আজ তার উপস্থিতি বড় প্রয়োজন ছিল by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী
দেশের
কিংবদন্তি সাংবাদিক এবং আমাদের বড় ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর (এসএম আলী) ৮৫তম
জন্মদিন আজ। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় ভাইয়ের ভূমিকা অনন্য। ছোটরা তাকে
ভয় পায়, কারণ তিনি একাধারে ভাই ও অভিভাবক। কিন্তু আমাদের বড় ভাই তার ভদ্র,
নম্র ও মধুর ব্যবহার দিয়ে আমাদের হৃদয় জয় করেছিলেন। তাকে আমরা ভয় পেতাম
কম, শ্রদ্ধা করতাম বেশি। ছাত্রজীবন থেকেই তার সাংবাদিক হওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহ
ছিল ও বিভিন্ন কাগজে লিখতেন। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করার পর সাংবাদিক
জীবনে পুরোপুরি প্রবেশ করেন। পঞ্চাশের দশকে সাংবাদিকদের জীবন মসৃণ ছিল না।
ছিল না অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। আমাদের বাবা ও চাচা আসাম সিভিল সার্ভিসের
উচ্চপদস্থ আমলা। সে যুগে আমলাদের ছিল অপরিসীম ক্ষমতা। কিন্তু ক্ষমতার
আকর্ষণ ত্যাগ করে সাংবাদিকের অজানা ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করলেন তিনি।
প্রথমে ঢাকার বিভিন্ন কাগজে কাজ করে পরে করাচিতে পাড়ি দিলেন। প্রথমে
‘ইভিনিং স্টার’ ও পরে প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ডনে’ কাজ করে লন্ডন পাড়ি দিলেন
১৯৫৩ সালে। সেখানে পেশাগত শিক্ষা গ্রহণ করে, কিছুদিন বিবিসিতে কাজ করে
ঢাকায় ফিরলেন ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে। ঢাকায় ফিরে যোগ দিলেন ‘পাকিস্তান
অবজারভারে’। একাধারে বিভিন্ন বিদেশী কাগজেও লেখা শুরু করলেন।
সাংবাদিকতা পেশায় তিনি তার স্বকীয়তা প্রমাণ করলেন ও পুরো মহাদেশের সাংবাদিক জগতে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। ব্যাংককের তদানীন্তন সান্ধ্য পত্রিকা ‘ব্যাংকক পোস্ট’ তাকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দিল। তিনি অচিরেই ‘ব্যাংকক পোস্ট’কে একটি নিয়মিত দৈনিকে পরিণত করলেন। অচিরেই সেই পত্রিকা এ অঞ্চলের সর্বাধিক পঠিত কাগজ হিসেবে সমাদৃত হল। বড় ভাইকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একে একে সিঙ্গাপুরের ‘নিউ নেশন’, হংকংয়ের ‘হংকং স্ট্যান্ডার্ড’ ও তখন ম্যানিলায় অবস্থিত প্রেস ফাউন্ডেশন অব এশিয়ার কর্ণধার হিসেবে কাজ করলেন। এ ফাউন্ডেশনের প্রধান কাজ ছিল এই মহাদেশের তরুণ সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আধুনিক সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলা।
আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইউনেস্কোর আঞ্চলিক যোগাযোগ উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিতে কুয়ালালামপুরে গেলেন। সেখানে একাধারে কাজ করলেন এক যুগ। অবসর নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন ১৯৯০-এর শেষের দিকে। উদ্দেশ্য, ঢাকা থেকে একটা উচ্চমানের ইংরেজি পত্রিকা বের করা। ইচ্ছা করলে ইউনেস্কোর পেনশন নিয়ে তিনি এ অঞ্চলের যে কোনো শহরে অবসর জীবনযাপন করতে পারতেন। ব্যাংকক, হংকং, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুরে তখন সাংবাদিকতার জগতে কাজ করার সুযোগ ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, যার দৃঢ় সংকল্প ছিল মৃত্যুর আগে দেশের জন্য কিছু করার। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে তার সর্বশেষ সৃষ্টি ‘ডেইলি স্টার’ প্রকাশিত হল দেশের সাংবাদিকতার জগতে এক অনন্য ‘তারকা’ হিসেবে। অচিরেই তা পাঠক সমাজে সমাদৃত হল। তার নিজস্ব কলাম ‘মাই ওয়ার্ল্ড’ ও প্রতিদিনের সম্পাদকীয়ই এই পত্রিকাটির প্রধান আকর্ষণ ছিল। কিন্তু এত খাটাখাটি সইল না। ১৯৯৩ সালের ১৭ অক্টোবর বড় ভাই মৃত্যুবরণ করেন।
