অবরোধ থেকে মুক্ত থাকুক

৪৮ বছর ধরে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সমাদৃত মিল্ক ভিটা। মানুষের পুষ্টি রক্ষায়, খাদ্যনিরাপত্তায় ও দারিদ্র্য বিমোচনে মিল্ক ভিটার অবদান অনন্য। একদিকে রোগীর পথ্য ও শিশুখাদ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা, অন্যদিকে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জীবিকার ব্যবস্থা—এ মহতী কাজে নিয়োজিত মিল্ক ভিটা। দেশে সমবায় বিপ্লবের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যেই মিল্ক ভিটার সৃষ্টি হয়েছিল। মিল্ক ভিটা একক কোনো ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান নয়। এটি জাতীয় সমবায় প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ১৩ লক্ষাধিক সমবায়ী ও তাঁদের পরিবার। তাঁরাই মিল্ক ভিটার প্রাণ। তাঁদের পরম স্নেহে লালিত-পালিত হচ্ছে হাজার হাজার উন্নত জাতের গাভি। এসব গাভির দুই থেকে আড়াই লাখ লিটার দুধ দীর্ঘ গ্রামীণ রাস্তা বা নদীপথ পাড়ি দিয়ে ট্রাক্টর, নৌকা, ট্রলার বা ট্রলিযোগে মিল্ক ভিটার কাছে পৌঁছে দেন সমবায়ীরা। অতঃপর এ দুধ মিল্ক ভিটার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্যাংকারে দুই-চার শ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক অতিক্রম করে আসছে ঢাকায়। বাংলাদেশে পাস্তুরিত দুধ উৎপাদনের সূচনা মিল্ক ভিটার হাতেই। মিল্ক ভিটার ভোক্তা শিশু, শিক্ষার্থী, বৃদ্ধ, রোগী, চিকিৎসকসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। প্রতিদিন দুই হাজার প্রাথমিক সমবায় সমিতির এক লাখ খামারি গড়ে কমবেশি দুই থেকে আড়াই লাখ লিটার দুধ মিল্ক ভিটায় সরবরাহ করেন।
এ দুধ প্রক্রিয়াজাত হয়ে প্যাকেটজাত তরল দুধ, ঘি, মাখন, দই, আইসক্রিম হিসেবে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ভোক্তাদের কাছে যায়। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার নিয়মিত গ্রাহক। গরুর দুধ উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য, যা শিশু, রোগী, বৃদ্ধসহ সাধারণ মানুষের জীবনধারণের অপরিহার্য উপাদান। বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মেধা গঠনে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণে দুধ আবশ্যকীয়। ফরমালিন ও ভেজালের আতঙ্কে মানুষ যেখানে ফলমূল খাওয়া বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছে, সেখানে বিশুদ্ধ দুধই একমাত্র অবলম্বন। দুধেই রয়েছে শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ, প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরের ক্ষয়পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। বিশুদ্ধ দুধ সরবরাহের প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিল্ক ভিটার ওপর সবার আছে ব্যাপক আস্থা। শুধু দুধ উৎপাদন নয়, পাশাপাশি মিল্ক ভিটা ঋণের মাধ্যমে গাভি সরবরাহ, বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা, প্রতিষেধক ও ওষুধ সরবরাহ এবং কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে শ্বেত বিপ্লব ঘটাচ্ছে। জনগণের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা সাম্প্রতিক অবরোধ ও হরতালে এখন স্থবির। শিশু, শিক্ষার্থী এবং রোগীদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না দুধ। রোগীদের দুর্ভোগ, শিশুদের কান্না এবং শিক্ষার্থীদের বেদনা কি সংশ্লিষ্ট অবরোধকারীদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না? অথচ দুধের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাওয়া মৌলিক মানবিক অধিকার। অবরোধের কারণে খামারিরা দুধ সরবরাহ করতে না পেরে অবলীলায় নদী-নালা,
