এ তোমার, এ আমার পাপ by বিমল সরকার
ক্ষমতার
মোহে অন্ধ হয়ে নিজের বা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিল কিংবা রক্ষা করার
জন্য আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কী করতে পারেন আর কী না করতে পারেন, তা কি আর
নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে? ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং একবার
কোনোরকমে ক্ষমতায় যেতে পারলে তা ধরে রাখার জন্য যে কোনো উপায় অবলম্বন করা
তাদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি যত বড় দলের শীর্ষ নেতাই
হোন আর মাঝারি বা সাধারণ স্তরের কোনো নেতাই হোন, বলতে গেলে সবার ক্ষেত্রে
(বিশেষ করে গত তিন দশক যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন) কথাটি সমানভাবে
প্রযোজ্য। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তামাশা কম
হয়নি। তিন দফা তফসিল পরিবর্তনের পর শেষ পর্যন্ত রমজান মাসে অনুষ্ঠিত হয়
নির্বাচনটি। অন্য দল বা স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থী না দাঁড়ানোয় সংসদের মোট
৩০০ আসনের মধ্যে ৪৮টিতেই ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় প্রার্থীকে বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই সারা
দেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। সরকার ও বিরোধী পক্ষ একেবারে মারমুখো হওয়ায় জনজীবনে
দেখা দেয় চরম অনিশ্চয়তা। নির্বাচনের আগে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরের
কয়েকটি শিরোনাম এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি : ১. বিপুল
সংখ্যায় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নির্বাচনবিরোধী তৎপরতার জবাব দিতে হবে-
প্রধানমন্ত্রী, ২. ১৫ ফেব্র“য়ারি কোনো নির্বাচন হবে না, হতে পারে না, হতে
দেয়া হবে না- শেখ হাসিনা, ৩. ১৫ তারিখের আগেই এ সরকারের পতন ঘটাতে হবে-
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ৪. প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াই এখন দেশের জন্য
সবচেয়ে বড় সমস্যা- মুফতি ফজলুল হক আমিনী, (ইনকিলাব, ১৩.০২.১৯৯৬)।
ইনকিলাবেরই পরদিনের সংখ্যার আরও কয়েকটি খবরের শিরোনাম- ১. বিবিসির খবর :
উত্তরাঞ্চলে একশ’ প্রার্থীর পলায়ন, ২. বিএনপি প্রার্থীদের ব্যাপক নির্বাচনী
তৎপরতা : এ নির্বাচন স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, ৩.
রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে নির্বাচনের পর আলোচনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া
হবে- প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, ৪. নির্বাচনী দায়িত্ব এড়াতে ২৩ হাজার
কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছুটি চেয়েছেন, ৫. নিরাপত্তার অভাবে স্বতন্ত্র ও অনেক
দলীয় প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, ৬. নির্বাচনের পর সংলাপের
নামে বিএনপি জাতিকে ধোঁকা দিতে চাচ্ছে- জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল
(ইনকিলাব, ১৪.০২.১৯৯৬)। আর ভোটের দিন (১৫.০২.১৯৯৬) ইনকিলাবে শিরোনাম হয়- ১.
দাতা দেশসমূহের কাছে অনুরোধ অবৈধ নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবেন না- শেখ
হাসিনা, ২. এ পর্যন্ত সহিংসতায় একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারসহ ৪ জন পুলিশ
সদস্যের মৃত্যু, ৩. নরসিংদীতে দিগম্বর করে ফেলায় শাড়ি পরে প্রধান শিক্ষকের
পলায়ন, ৪. যশোরে ৩০ জন প্রার্থীই ভয়ে এলাকা ছেড়ে আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গেছেন।
এ খবরটিতে উল্লেখ করা হয়, যশোরের ৬টি আসনের মোট ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে
বিএনপি ও বিএনপির বিদ্রোহী গ্র“পের ৮ জন প্রার্থী ছাড়া কার্যত কোনো
প্রার্থী পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত দিতে পারেননি। নির্বাচনের পরদিন ইনকিলাবে
প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম- ১. দেড় শতাধিক কেন্দ্রে নির্বাচন পণ্ড, ২.
রংপুরে প্রবল প্রতিরোধ : ৪৮৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৮৫টিতে কোনো ভোট হয়নি, ৩.
