বিএনপির নির্বাচন বর্জনে কার লাভ, কার ক্ষতি by বদিউর রহমান
নির্বাচনের
তফসিল ঘোষিত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগের দিন সমঝোতার জন্য সময়
দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেও পরদিন সোমবার তফসিল ঘোষণা করে আমাদের হতবাকই
করেছেন বটে। দেখা গেল, তিনি নিজের সিদ্ধান্ত থেকেই সরে গেলেন। তারপর আবার
বললেন, সমঝোতা হলে পুনঃতফসিল ঘোষণা করা যাবে। সমঝোতা হলে তো সাংবিধানিক
মেয়াদের পরও তফসিল ঘোষণা অসম্ভব নয়। এরশাদবিরোধী ’৯০-র গণঅভ্যুত্থানের সময়
কি আমরা আপসে আজগুবি কাজ করিনি? প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে
উপরাষ্ট্রপতি করার জন্য মওদুদকে পদত্যাগ করিয়ে পরে সাহাবুদ্দীন সাহেবকে
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে কাজ চালিয়ে আবার নির্বাচন শেষে সংবিধান সংশোধনের
মাধ্যমে কৃতকর্মকে জায়েজ করে তাকে আবার প্রধান বিচারপতি পদে আসীন করার
ব্যবস্থা করিনি? আপসে কী না হয়! কিন্তু তেমন জটিল এক অবস্থা সৃষ্টির আগে তো
সিইসি সাহেব তফসিল ঘোষণায় আরও কয়েক দিন সময় নিয়ে সমঝোতার সুযোগ দেয়ার
লক্ষ্যে অপেক্ষা করতে পারতেন এবং সেটা হতো উত্তম। বিরোধী দলের অবরোধ
কর্মসূচির জীবননাশের, সহিংসতার দায়ভার হয়তো তখন তার ওপর বর্তাতো না। ২৪
জানুয়ারি শেষ সময় বিবেচনায় রেখে সম্ভাব্য সময় দিলে তার কথা বলার সুযোগ থাকত
যে, কমিশন শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে।
যাক, যে কারণেই তিনি তার কথার বরখেলাপ করে তফসিল ঘোষণা করুন না কেন, কপালের লিখন বা দুর্দশা আমাদের মেনে নিতেই হচ্ছে। দেশ রসাতলে যাক, ১৮ কেন ১৮০০ বা ১৮০০০ মরলে, আগুনে পুড়লেও দুই নেত্রীর কী বা যায় আসে। তাদের তো ক্ষমতা চাই, কেবল ক্ষমতা। তবে দোহাই হবে- একজনের সাংবিধানিক ধারা উপহার দেয়ার, আরেকজনের দেশ রক্ষার। তাদের জয়-পুতুল কিংবা তারেক-কোকো তো ককটেলের আগুনে পুড়ে মরছে না। তারা দু’জনও স্বজন হারিয়েছেন, তাদেরও কষ্ট আছে; কিন্তু বার্ন ইউনিটে পুড়ে মরা দেখা কেমন, তা যদি জয়-পুতুল-তারেক-কোকোকে দিয়ে তারা বাস্তবে দেখতেন, তাহলে এই অপরাজনীতি থেকে তারা সরে আসতেন কি-না আল্লাহ মালুম।
থাকগে, তফসিল যেহেতু ঘোষিত হয়েছে, নির্বাচন হবে বলা যায়। বাজাদ (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) কিংবা সম্মিলিতভাবে অন্য বিরোধী সব দল যদি আন্দোলনের মাধ্যমে, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে, নৃশংস হত্যার মাধ্যমে, দেশ অচল করার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে সরাতে না পারে, অথবা কোনো প্রকার সমঝোতার মাধ্যমে যদি সমস্যার সমাধান না করতে পারে, তাহলে হয়তো একতরফা নির্বাচনই