রাজনীতি- একতরফা সংবিধান সংশোধনের ফল by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এখন বিরাট সংকট চলছে। এই সংকটের সমাধান কীভাবে হবে, তা কেউ বলতে পারে না।
এক বছর যাবৎ বহু প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, ব্যক্তি ও মিডিয়া সংকট সমাধানে নানা প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছে। মহাজোট সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করেননি। তাঁর একটিই কথা, ‘সংবিধান অনুসারেই সংসদ নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনকালীন সরকারে তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।’ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সংক্ষিপ্ত রায়, কয়েকটি পর্যবেক্ষণ, এক বছর পরে চূড়ান্ত রায়, সংবিধান সংশোধনের জন্য সরকার কর্তৃক কমিটি গঠন, কমিটির বিভিন্ন সদস্যের মতামত ও সুপারিশ, সব শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় ও নির্দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি এবং এই রাজনৈতিক সংকটের জন্ম।

এ প্রসঙ্গ আর নয়। বর্তমান সংকটের সমাধান আমরা সময়ের কাছে ছেড়ে দিয়েছি। বহু প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে রয়েছে। আশা করি প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের এতে বোধোদয় হবে। সরকার ও প্রধান বিরোধী দল বড় রকমের ছাড় দিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে। নইলে দেশের পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয়, দেশে যদি কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে, তাহলে প্রধানত দুই রাজনৈতিক জোট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া দায়ী হবেন। আশা করি তাঁরা পরে অন্য কারও ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেষ্টা করবেন না। নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও টিভির টক শোকে এ জন্য দায়ী করার সুযোগ নেই। দায়ী হবেন শুধু দুই জোটের রাজনীতিবিদেরা।
আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো ভেবেছিল, ‘একক কর্তৃত্বে পঞ্চদশ সংশোধনী করে ফেলতে পারলে নির্বাচন তাদের হাতের মুঠোয় থাকবে। তাহলে বিএনপি কিছুতেই জয়লাভ করতে পারবে না।’ কিন্তু ১৮-দলীয় জোট ও বেগম খালেদা জিয়া যে দেশে এত বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন, তা সরকার স্বপ্নেও ভাবেনি। আওয়ামী মন্ত্রী ও নেতারা বিএনপির শক্তি সম্পর্কে বরাবর ভুল ধারণা দিয়ে এসেছেন। তাঁরা বহুবার বলেছেন, ‘বিএনপির পক্ষে কোনো আন্দোলন করা সম্ভব নয়।’ আন্দোলন নাকি শুধু আওয়ামী লীগই করতে জানে। তাই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, ‘তাঁরা (বিএনপি) আওয়ামী লীগের সিলেবাস দেখে আন্দোলন করছে।’
সমপ্রতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আন্দোলন করতে হলে রাস্তায় নামুন।’ কী করে নামবে? সরকার তো বিএনপি অফিস ঘেরাও করে রেখেছে। তাদের অনেক নেতাকে জেলে নিয়েছে। অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে। বিএনপি অফিসের দরজা ভেঙে দলের মুখপাত্রকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকার যদি বিএনপিকে স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন করতে দিত, তাহলে এ রকম চোরাগোপ্তা হামলা হয়তো
হতো না। সরকারের দমননীতির কারণে বিএনপি এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে পরিণত হয়েছে। এটা কি গণতন্ত্র?
গণতন্ত্রে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অর্থ গায়ের জোর নয়। গায়ের জোরে গণতন্ত্রে সবকিছু করা যায় না। গণতন্ত্রের মূল শর্তই হলো আলাপ-আলোচনা। এক ব্যক্তির শাসন বা ইচ্ছা গণতন্ত্রে অচল। পঞ্চদশ সংশোধনী করে আওয়ামী লীগ একটা বড় শিক্ষা পেয়েছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের জন্যও এটি বড় শিক্ষা।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে বড় দলগুলো কয়েকটি শিক্ষা নিতে পারে। ১) সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মৌলিক পরিবর্তন বা সংবিধান সংশোধন করা ঠিক নয়। এ রকম মৌলিক পরিবর্তন নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে জনমত নিয়ে করা উচিত। ২) মৌলিক পরিবর্তন বা বড় মাপের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে হলে প্রধান বিরোধী দলের সম্মতিতেই করা উচিত। নইলে তা স্থায়ী হয় না। ৩) দলের সভাপতি ভুল পদক্ষেপ নিতে চাইলে দলের মধ্যে এর প্রতিবাদ করা উচিত। কারণ দলপ্রধান অস্থায়ী, দল স্থায়ী। দলই দলপ্রধানের শক্তি। ৪) স্তাবকতা বা নীরবতা দিয়ে দলের উপকার হয় না। ৫) দলপ্রধান ডুবলে দলও ডুববে। দলের নেতাদের এ দেশেই রাজনীতি করতে হবে। ৬) সংসদে প্রধান বিরোধী দলের সিট কম হলেও তাদের অবজ্ঞা করতে নেই। সিট নয়, তাদের ভোটের সংখ্যা দেখা উচিত। ৭) বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ কাউকে উপেক্ষা করে রাজনীতি করতে পারবে না।