বড় ভাই ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক। তিনি তার পেশাগত নৈতিকতা পালন করতেন অত্যন্ত কঠোরভাবে। অনেক বিশ্বনেতা তাকে একান্তে যেসব ‘অফ দ্য রেকর্ড’ কথা বলতেন, তা তিনি কখনও প্রকাশ করতেন না। দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীরা তাকে অনেক কিছুই বলেছেন সম্পূর্ণ তার বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে। তার উপদেশ নিয়েছেন। আমরা ভীষণ পীড়াপীড়ি করলেও তিনি এসব ব্যাপারে মুখ খুলতেন না।
ঢাকায় যে বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকতেন, সেটা ছিল তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিবের নিজস্ব বাড়ি। তিনি নিচতলায় থাকতেন ও বড় ভাই থাকতেন দোতলায়। তদানীন্তন সরকারের কোনো ভুল পদক্ষেপের জন্য কড়া সমালোচনা করতেন বড় ভাই। তদানীন্তন মন্ত্রিসভার সদস্যদের বার্ষিক কর্মসম্পাদন রিপোর্ট লিখতেন তার কাগজে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে। একবার তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গ্রেড দিলেন ‘বি-মাইনাস’। মন্ত্রী সাহেব কিছুটা দুঃখিত হলেন। আমি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে কিছুটা বিব্রত হই। কিন্তু বড় ভাইয়ের এক কথা- ‘আমার একমাত্র দায়বদ্ধতা আমার পাঠকের কাছে, আর কারও কাছে নয়।’
একইভাবে তদানীন্তন বিরোধী দলের মহাসচিব তার কড়া সম্পাদকীয় পড়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। বড় ভাই তার কলামে লিখলেন ‘কাউকে খুশি করার জন্য তিনি সম্পাদকীয় লেখেন না।’ সোজা কথায়, তার লেখা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, বাস্তবধর্মী ও পেশাগত। সেখানে আপসের কোনো সুযোগ ছিল না।
আজ দেশ এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। গ্রেফতার, হরতাল ও অবরোধ এক অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। আজ সারা দেশে একজন সর্বগ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছে না, যার লেখা সবাই পড়বে, যার উপদেশ সবাই মানবে। এ ধরনের জাতীয় সংকটকালে বড় ভাই সব সময় বলতেন, ‘আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম নিয়ে এগিয়ে এলে দেশের যে কোনো সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই খুঁজে পাব।’
বড় ভাই, আজ আপনার খুব প্রয়োজন বোধ করছি। আপনার জন্মদিনে আপনার চির শান্তি কামনা করি।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব
সাংবাদিকতা পেশায় তিনি তার স্বকীয়তা প্রমাণ করলেন ও পুরো মহাদেশের সাংবাদিক জগতে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। ব্যাংককের তদানীন্তন সান্ধ্য পত্রিকা ‘ব্যাংকক পোস্ট’ তাকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দিল। তিনি অচিরেই ‘ব্যাংকক পোস্ট’কে একটি নিয়মিত দৈনিকে পরিণত করলেন। অচিরেই সেই পত্রিকা এ অঞ্চলের সর্বাধিক পঠিত কাগজ হিসেবে সমাদৃত হল। বড় ভাইকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একে একে সিঙ্গাপুরের ‘নিউ নেশন’, হংকংয়ের ‘হংকং স্ট্যান্ডার্ড’ ও তখন ম্যানিলায় অবস্থিত প্রেস ফাউন্ডেশন অব এশিয়ার কর্ণধার হিসেবে কাজ করলেন। এ ফাউন্ডেশনের প্রধান কাজ ছিল এই মহাদেশের তরুণ সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আধুনিক সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলা।
আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইউনেস্কোর আঞ্চলিক যোগাযোগ উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিতে কুয়ালালামপুরে গেলেন। সেখানে একাধারে কাজ করলেন এক যুগ। অবসর নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন ১৯৯০-এর শেষের দিকে। উদ্দেশ্য, ঢাকা থেকে একটা উচ্চমানের ইংরেজি পত্রিকা বের করা। ইচ্ছা করলে ইউনেস্কোর পেনশন নিয়ে তিনি এ অঞ্চলের যে কোনো শহরে অবসর জীবনযাপন করতে পারতেন। ব্যাংকক, হংকং, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুরে তখন সাংবাদিকতার জগতে কাজ করার সুযোগ ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, যার দৃঢ় সংকল্প ছিল মৃত্যুর আগে দেশের জন্য কিছু করার। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে তার সর্বশেষ সৃষ্টি ‘ডেইলি স্টার’ প্রকাশিত হল দেশের সাংবাদিকতার জগতে এক অনন্য ‘তারকা’ হিসেবে। অচিরেই তা পাঠক সমাজে সমাদৃত হল। তার নিজস্ব কলাম ‘মাই ওয়ার্ল্ড’ ও প্রতিদিনের সম্পাদকীয়ই এই পত্রিকাটির প্রধান আকর্ষণ ছিল। কিন্তু এত খাটাখাটি সইল না। ১৯৯৩ সালের ১৭ অক্টোবর বড় ভাই মৃত্যুবরণ করেন।
বড় ভাই ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক। তিনি তার পেশাগত নৈতিকতা পালন করতেন অত্যন্ত কঠোরভাবে। অনেক বিশ্বনেতা তাকে একান্তে যেসব ‘অফ দ্য রেকর্ড’ কথা বলতেন, তা তিনি কখনও প্রকাশ করতেন না। দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীরা তাকে অনেক কিছুই বলেছেন সম্পূর্ণ তার বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে। তার উপদেশ নিয়েছেন। আমরা ভীষণ পীড়াপীড়ি করলেও তিনি এসব ব্যাপারে মুখ খুলতেন না।
ঢাকায় যে বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকতেন, সেটা ছিল তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিবের নিজস্ব বাড়ি। তিনি নিচতলায় থাকতেন ও বড় ভাই থাকতেন দোতলায়। তদানীন্তন সরকারের কোনো ভুল পদক্ষেপের জন্য কড়া সমালোচনা করতেন বড় ভাই। তদানীন্তন মন্ত্রিসভার সদস্যদের বার্ষিক কর্মসম্পাদন রিপোর্ট লিখতেন তার কাগজে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে। একবার তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গ্রেড দিলেন ‘বি-মাইনাস’। মন্ত্রী সাহেব কিছুটা দুঃখিত হলেন। আমি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে কিছুটা বিব্রত হই। কিন্তু বড় ভাইয়ের এক কথা- ‘আমার একমাত্র দায়বদ্ধতা আমার পাঠকের কাছে, আর কারও কাছে নয়।’
একইভাবে তদানীন্তন বিরোধী দলের মহাসচিব তার কড়া সম্পাদকীয় পড়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। বড় ভাই তার কলামে লিখলেন ‘কাউকে খুশি করার জন্য তিনি সম্পাদকীয় লেখেন না।’ সোজা কথায়, তার লেখা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, বাস্তবধর্মী ও পেশাগত। সেখানে আপসের কোনো সুযোগ ছিল না।
আজ দেশ এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। গ্রেফতার, হরতাল ও অবরোধ এক অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। আজ সারা দেশে একজন সর্বগ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছে না, যার লেখা সবাই পড়বে, যার উপদেশ সবাই মানবে। এ ধরনের জাতীয় সংকটকালে বড় ভাই সব সময় বলতেন, ‘আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম নিয়ে এগিয়ে এলে দেশের যে কোনো সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই খুঁজে পাব।’
বড় ভাই, আজ আপনার খুব প্রয়োজন বোধ করছি। আপনার জন্মদিনে আপনার চির শান্তি কামনা করি।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব
No comments