হবে। বাজাদ এবং অন্য বিপক্ষ দলগুলোর একমাত্র লক্ষ্য এখন শেখ হাসিনাকে বাদ দেয়া। তার অধীনে নির্বাচন নয়। শেখ হাসিনারও সাংবিধানিক জেদ তার অধীনে নির্বাচন হতে হবে। জেদাজেদি যা-ই চলুক, নির্বাচন নিয়ে এখন আমার মতে তিনটি অবস্থা বিদ্যমান। এক. বাজাদসহ নির্বাচন হওয়া; দুই. বাজাদ বাদে নির্বাচন হওয়া; তিন. নির্বাচন না হয়ে তৃতীয় কোনো শক্তির দখলে শাসনভার চলে যাওয়া। দেখা যাক কোন অবস্থায় কার লাভ-ক্ষতি কতটুকু।
প্রথমে আমরা ধরে নেই, চমকপ্রদভাবে একটা সমঝোতা হয়ে গেল, বাজাদ নির্বাচনে অংশ নিল। শেখ হাসিনার অধীনেই হোক বা অন্য কারও নেতৃত্বেই হোক, একটা সফল নির্বাচন হয়ে গেল। বিভিন্ন জরিপ কিংবা পাঁচ সিটির মেয়র নির্বাচনের ফলাফল, প্রচুর উন্নয়ন সত্ত্বেও আলীর প্রতি জনগণের নেতিবাচক মনোভাব, শেয়ার কেলেংকারি, হলমার্ক-ডেসটিনি-বিসমিল্লাহ-পদ্মা মিলে নেতিবাচক জনপ্রিয়তায় বাজাদ জয়ী হয়ে গেল। এতে লাভ বেশি কার- আলীর না বাজাদের? সহজ-সরল উত্তর হবে, বাজাদের। বাজাদ বড় গলায় বলতে পারবে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াও তারা বিজয়ী হয়েছে, তাদের জনপ্রিয়তা আর কাকে বলে, আরও কত কী! কিন্তু আমি বলব, এক্ষেত্রে প্রকৃত জয়টি হবে আলীর (আওয়ামী লীগের)। আলী তখন বিরোধী দলে গিয়েও বুক ফুলিয়ে বলবে, তাদের অধীনে তাদের দ্বারাই নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। বাজাদ জামায়াত-শিবিরের সহযোগিতায় অযথা দেশে এতদিন নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, জীবন ও সম্পদের হানি ঘটিয়েছে- এসবের জন্য তাদের বিচার হওয়া দরকার। বাজাদ সরকার তখন আরেক মুশকিলে পড়বে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে। তখন জামায়াত থেকে চোখ-ফেরানো ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকবে না। বিচারের ধারাবাহিকতা না রাখলে বা রায় কার্যকর না করলে অল্প সময়ের মধ্যে বাজাদের বিরুদ্ধে আলীর আন্দোলন চাঙ্গা হবে এবং বাজাদ সরকার বড় বেকায়দায় পড়বে। অপরদিকে জামায়াত-শিবির থেকে মুখ ফেরালে বাজাদ আলী, জামায়াত সবার চাপে আরও চ্যাপটা হয়ে যাবে। বাজাদের ১৮ দলীয় শরিক এবং অন্য সমর্থকদের যথা- কামাল, বদরুদ্দোজা, অলি, রব, কাদের গংদের চাওয়া-পাওয়ার সম্মান দিতেও বাজাদ হিমশিম খাবে। কত বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় যাবে বাজাদ তাও এক বিবেচ্য। সংবিধান সংশোধনের মতো গরিষ্ঠতা না পেলে আলীর সংশোধিত পঞ্চদশ সংশোধনের ‘উপকারিতা’ই তাদের ভোগ করতে হবে। আরও কত যে ঝামেলা থাকবে বাজাদের! আলীকে সামাল দেয়া হবে এক মহাঝামেলা। কিন্তু সবচেয়ে বড় গলা থাকবে আলীর, তারা কথা রেখেছে- সফল নির্বাচন করে দিতে পেরেছে, নয় কি?
