যেখানে শৈশব সেখানেই শেষশয্যা
শোকগাথার জলোচ্ছ্বাসে ভাসছে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথাগত রেওয়াজে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাতে, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে মহাপ্রয়াণের গীত। তালে তাল মিলিয়ে, পায়ে পা ঠুকে সমস্বরে বুক ভাসাচ্ছে সবাই। এমনই চলবে আগামী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ‘তোমার মতো, এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই।’ এমনিতে আনন্দের গান হলেও, সে সুরে উল্লাসের রেশটুকুও নেই- বেদনার মহাসাগরের পাশে সলিল সমাধি হয়েছে সে সোল্লাসে। গানের ফাঁকে ফাঁকে সবাই কাঁদছেন, ‘আমরা পিতৃহারা হলাম, মাতৃহারাও। তাকে ছাড়া আমাদের কী করে চলবে।’ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ৮টা ৫০ মিনিটে মারা গেছেন নেলসন রোলিহলালা ম্যান্ডেলা। শুক্রবার ভোর রাতে সেই খবর জানাজানি হতেই ৯৫ বছর বয়সী রাষ্ট্রনায়কের বাড়ির সামনে অসংখ্য মানুষের ঢল। সবার মুখে একটাই কথা ‘আমরা অনাথ হলাম।’ নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুসংবাদ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জ্যাবক জুমাও বলেন, ‘পিতৃহারা হল দ. আফ্রিকা। এ দেশের মানুষ তাদের পিতাকে হারাল।’ মহাকালের মহানায়ক সময়ের সেরা সন্তান সেই কালো মানুষটিকে সমাহিত করা হবে ১৫ ডিসেম্বর। পরম শ্রদ্ধাভরে জন্মস্থান কু কুনুগ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তার শেষ শয্যা হবে। সেখানেই পাতা হচ্ছে তার শেষ বিছানা। এখানেই কেটেছিল তার উচ্ছল শৈশব। মমতাময়ী মায়ের কোলে চড়ে এপাড়া ওপাড়া করে বেরিয়েছিলেন একসময়। বাবা-দাদার কাঁধে হয়তো পাহাড়ি আকাশে ম্লান হয়ে যাওয়া অস্তাচলে স্বপ্ন রেখেছিলেন। সমবয়সীদের সঙ্গে ছেলেবেলামো করেছেন। কৈশোরে কালপুরুষ হওয়ার স্বপ্নে মজেছিলেন- সেও এই কুনুতেই। এবার সেই কুনুতেই চির ঘুমের দেশের রাজপুত্র হবেন মর্তের স্বপ্নপুরুষ ‘টাটা’- দ. আফ্রিকার বাবা। শতাব্দীর সেরা সূর্য! ম্যান্ডেলার জীবদ্দশাতেই পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছিল, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় বছর কয়েক আগে, ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য-বিতর্কে। মৃত্যুর পরে নেলসনকে কোথায় সমাহিত করা হবে, তা নিয়েও ম্যান্ডেলা পরিবারে ঘোর সংঘাত চলছিল। এক দিকে ম্যান্ডেলার প্রথম পক্ষের নাতি মান্ডলা। অন্য দিকে দুই স্ত্রী উইনি ও গ্রাচা। ইতিমধ্যেই ম্যান্ডেলার কয়েক জন ছেলেমেয়ে মারা গিয়েছেন।
তাদের শায়িত করা হয়েছিল কুনু গ্রামে। কিন্তু মান্ডলা চাইছিলেন, মৃত্যুর পরে তার দাদাকে সমাহিত করা হবে জন্মস্থান মাভেজোতে। অন্য আত্মীয়দের না জানিয়ে, বাবা-ফুফুর কবর কুনু গ্রাম থেকে রাতারাতি মাভেজোতে নিয়ে আসেন মান্ডলা। যাতে মৃত্যুর পরে মাভেজাতে সমাহিত করলে ছেলেমেয়েদের পাশেই ঠাঁই হয় ম্যান্ডেলার। কবর-বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কোর্টের রায়ে অবশ্য ম্যান্ডেলার ছেলেমেয়ের কবর ফিরিয়ে আনা হয় কুনু গ্রামেই। ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পরে অবশ্য সহমত হয়েছেন পরিবারের সবাই। ১৫ ডিসেম্বর, রোববার, পাহাড়ি গ্রাম কুনুতেই তার শেষকৃত্য হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা। ভুগছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। বৃহস্পতিবার ভোররাতে খবর এল নেলসন ম্যান্ডেলা আর নেই। বছর কুড়ি আগে, ১৯৯৪ সালের ১০ মে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। বর্ণবিদ্বেষ জমানার শেষ শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, এফ ডব্লিউ দ্য ক্লার্ককে পাশে নিয়ে ৭৫ বছর বয়সী ম্যান্ডেলা সে দিন বলেছিলেন, ‘এত দিন পরে, অবশেষে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি আমরা। বর্ণবিদ্বেষের সন্ধ্যা আর এ দেশে কখনও আসবে না।’ কথা রেখেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক দক্ষতায় সামলেছিলেন দেশের ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে। বর্ণবিদ্বেষের বীজ যে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, দেশের সব থেকে বিত্তবান সম্প্রদায় যেখানে শ্বেতাঙ্গ, সামরিক বাহিনীও যেখানে শ্বেতাঙ্গদের হাতে, সেখানে প্রশাসনকে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে ‘কালো’ করে তুলেছিলেন নেলসন। রোবেন দ্বীপে ২৭ বছরের দীর্ঘ বন্দিজীবন, আর মুক্তির পরের রক্তহীন সংগ্রামের বিনিময়ে এ দেশে নতুন সূর্যের ভোর এনেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা তাই তাকে ডাকত ‘টাটা’ বলে। ম্যান্ডেলার মাতৃভাষা ‘জোসা’তে ‘টাটা’ মানে বাবা। মাত্র পাঁচ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু জাতির জনক থেকে গিয়েছেন জীবনভর।
No comments