বর্তমান সংকট থেকে দুই প্রধান দল আশা করি শিক্ষা নেবে। এ রকম পরিস্থিতি যে আর কখনো হবে না, তা কেউ বলতে পারবে না। কাজেই নিজেদের সংশোধন করাই এখনকার বড় শিক্ষা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন ‘রুটিন কাজ’ পরিচালনার জন্য ৩০ সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা ও কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। অন্যবার সংসদ নির্বাচনের সময় ১১ জনের উপদেষ্টা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হতো এই ‘রুটিন কাজ’ করার জন্য। এবার ‘রুটিন কাজের’ পরিধি কি এতই বেড়েছে যে ৩০ জন মন্ত্রী-উপদেষ্টার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে? এটা খুবই রহস্যময়।
শেখ হাসিনা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার পরিচালনার সময় আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের তারকা নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। ওয়ার্কার্স পার্টির অভিজ্ঞ নেতা রাশেদ খান মেননেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। অভিজ্ঞ কূটনীতিক মাহমুদ আলীরও প্রয়োজন বোধ করেননি। তখন তিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায় ‘কচি-কাঁচাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা’ গঠন করেছিলেন। আর এখন দুই মাস ‘রুটিন কাজ’ করার জন্য এত সব তারকা নেতাকে মন্ত্রিসভায় নিলেন কেন? এটাও একটা রহস্য। মন্ত্রিসভার বাইরে থেকেও তাঁরা শেখ হাসিনাকে ‘রুটিন কাজে’ সহায়তা করতে পারতেন।
শেখ হাসিনার নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টামণ্ডলীর বহর দেখে যে কারও মনে হতে পারে, এ রকম মন্ত্রিসভা দিয়ে সংসদ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয় না। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি (শুধু ১১ জন উপদেষ্টা) ঘুরেফিরে উঠবেই। ভবিষ্যতেও উঠবে। যদি নির্বাচনকালীন বহুদলীয় মন্ত্রিসভা (উপদেষ্টা ছাড়া) ১২-১৫ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা কেউ নির্বাচনে অংশ না নেন, তাহলে এই মডেল নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা হতে পারে। নইলে শেখ হাসিনার এই মডেল এটাই প্রথম এবং সম্ভবত এটাই শেষ। আমাদের মতো দেশে (দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, পরিবারতন্ত্র, আস্থাহীনতা, পরস্পরকে শত্রু জ্ঞান করা ও অন্যান্য) সংসদ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ; যা এ নির্বাচনে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তবু কী শর্তে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হয়, তা দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করার যৌক্তিকতা অবশ্যই রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি তথা ১৮-দলীয় জোটকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দিচ্ছে না, তাদের ওপর জেল-জুলুম হচ্ছে, এটাও সত্য। কিন্তু আন্দোলনের নামে বাসে আগুন দিয়ে প্রতিদিন নিরীহ মানুষ হত্যা, মানুষ পোড়ানো, রেললাইন উপড়ে ফেলা—এগুলো নির্জলা সন্ত্রাস। আমরা কঠোর ভাষায় এর নিন্দা জানাই।
১৮-দলীয় জোটকে আন্দোলনের জন্য অন্য কৌশলের কথা ভাবতে হবে। আন্দোলনের নামে এ রকম সন্ত্রাস চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ বিএনপির প্রতি বিমুখ হয়ে যেতে পারে। অনেকে মনে করেন, বর্তমান সরকার বিএনপিকে এই সন্ত্রাসে উৎসাহিত করছে, যাতে বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। বিএনপি এই ফাঁদে পা দিয়ে ভুল করছে। বিএনপির মনে রাখা উচিত, নিরীহ সাধারণ মানুষ ও গণ-যানবাহন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না। ব্যাংককের আন্দোলনের দিকে তাকান। তারা কোথায় আক্রমণ করছে। তারা কী কী বিকল করছে। ব্যাংককের জনজীবনে এই আন্দোলন প্রভাব ফেলেনি। আন্দোলন সরকারি অফিস ও ভবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা ছাড়া এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচি হতে পারে না। এ রকম সন্ত্রাসী আন্দোলন ভবিষ্যতে বিএনপির জন্য বুমেরাংও হতে পারে। সরকারের দমননীতিতে বিএনপি এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু এভাবে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। আলোচনায় বসে দুই পক্ষ ছাড় দিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হবে।
বিএনপির পক্ষ থেকে এ রকম অভিযোগও উঠেছে যে ‘সরকারপক্ষই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, যাতে বিএনপি নিন্দিত হয়।’ এ অভিযোগের কোনো বড় প্রমাণ বিএনপি অবশ্য দিতে পারেনি। কিন্তু প্রকাশ্য রাস্তায় এত বোমাবাজি হচ্ছে, গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে, পুলিশ বা র‌্যাব সন্ত্রাসীদের হাতেনাতে গ্রেপ্তার করতে পারছে না বা গ্রেপ্তার করছে না কেন? টিভির ভিডিও ফুটেজ দেখেও তো সন্ত্রাসীদের ধরা যায়। সরকার এ অভিযোগে গ্রেপ্তার করছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের, মূল সন্ত্রাসীকে নয়। এতে এ রকম সন্দেহ হতে পারে যে সরকারপক্ষই এ সন্ত্রাস পরিচালনা করছে। পঞ্চদশ সংশোধনী করে সরকার যে আগুন জ্বালিয়েছে, তা সহজে নিভবে বলে মনে হয় না। যদি না শেখ হাসিনা তাঁর অনড় অবস্থান থেকে সরে আসেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.