এবার মনে করি সমঝোতা হবে না, বাজাদ নির্বাচনে এলো না, কিন্তু আলী একা নির্বাচন সেরে ফেলল। এ নির্বাচন অবশ্যই ১৫ ফেব্র“য়ারির ’৯৬ মার্কা হবে না। কেননা এতে জাপা, জেপি, ইনু-মেননরা তো অন্তত আছেন। সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দীলিপ বড়–য়াকে বাদ দেব কেন? যদিও অতি সম্প্রতি জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে এরশাদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ইনু, মেনন মাঠে কম বড় নন, ভোটে না হোক, কণ্ঠে তো অন্তত। এর মাঝে যদি আরও কাউকে ভেড়ানো যায় তা তো আরও ভালো। বিএনএফ যদি একটা ফ্যাক্টর হয় এবং বাজাদের অনেকে যদি এদিক-সেদিক করে নির্বাচনে শামিল হয়ে যায় অথবা তাদের শামিল করানো যায়, তাহলে তো একটি ভালো গ্রহণযোগ্যতা এসে যাবে, নাকি? নির্বাচনমুখী বাজাদের অনেক নেতাকর্মী কি সাত বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর আবারও আরও পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে ধৈর্যশীল হবে? আমার তো অন্তত মনে হয় না। হাল-সময়ের হরতাল-অবরোধে বাজাদের বড় নেতাদের কি আমরা মাঠে দেখছি? খালেদা জিয়ার নির্দেশে কি কোনো কাজ হচ্ছে? এটা কিসের আলামত? অবশ্যই বাজাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচন চান, দলের বর্তমান জনপ্রিয়তায়, হোক না তা আলী-বিরাগে নেতিবাচক, তারা কেন ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেবে না? অতএব বাজাদ স্বীকৃতভাবে নির্বাচনে না এলেও তাদের অনেক নেতা ভিন্নভাবে নির্বাচনে আসবে। ফলে বাজাদে আবার ভাঙন ধরবে, দল বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এতে আবারও লাভবান হবে আলী। শেখ হাসিনা কিন্তু সংস্কারপন্থীদের র্যাটস (জঅঞঝ) থেকে শেষ মুহূর্তে হলেও স্টার (ঝঞঅজ) করে দিয়েছেন। বেঁচে থাকলে রাজ্জাকও (জ) এ সুবিধায় আসতেন, বেঁচে না থেকেও তিনি এখন স্টারভুক্তই হলেন। খালেদা জিয়া কিন্তু এখনও তাদের অর্থাৎ তার দলের সংস্কারপন্থীদের পুরো পুনর্বাসন করেননি। জিয়ার বাজাদ ভেঙে বদরুদ্দোজার বিকল্প ধারা, কর্নেল অলির এলডিপি, জাহানারাদের বিএনএফ, ব্যানাহুদার সমর্থক- কত ভাগ যে হয়ে গেল! এবার নির্বাচনে না এলে হয়তো আরও ভাঙন হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একবার নির্বাচন হয়ে গেলে আলী ক্ষমতায় এসে এরশাদকে বিরোধী দলে বসিয়ে সরকারের নৈতিক অধিকার পেয়ে আরও শক্ত হয়ে যাবে। তখন কি আর বাজাদের আন্দোলনের বড় কোনো নৈতিক অধিকার বা ইস্যু থাকবে? এখন অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও বাজাদ ফলপ্রসূ কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, বরং বলা চলে, আলীর বাজাদের হাতে তুলে দেয়া বড় বড় ইস্যুকেও যেখানে বাজাদ কাজে লাগাতে পারেনি, তখন আর কি পারবে? আমার তো মনে হয় না। আলী এ মেয়াদে অনেক ভালো কাজ করেছে, উন্নয়ন করেছে, আলী তখন উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মনোযোগী হবে এবং পূর্বতন ভুল না করার জন্য সচেষ্ট হবে। ফলে আলীর পরবর্তী সরকার শিগগিরই জনসমর্থন পেতে কার্যকরভাবে সফল হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা তখন সত্যি সত্যি লৌহমানবী হওয়ার ভূমিকায় যাবেন। তখন বর্তমান আন্দোলনের