খালে-বিলে দুধ ফেলে দিচ্ছেন। শুধু চট্টগ্রামের পটিয়ায় দৈনিক চার-পাঁচ হাজার লিটার দুধ ফেলে দিচ্ছেন খামারিরা। সড়কপথে নিরাপত্তাঝুঁকির কারণে মিল্ক ভিটার দুধ সংগ্রহ ও বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। অবরোধে শুধু খামারিদের ক্ষতি নয়, দুধ পরিবহনে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি, দুধ বিক্রির সঙ্গে জড়িত পরিবেশক এবং তাঁদের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও বন্ধ। এভাবে মিল্ক ভিটার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও শ্রেণীর জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে আছে। এমনকি গোখাদ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় গবাদিপশুর খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। গোখাদ্যের সংকটে পড়ে খামারিরা অসহায় এবং তাঁদের পালিত অবলা পশুরাও এখন নিরুপায়। এখন সারা দেশে পরীক্ষার মৌসুম। এ সময় শিক্ষার্থীদের দুধ পানের প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু দুধ না খেয়ে শিক্ষার্থীরা ছুটছে পরীক্ষার হলে। এ পুষ্টিহীনতা অনিবার্যভাবে বয়ে আনবে মেধাহীনতা। হরতাল-অবরোধে বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দৈনিক মিল্ক ভিটার আর্থিক ক্ষতি ৫০ লাখ টাকা, সমবায়ী কৃষকদের ক্ষতি ৩০ লাখ টাকা, সমিতির কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধজনিত ক্ষতি চার লাখ টাকা, দুধ পরিবহনকারী শ্রমিকদের মজুরি বন্ধজনিত ক্ষতি ৪.৫ লাখ টাকা, পরিবেশকদের আর্থিক ক্ষতি ৪.২৬ লাখ টাকা, খুচরা বিক্রেতাদের আর্থিক ক্ষতি ১০.৭০ লাখ টাকা,
ভ্যানচালক-শ্রমিকদের মজুরি বন্ধজনিত ক্ষতি ২.৫ লাখ টাকা। এভাবে প্রতিদিন সম্মিলিত আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা। তরল দুধের এ সংকটে অপরিহার্যভাবে গুঁড়া দুধের আমদানি ও ব্যবহার বেড়ে যাবে। গুঁড়া দুধে ভেজাল, তেজস্ক্রিয়তা ও মেলামিনের ঝুঁকি থাকে। দেশের জনসংখ্যার মাথাপিছু দৈনিক দুধের প্রাপ্তি মাত্র ৬০-৭০ মিলিলিটার অথচ ন্যূনতম চাহিদা ২৫০ মিলিলিটার। অব্যাহত অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত সমবায়ীরা গাভি পালন এবং দুধ উৎপাদন থেকে সরে দাঁড়ালে হারিয়ে যাবে সম্ভাবনাময় এ শিল্প। অথচ কৃষিজমি সাশ্রয় এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য দুগ্ধ শিল্প বিকাশের বিকল্প নেই, যা পরিবেশবান্ধব শিল্প। যেখানে ইটভাটার লেলিহান শিখায় গ্রামগঞ্জে পরিবেশ বিপন্ন, সেখানে একমাত্র দুগ্ধ শিল্পের মাধ্যমে জাতির স্বাস্থ্যরক্ষা এবং দূষণমুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা সম্ভব। ১৯৯০ সাল থেকে মিল্ক ভিটা এযাবৎ ১০০ কোটি ৪২ লাখ লিটার কাঁচা তরল দুধ সমবায়ীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে মূল্য বাবদ তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছে দুই হাজার ২৫২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। একই সঙ্গে সম্পূরক দুগ্ধ মূল্য (প্রণোদনা) দিয়েছে ৭৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। মিল্ক ভিটার সামনে অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু আছে পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতা। সে প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে কোমলমতি শিশু, কিশোর, শিক্ষার্থী ও রোগীদের জীবন, মেধা ও স্বাস্থ্যরক্ষার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মানবিকতার চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসার বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি এ ক্রান্তিলগ্নে।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিল্ক ভিটা।
mmunirc@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.