ভোয়ার খবর : বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ মাত্র ৫ থেকে ১০
ভাগ। ঢাকায় ভোটদানের পর সাংবাদিকদের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেদিন বলেছিলেনন, ‘আমার খুব ভালো লাগছে।’
বেগম জিয়া অপর এক বিবৃতিতে সাধারণ নির্বাচনে ‘শান্তিপূর্ণ ও
স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটদান করার জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানান।’
আশির দশকে এরশাদের অধীন অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচন এবং নব্বইয়ের দশকে বেগম খালেদা জিয়ার আমলে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের দুঃসহ সব স্মৃতি বোধকরি দেশবাসীর মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। ভুলে যায়নি কেউ ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির ঘোষিত নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতির কথাও (যা অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮)। আর দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সাম্প্রতিক একের পর এক যা ঘটে চলেছে তা তো এখনও হিসাব-নিকাশের বিষয় হয়েই রয়েছে। তিন প্রধান দলের নেতারা ক্ষমতায় থেকে সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা যা বলেছেন বা বলছেন কিংবা করেছেন বা করছেন, বিরোধী দলে থেকে তারা সবাই মোটামুটি একই বয়ান শুনিয়েছেন বা শোনাচ্ছেন। কম-বেশি সবাই সংবিধানের পাঠ শেখান। স্বাধীনতার পর কয়েকটি বছর যেতে না যেতেই, বিশেষ করে আশির দশকের শেষার্ধ থেকে উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকরা সংবিধানের এ ধরনের ‘পাঠ’ আমাদের জাতীয় নির্বাচনের ‘সিলেবাসে’ অন্তর্ভুক্ত করেন। একেকটি সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওই ‘পাঠদানের’ জন্য তারা সদলবলে উঠেপড়ে লেগে যান। জানি না কথিত ওই সিলেবাসের পাঠদান কবে নাগাদ শেষ করতে পারবেন আমাদের রাজনীতিকরা। আর ‘গুরুদক্ষিণা’ হিসেবে তাদের উদ্দেশে আরও কী পরিমাণ রক্তইবা উৎসর্গ করতে হবে গোটা জাতিকে (!)।
পরিশেষে জাতির সংকটকালে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে চাই- ‘কার নিন্দা করো তুমি, কারে দাও শাপ/এ তোমার এ আমার পাপ।’
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
আশির দশকে এরশাদের অধীন অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচন এবং নব্বইয়ের দশকে বেগম খালেদা জিয়ার আমলে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের দুঃসহ সব স্মৃতি বোধকরি দেশবাসীর মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। ভুলে যায়নি কেউ ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির ঘোষিত নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতির কথাও (যা অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮)। আর দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সাম্প্রতিক একের পর এক যা ঘটে চলেছে তা তো এখনও হিসাব-নিকাশের বিষয় হয়েই রয়েছে। তিন প্রধান দলের নেতারা ক্ষমতায় থেকে সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা যা বলেছেন বা বলছেন কিংবা করেছেন বা করছেন, বিরোধী দলে থেকে তারা সবাই মোটামুটি একই বয়ান শুনিয়েছেন বা শোনাচ্ছেন। কম-বেশি সবাই সংবিধানের পাঠ শেখান। স্বাধীনতার পর কয়েকটি বছর যেতে না যেতেই, বিশেষ করে আশির দশকের শেষার্ধ থেকে উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকরা সংবিধানের এ ধরনের ‘পাঠ’ আমাদের জাতীয় নির্বাচনের ‘সিলেবাসে’ অন্তর্ভুক্ত করেন। একেকটি সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওই ‘পাঠদানের’ জন্য তারা সদলবলে উঠেপড়ে লেগে যান। জানি না কথিত ওই সিলেবাসের পাঠদান কবে নাগাদ শেষ করতে পারবেন আমাদের রাজনীতিকরা। আর ‘গুরুদক্ষিণা’ হিসেবে তাদের উদ্দেশে আরও কী পরিমাণ রক্তইবা উৎসর্গ করতে হবে গোটা জাতিকে (!)।
পরিশেষে জাতির সংকটকালে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে চাই- ‘কার নিন্দা করো তুমি, কারে দাও শাপ/এ তোমার এ আমার পাপ।’
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
No comments