সহিংসতা, মৃত্যুর দায় সবই যাবে বাজাদ নেতাদের ওপর। কী কী মামলা যে হবে তখন, তা সহজেই ধারণা করা যায়। তখন নিশ্চয়ই সামান্য হাতুড়ি দিয়ে নয়াপল্টনের বাজাদ কার্যালয় ভাঙার ছেলেমানুষি করবে না পুলিশ, যা হবে বেশ ভারিই হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় যথারীতি দ্রুত বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। বাজাদের আন্দোলনের শক্তি জামায়াত-শিবির শেষের খাতায়। তাহলে বাজাদ আর আন্দোলন করবে কাকে নিয়ে? ছাত্রদল তো এখনই নেই, তখন তাদের পাবে কোথায়? অতএব, ৫+২+৫=১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বাজাদ কোথায় যে যাবে বোঝা মুশকিল। মনে রাখা দরকার, বাজাদ কিন্তু আলী নয় যে, ২১ বছর পরও বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা হারিয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে? খালেদা না থাকলে বা অসুস্থ হয়ে গেলে তারেক আর একা কতটা কী করবেন? সিনিয়র নেতাদের মাথার উপরে চেপে বসা তারেককে তখন তারা আর মানবেন? অতএব আলীর এ অবস্থায়ও লাভ, বরং নিশ্চিত বড় লাভ। বাজাদ নির্বাচনে না এলেই বরং আলী মহাখুশি হবে। এমনটি ভাবা বোধহয় এখন সহজ বিষয়। এমন সুযোগ আলীকে না দেয়ার জন্য বাজাদের নির্বাচনে আসাই উত্তম হবে।
সর্বশেষ অবস্থা যদি এমন হয়, হাসিনা-খালেদার জেদ ও অনড় অবস্থানের কারণে দেশজুড়ে জীবনহানি এবং সহিংসতা এমন পর্যায়ে গেল যে জরুরি অবস্থা জারি করতে হল, তাহলেও লাভ আলীর। আলী আরও সময় ক্ষমতায় থাকল। আর তা না হয়ে যদি তৃতীয় শক্তি শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়, তাহলেও লাভ আলীরই। কারণ আলীকে বাজাদের কাছে হারতেও হল না। পরাজয়ও মেনে নিতে হল না। তৃতীয় শক্তি দু’-চার বছর যা-ই থাকে, আলী চুপ থাকল। তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক জনঅসন্তোষ ধীরে ধীরে কমে গেল। পরবর্তী সময়ে একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আবার নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে আলী ফের পহেলেছে শুরু করে মাঠে নামবে। এ ফাঁকে তারা তাদের ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তা আবার ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবে। তাদের অপকর্ম মানুষ অনেকাংশে ভুলে যাবে। তবে বাজাদ পড়ে যাবে আরও ফাঁকে। অতএব এতেও লাভ আলীর। আমার বিবেচনায় তিন অবস্থায়ই আলী লাভবান হচ্ছে। অতএব, নিজের ক্ষতি না করে নির্বাচনে আসাই বাজাদের জন্য লাভজনক।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
যাক, যে কারণেই তিনি তার কথার বরখেলাপ করে তফসিল ঘোষণা করুন না কেন, কপালের লিখন বা দুর্দশা আমাদের মেনে নিতেই হচ্ছে। দেশ রসাতলে যাক, ১৮ কেন ১৮০০ বা ১৮০০০ মরলে, আগুনে পুড়লেও দুই নেত্রীর কী বা যায় আসে। তাদের তো ক্ষমতা চাই, কেবল ক্ষমতা। তবে দোহাই হবে- একজনের সাংবিধানিক ধারা উপহার দেয়ার, আরেকজনের দেশ রক্ষার। তাদের জয়-পুতুল কিংবা তারেক-কোকো তো ককটেলের আগুনে পুড়ে মরছে না। তারা দু’জনও স্বজন হারিয়েছেন, তাদেরও কষ্ট আছে; কিন্তু বার্ন ইউনিটে পুড়ে মরা দেখা কেমন, তা যদি জয়-পুতুল-তারেক-কোকোকে দিয়ে তারা বাস্তবে দেখতেন, তাহলে এই অপরাজনীতি থেকে তারা সরে আসতেন কি-না আল্লাহ মালুম।
