ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ। বিপত্তিটা হয় হেরে গেলেই, তখন নানা ছুতায় সংসদ বর্জন (বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি, বিদেশভ্রমণ বর্জন যদিও নয়)। নির্বাচনকে দেশসেবার সুযোগ হিসেবে না দেখে শুধু ক্ষমতায় আরোহণের উপায় হিসেবে দেখার কারণে গণতন্ত্র তার চরিত্র হারিয়েছে। হারিয়ে এখন তা রূপ নিয়েছে আতঙ্কতন্ত্রে।
এই আতঙ্কতন্ত্রের মাত্রা বাড়াচ্ছে উগ্রবাদীরা, জঙ্গিরা। এখন ধর্মের নামে আতঙ্ক ছড়ায় অনেক দল ও গোষ্ঠী। আতঙ্কতন্ত্রে নাম লেখাচ্ছেন পেশাজীবী ও দলীয় বুদ্ধিজীবীরাও। যাঁরা তীব্র কণ্ঠে আতঙ্কতন্ত্রের অবসান চাইতে পারতেন, তাঁরা যখন আতঙ্কতন্ত্রকে মেনে নেন, তখন আমাদের কীই-বা করার থাকে।
তবে আতঙ্কতন্ত্রকে মেনে নিতে পারে না সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া লোকজন, ভুক্তভোগীরা। অবরোধের আগুনে ঝলসে যাওয়া বাসযাত্রী গীতা সেনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে তিনি বলেছেন, ‘আমরা অসুস্থ সরকার চাই না’। ‘আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন’। বুধবার সকালের খবরের কাগজের একটি শিরোনাম, ‘যথেষ্ট হয়েছে, এবার থামতে হবে’। দাবিটি জানিয়েছে ‘সহিংসতা প্রতিরোধে জনতা’। এই দাবিটি এখন ঘরে ঘরে।
মানুষ আতঙ্কতন্ত্র চায় না, গণতন্ত্র চায়। এই গণতন্ত্র আমাদের জাতিসংঘ দিতে পারে না, কোনো ত্রাতা দেশও দিতে পারে না। গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারেন একমাত্র রাজনীতিবিদেরাই। তাঁদের সাহায্য করার জন্য মানুষ প্রস্তুত। এখন তাঁরা এগিয়ে এলেই হয়।
সারা শরীর আগুনে পুড়ে যাওয়া মনির যখন গাজীপুর চৌরাস্তায় বসে ছিল, হয়তো নিস্তব্ধ বসে বোঝার চেষ্টা করছিল, কেন তাকে এভাবে কোন অপরাধে, অবেলায়, অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় চলে যেতে হবে; তার পাশে বসে তার বাবা নিজের চোখে জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা দেখছিলেন। ওই ছবিটি ডেইলি স্টার-এ উঠেছিল। অন্যান্য কাগজও ছাপিয়েছিল। আমাদের নেতা-নেত্রীদের অনুরোধ, ছবিটি দেখুন। হয়তো ব্যস্ততার কারণে ছবিটি আপনাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু পড়া উচিত।
ছবিটি দেখে নিশ্চয় আপনাদের চোখে পানি আসবে। তখন নিশ্চয় মনির ও তার মতো অসংখ্য শিশু-কিশোর এবং আগুনে-গুলিতে-চাপাতির আঘাতে না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া অসংখ্য মানুষের জন্য আপনারা গণতন্ত্রে ফেরার কাজটি শুরু করবেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments