দেশে কি মহাপ্রলয় আসন্ন? by অরবিন্দ রায়
লোকনাথ বা মোহাম্মদী পঞ্জিকায় মহাপ্রলয়ের
দিন-তারিখ উল্লেখ নেই। সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের আগাম দিনক্ষণের কথা যেমন
লেখা থাকে, মহাপ্রলয়ের দিনক্ষণ নিয়ে আগাম তথ্য এ যাবৎ কেউ দেয়নি। ভবিষ্যতে
দেবে কি-না আমার জানা নেই। শুনেছি মহাপ্রলয়ের দিন সূর্য পৃথিবীর খুব
কাছাকাছি চলে আসবে। আর এর হলকায় ছারখার হবে সব কিছু। তবে বর্তমানে দেশের যা
পরিস্থিতি তাতে ছারখার হওয়ার জন্য মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে না।
জ্যান্ত মানুষ ঝলসানোর জন্য সূর্যকেও আর কষ্ট করে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি চলে
আসার প্রয়োজন নেই। কেননা শরীর ঝলসানোর জন্য পেট্রল বোমাই যথেষ্ট, যার
আঘাতে ইতিমধ্যে অনেকের শরীর ঝলসে গেছে। তাদের কেউ কেউ চলে গেছেন না ফেরার
দেশে। অবশিষ্টরা ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
এ বুঝি শেখ ফজলুল করিমের স্বর্গ-নরক কবিতার চিত্রকল্প। কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর? মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর। কবিতায় বর্ণিত সেই স্বর্গ-নরকের মতো মহাপ্রলয়ও বোধকরি মানুষের ওপর আগাম নেমে আসার পাঁয়তারা করছে। আজকাল শিক্ষিত ও ভদ্র ঘরের অনেক ছেলেই মহাপ্রলয় ডেকে আনার কাজে সদা ব্যস্ত। পান থেকে চুন না খসতেই মানুষ মাপের রামদা ও ভোজালি নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা। এ যেন কারবালার ঘটনায় বর্ণিত এজিদ বাহিনীর মিনি সংস্করণ। জানি না এরা কোন এজিদের বংশধর, যারা প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলার জন্য খঞ্জর উঁচিয়ে নিত্য প্রহর ধাওয়া করছে।
দেশের শিরায় শিরায় এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা বহমান। তবে একে সংসদীয় গণতন্ত্র না বলে ‘সংঘাতীয় গণতন্ত্র’ বলা যেতে পারে। বাস্তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কেবল সংঘাতীয় গণতন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। মূলত দেশে এখন নামে গণতন্ত্র, কাজে রাজতন্ত্র, বাস্তবে নাইতন্ত্র চলছে। কেবল ক্ষমতা লাভের জন্যই উভয় দল পরস্পরের কাটা মুণ্ডের মালা গলায় ঝোলাতে চাইছেন। কাজেই এ তন্ত্রকে কোনোমতেই গণতন্ত্র বলা যায় না। রাজার উত্তরসূরিরাই রাজা হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি রীতি ও নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই এ পদ্ধতিকে রাজতন্ত্র বলা যেতেই পারে। আবার ক্ষমতা হাত বদলের এ সময়ে অনেককেই আদর্শবর্জিত হতে দেখা যায়। আদর্শ কেনা-বেচার হাটটিও বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। অগ্নিপরীক্ষার এ মৌসুমটায় যেহেতু কাউকেই কোনো তন্ত্রের ফ্রেমে বাঁধা যায় না, কাজেই একে নাইতন্ত্র বলতে দোষের কিছু নেই।
মজার বিষয় হচ্ছে, এসব অপকর্ম করার লাইসেন্স জনগণই তাদের হাতে তুলে দেয়। আর প্রতি পাঁচ বছর পর পর লাইসেন্স নবায়নের যখন সময় আসে, তখন ঝগড়া-বিবাদের প্রদর্শনী বসে। এ বায়স্কোপ না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় থাকে না যে বিবাদ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এসব বিবাদের ফলাফল যাই হোক, তার ভাগিদার যারা কখনোই হয় না তাদেরই এসব ফ্যাসাদে প্রাণ হারাতে দেখা যায়। বিষয়টি বর ও কনে পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার মতো। লাশও পড়ে কয়েক ডজন। কিন্তু তাতে বর-কনের ফুল শয্যায় এতটুকু ব্যাঘাত ঘটে না। ঠিক এ কথাটি অনেকেই সোজা-সাপ্টাভাবে বলেন- ‘মজা লোটে ফজা ভাই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই’। এই ফজা ভাইদের হাতে ক্ষমতার সুধা তুলে দেয়ার জন্যই আমজনতা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে, পথঘাটের আন্দোলনে জীবন হারানো কোনো পরিবারের সদস্যকে অদ্যাবধি মন্ত্রী-মিনিস্টার বানানো হয়নি। মন্ত্রী বানানো দূরে থাক; ঘুষ ছাড়া পিওনের চাকরিও কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। অথচ এরাই আজ বুকের রক্তে রঞ্জিত করছে পিচঢালা পথ। নিজে পঙ্গু হওয়ার পাশাপাশি সমাজকেও পঙ্গু করছে। পরিবারগুলো পাওনা হিসেবে পাচ্ছে গগনবিদারী কারবালার মাতম।
কী হবে? কী হতে যাচ্ছে- এ নিয়ে আতংকের শেষ নেই। একাত্তরে নয় মাস পর তবু একটা ফয়সালা হয়েছিল। চলমান অশান্তির ফয়সালা আদৌ কখনও হবে কি-না তা বিধাতা ছাড়া কেউই বলতে পারবেন না। মাঝ শিঁথির মতো দুই ভাগে ভাগ হয়ে পরস্পর পরস্পরকে নিশ্চিহ্নের খেলায় মেতে উঠেছে তারা। শক্তি ও তেজে কেউই কোনো অংশে কম নয়। কাজেই নিশ্চিহ্ন মিশনের সামগ্রিক পরিণতি কী, তা সাধারণ অন্ধেরও জানা থাকার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক অন্ধরা ক্ষমতা ছাড়া কিছুই দেখতে পান না। নরহত্যার এ খেলায় নিরীহের পাশাপাশি নেতা, কর্মী, সমর্থক, পিকেটার কেউই বাদ যাচ্ছে না। আজ যদু তো কাল মধু। লাশ পতনের রেট ক্রমশ বাড়ছে। বর্ধনশীল এ রেট ছাপাখানার ছপাছপ গতিতে গিয়ে ঠেকলেও মনে হয় না কারও হুঁশ হবে। কাজেই এ পরিস্থিতিকে মহাপ্রলয় বলা যেতেই পারে। এখন চলছে সেমি প্রলয়। সামগ্রিক পরিস্থিতির সহসা কোনো পরিবর্তন আনা না হলে মহাপ্রলয়ের তারিখটি মনে হয় ৫ জানুয়ারি ২০১৪।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
এ বুঝি শেখ ফজলুল করিমের স্বর্গ-নরক কবিতার চিত্রকল্প। কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর? মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর। কবিতায় বর্ণিত সেই স্বর্গ-নরকের মতো মহাপ্রলয়ও বোধকরি মানুষের ওপর আগাম নেমে আসার পাঁয়তারা করছে। আজকাল শিক্ষিত ও ভদ্র ঘরের অনেক ছেলেই মহাপ্রলয় ডেকে আনার কাজে সদা ব্যস্ত। পান থেকে চুন না খসতেই মানুষ মাপের রামদা ও ভোজালি নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা। এ যেন কারবালার ঘটনায় বর্ণিত এজিদ বাহিনীর মিনি সংস্করণ। জানি না এরা কোন এজিদের বংশধর, যারা প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলার জন্য খঞ্জর উঁচিয়ে নিত্য প্রহর ধাওয়া করছে।
দেশের শিরায় শিরায় এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা বহমান। তবে একে সংসদীয় গণতন্ত্র না বলে ‘সংঘাতীয় গণতন্ত্র’ বলা যেতে পারে। বাস্তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কেবল সংঘাতীয় গণতন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। মূলত দেশে এখন নামে গণতন্ত্র, কাজে রাজতন্ত্র, বাস্তবে নাইতন্ত্র চলছে। কেবল ক্ষমতা লাভের জন্যই উভয় দল পরস্পরের কাটা মুণ্ডের মালা গলায় ঝোলাতে চাইছেন। কাজেই এ তন্ত্রকে কোনোমতেই গণতন্ত্র বলা যায় না। রাজার উত্তরসূরিরাই রাজা হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি রীতি ও নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই এ পদ্ধতিকে রাজতন্ত্র বলা যেতেই পারে। আবার ক্ষমতা হাত বদলের এ সময়ে অনেককেই আদর্শবর্জিত হতে দেখা যায়। আদর্শ কেনা-বেচার হাটটিও বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। অগ্নিপরীক্ষার এ মৌসুমটায় যেহেতু কাউকেই কোনো তন্ত্রের ফ্রেমে বাঁধা যায় না, কাজেই একে নাইতন্ত্র বলতে দোষের কিছু নেই।
মজার বিষয় হচ্ছে, এসব অপকর্ম করার লাইসেন্স জনগণই তাদের হাতে তুলে দেয়। আর প্রতি পাঁচ বছর পর পর লাইসেন্স নবায়নের যখন সময় আসে, তখন ঝগড়া-বিবাদের প্রদর্শনী বসে। এ বায়স্কোপ না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় থাকে না যে বিবাদ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এসব বিবাদের ফলাফল যাই হোক, তার ভাগিদার যারা কখনোই হয় না তাদেরই এসব ফ্যাসাদে প্রাণ হারাতে দেখা যায়। বিষয়টি বর ও কনে পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার মতো। লাশও পড়ে কয়েক ডজন। কিন্তু তাতে বর-কনের ফুল শয্যায় এতটুকু ব্যাঘাত ঘটে না। ঠিক এ কথাটি অনেকেই সোজা-সাপ্টাভাবে বলেন- ‘মজা লোটে ফজা ভাই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই’। এই ফজা ভাইদের হাতে ক্ষমতার সুধা তুলে দেয়ার জন্যই আমজনতা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে, পথঘাটের আন্দোলনে জীবন হারানো কোনো পরিবারের সদস্যকে অদ্যাবধি মন্ত্রী-মিনিস্টার বানানো হয়নি। মন্ত্রী বানানো দূরে থাক; ঘুষ ছাড়া পিওনের চাকরিও কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। অথচ এরাই আজ বুকের রক্তে রঞ্জিত করছে পিচঢালা পথ। নিজে পঙ্গু হওয়ার পাশাপাশি সমাজকেও পঙ্গু করছে। পরিবারগুলো পাওনা হিসেবে পাচ্ছে গগনবিদারী কারবালার মাতম।
কী হবে? কী হতে যাচ্ছে- এ নিয়ে আতংকের শেষ নেই। একাত্তরে নয় মাস পর তবু একটা ফয়সালা হয়েছিল। চলমান অশান্তির ফয়সালা আদৌ কখনও হবে কি-না তা বিধাতা ছাড়া কেউই বলতে পারবেন না। মাঝ শিঁথির মতো দুই ভাগে ভাগ হয়ে পরস্পর পরস্পরকে নিশ্চিহ্নের খেলায় মেতে উঠেছে তারা। শক্তি ও তেজে কেউই কোনো অংশে কম নয়। কাজেই নিশ্চিহ্ন মিশনের সামগ্রিক পরিণতি কী, তা সাধারণ অন্ধেরও জানা থাকার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক অন্ধরা ক্ষমতা ছাড়া কিছুই দেখতে পান না। নরহত্যার এ খেলায় নিরীহের পাশাপাশি নেতা, কর্মী, সমর্থক, পিকেটার কেউই বাদ যাচ্ছে না। আজ যদু তো কাল মধু। লাশ পতনের রেট ক্রমশ বাড়ছে। বর্ধনশীল এ রেট ছাপাখানার ছপাছপ গতিতে গিয়ে ঠেকলেও মনে হয় না কারও হুঁশ হবে। কাজেই এ পরিস্থিতিকে মহাপ্রলয় বলা যেতেই পারে। এখন চলছে সেমি প্রলয়। সামগ্রিক পরিস্থিতির সহসা কোনো পরিবর্তন আনা না হলে মহাপ্রলয়ের তারিখটি মনে হয় ৫ জানুয়ারি ২০১৪।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
No comments