থাকগে, তফসিল যেহেতু ঘোষিত হয়েছে, নির্বাচন হবে বলা যায়। বাজাদ (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) কিংবা সম্মিলিতভাবে অন্য বিরোধী সব দল যদি আন্দোলনের মাধ্যমে, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে, নৃশংস হত্যার মাধ্যমে, দেশ অচল করার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে সরাতে না পারে, অথবা কোনো প্রকার সমঝোতার মাধ্যমে যদি সমস্যার সমাধান না করতে পারে, তাহলে হয়তো একতরফা নির্বাচনই হবে। বাজাদ এবং অন্য বিপক্ষ দলগুলোর একমাত্র লক্ষ্য এখন শেখ হাসিনাকে বাদ দেয়া। তার অধীনে নির্বাচন নয়। শেখ হাসিনারও সাংবিধানিক জেদ তার অধীনে নির্বাচন হতে হবে। জেদাজেদি যা-ই চলুক, নির্বাচন নিয়ে এখন আমার মতে তিনটি অবস্থা বিদ্যমান। এক. বাজাদসহ নির্বাচন হওয়া; দুই. বাজাদ বাদে নির্বাচন হওয়া; তিন. নির্বাচন না হয়ে তৃতীয় কোনো শক্তির দখলে শাসনভার চলে যাওয়া। দেখা যাক কোন অবস্থায় কার লাভ-ক্ষতি কতটুকু।
প্রথমে আমরা ধরে নেই, চমকপ্রদভাবে একটা সমঝোতা হয়ে গেল, বাজাদ নির্বাচনে অংশ নিল। শেখ হাসিনার অধীনেই হোক বা অন্য কারও নেতৃত্বেই হোক, একটা সফল নির্বাচন হয়ে গেল। বিভিন্ন জরিপ কিংবা পাঁচ সিটির মেয়র নির্বাচনের ফলাফল, প্রচুর উন্নয়ন সত্ত্বেও আলীর প্রতি জনগণের নেতিবাচক মনোভাব, শেয়ার কেলেংকারি, হলমার্ক-ডেসটিনি-বিসমিল্লাহ-পদ্মা মিলে নেতিবাচক জনপ্রিয়তায় বাজাদ জয়ী হয়ে গেল। এতে লাভ বেশি কার- আলীর না বাজাদের? সহজ-সরল উত্তর হবে, বাজাদের। বাজাদ বড় গলায় বলতে পারবে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াও তারা বিজয়ী হয়েছে, তাদের জনপ্রিয়তা আর কাকে বলে, আরও কত কী! কিন্তু আমি বলব, এক্ষেত্রে প্রকৃত জয়টি হবে আলীর (আওয়ামী লীগের)। আলী তখন বিরোধী দলে গিয়েও বুক ফুলিয়ে বলবে, তাদের অধীনে তাদের দ্বারাই নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। বাজাদ জামায়াত-শিবিরের সহযোগিতায় অযথা দেশে এতদিন নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, জীবন ও সম্পদের হানি ঘটিয়েছে- এসবের জন্য তাদের বিচার হওয়া দরকার। বাজাদ সরকার তখন আরেক মুশকিলে পড়বে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে। তখন জামায়াত থেকে চোখ-ফেরানো ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকবে না। বিচারের ধারাবাহিকতা না রাখলে বা রায় কার্যকর না করলে অল্প সময়ের মধ্যে বাজাদের বিরুদ্ধে আলীর আন্দোলন চাঙ্গা হবে এবং বাজাদ সরকার বড় বেকায়দায় পড়বে। অপরদিকে জামায়াত-শিবির থেকে মুখ ফেরালে বাজাদ আলী, জামায়াত সবার চাপে আরও চ্যাপটা হয়ে যাবে। বাজাদের ১৮ দলীয় শরিক এবং অন্য সমর্থকদের যথা- কামাল, বদরুদ্দোজা, অলি, রব, কাদের গংদের চাওয়া-পাওয়ার সম্মান দিতেও বাজাদ হিমশিম খাবে। কত বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় যাবে বাজাদ তাও এক বিবেচ্য। সংবিধান সংশোধনের মতো গরিষ্ঠতা না পেলে আলীর সংশোধিত পঞ্চদশ সংশোধনের ‘উপকারিতা’ই তাদের ভোগ করতে হবে। আরও কত যে ঝামেলা থাকবে বাজাদের! আলীকে সামাল দেয়া হবে এক মহাঝামেলা। কিন্তু সবচেয়ে বড় গলা থাকবে আলীর, তারা কথা রেখেছে- সফল নির্বাচন করে দিতে পেরেছে, নয় কি?
এবার মনে করি সমঝোতা হবে না, বাজাদ নির্বাচনে এলো না, কিন্তু আলী একা নির্বাচন সেরে ফেলল। এ নির্বাচন অবশ্যই ১৫ ফেব্র“য়ারির ’৯৬ মার্কা হবে না। কেননা এতে জাপা, জেপি, ইনু-মেননরা তো অন্তত আছেন। সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দীলিপ বড়–য়াকে বাদ দেব কেন? যদিও অতি সম্প্রতি জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে এরশাদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ইনু, মেনন মাঠে কম বড় নন, ভোটে না হোক, কণ্ঠে তো অন্তত। এর মাঝে যদি আরও কাউকে ভেড়ানো যায় তা তো আরও ভালো। বিএনএফ যদি একটা ফ্যাক্টর হয় এবং বাজাদের অনেকে যদি এদিক-সেদিক করে নির্বাচনে শামিল হয়ে যায় অথবা তাদের শামিল করানো যায়, তাহলে তো একটি ভালো গ্রহণযোগ্যতা এসে যাবে, নাকি? নির্বাচনমুখী বাজাদের অনেক নেতাকর্মী কি সাত বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর আবারও আরও পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে ধৈর্যশীল হবে? আমার তো অন্তত মনে হয় না। হাল-সময়ের হরতাল-অবরোধে বাজাদের বড় নেতাদের কি আমরা মাঠে দেখছি? খালেদা জিয়ার নির্দেশে কি কোনো কাজ হচ্ছে? এটা কিসের আলামত? অবশ্যই বাজাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচন চান, দলের বর্তমান জনপ্রিয়তায়, হোক না তা আলী-বিরাগে নেতিবাচক, তারা কেন ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেবে না? অতএব বাজাদ স্বীকৃতভাবে নির্বাচনে না এলেও তাদের অনেক নেতা ভিন্নভাবে নির্বাচনে আসবে। ফলে বাজাদে আবার ভাঙন ধরবে, দল বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এতে আবারও লাভবান হবে আলী। শেখ হাসিনা কিন্তু সংস্কারপন্থীদের র্যাটস (জঅঞঝ) থেকে শেষ মুহূর্তে হলেও স্টার (ঝঞঅজ) করে দিয়েছেন। বেঁচে থাকলে রাজ্জাকও (জ) এ সুবিধায় আসতেন, বেঁচে না থেকেও তিনি এখন স্টারভুক্তই হলেন। খালেদা জিয়া কিন্তু এখনও তাদের অর্থাৎ তার দলের সংস্কারপন্থীদের পুরো পুনর্বাসন করেননি। জিয়ার বাজাদ ভেঙে বদরুদ্দোজার বিকল্প ধারা, কর্নেল অলির এলডিপি, জাহানারাদের বিএনএফ, ব্যানাহুদার সমর্থক- কত ভাগ যে হয়ে গেল! এবার নির্বাচনে না এলে হয়তো আরও ভাঙন হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একবার নির্বাচন হয়ে গেলে আলী ক্ষমতায় এসে এরশাদকে বিরোধী দলে বসিয়ে সরকারের নৈতিক অধিকার পেয়ে আরও শক্ত হয়ে যাবে। তখন কি আর বাজাদের আন্দোলনের বড় কোনো নৈতিক অধিকার বা ইস্যু থাকবে? এখন অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও বাজাদ ফলপ্রসূ কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, বরং বলা চলে, আলীর বাজাদের হাতে তুলে দেয়া বড় বড় ইস্যুকেও যেখানে বাজাদ কাজে লাগাতে পারেনি, তখন আর কি পারবে? আমার তো মনে হয় না। আলী এ মেয়াদে অনেক ভালো কাজ করেছে, উন্নয়ন করেছে, আলী তখন উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মনোযোগী হবে এবং পূর্বতন ভুল না করার জন্য সচেষ্ট হবে। ফলে আলীর পরবর্তী সরকার শিগগিরই জনসমর্থন পেতে কার্যকরভাবে সফল হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা তখন সত্যি সত্যি লৌহমানবী হওয়ার ভূমিকায় যাবেন। তখন বর্তমান আন্দোলনের সহিংসতা, মৃত্যুর দায় সবই যাবে বাজাদ নেতাদের ওপর। কী কী মামলা যে হবে তখন, তা সহজেই ধারণা করা যায়। তখন নিশ্চয়ই সামান্য হাতুড়ি দিয়ে নয়াপল্টনের বাজাদ কার্যালয় ভাঙার ছেলেমানুষি করবে না পুলিশ, যা হবে বেশ ভারিই হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় যথারীতি দ্রুত বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। বাজাদের আন্দোলনের শক্তি জামায়াত-শিবির শেষের খাতায়। তাহলে বাজাদ আর আন্দোলন করবে কাকে নিয়ে? ছাত্রদল তো এখনই নেই, তখন তাদের পাবে কোথায়? অতএব, ৫+২+৫=১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বাজাদ কোথায় যে যাবে বোঝা মুশকিল। মনে রাখা দরকার, বাজাদ কিন্তু আলী নয় যে, ২১ বছর পরও বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা হারিয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে? খালেদা না থাকলে বা অসুস্থ হয়ে গেলে তারেক আর একা কতটা কী করবেন? সিনিয়র নেতাদের মাথার উপরে চেপে বসা তারেককে তখন তারা আর মানবেন? অতএব আলীর এ অবস্থায়ও লাভ, বরং নিশ্চিত বড় লাভ। বাজাদ নির্বাচনে না এলেই বরং আলী মহাখুশি হবে। এমনটি ভাবা বোধহয় এখন সহজ বিষয়। এমন সুযোগ আলীকে না দেয়ার জন্য বাজাদের নির্বাচনে আসাই উত্তম হবে।
সর্বশেষ অবস্থা যদি এমন হয়, হাসিনা-খালেদার জেদ ও অনড় অবস্থানের কারণে দেশজুড়ে জীবনহানি এবং সহিংসতা এমন পর্যায়ে গেল যে জরুরি অবস্থা জারি করতে হল, তাহলেও লাভ আলীর। আলী আরও সময় ক্ষমতায় থাকল। আর তা না হয়ে যদি তৃতীয় শক্তি শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়, তাহলেও লাভ আলীরই। কারণ আলীকে বাজাদের কাছে হারতেও হল না। পরাজয়ও মেনে নিতে হল না। তৃতীয় শক্তি দু’-চার বছর যা-ই থাকে, আলী চুপ থাকল। তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক জনঅসন্তোষ ধীরে ধীরে কমে গেল। পরবর্তী সময়ে একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আবার নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে আলী ফের পহেলেছে শুরু করে মাঠে নামবে। এ ফাঁকে তারা তাদের ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তা আবার ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবে। তাদের অপকর্ম মানুষ অনেকাংশে ভুলে যাবে। তবে বাজাদ পড়ে যাবে আরও ফাঁকে। অতএব এতেও লাভ আলীর। আমার বিবেচনায় তিন অবস্থায়ই আলী লাভবান হচ্ছে। অতএব, নিজের ক্ষতি না করে নির্বাচনে আসাই বাজাদের জন্য লাভজনক।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments