সরল গরল- রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টই শেষ ভরসা by মিজানুর রহমান খান

রাষ্ট্রপতি যে মুহূর্তে মনে করবেন সংলাপ ও সমঝোতার পথ রুদ্ধ, সেই মুহূর্ত থেকে তিনি একটি অসাধারণ প্রতিকারের কথা ভাবতে পারেন।
এই বিশেষ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির যে আছে তার একটা আলোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা সমাজে এখনই সৃষ্টি হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টের কোনো ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ পদক্ষেপ যে স্বীকৃত সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষের বাইরের যেকোনো পদক্ষেপের চেয়ে উন্নত, সেটা আগে মানতে হবে। খালি দুই নেত্রীকে আলোচনা করতে বলবেন না। বরং এই আলোচনাটা মাথায় রাখুন। মনে রাখুন, বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতিকে বাংলাদেশের ‘আইনের’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোনো গ্রন্থনা এযাবৎ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদীয় রীতির তালিকাও হয়নি। তাই ইংল্যান্ড প্রবর্তিত সংসদীয় রীতি রেওয়াজকেই ‘আইন’ হিসেবে মানার অনুশীলন করতে হবে।

ভারতের রাষ্ট্রপতিকে তাদের সংবিধান অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়েছে। তাই তারা যা পারে, আমাদের রাষ্ট্রপতি বা সুপ্রিম কোর্ট তা পারেন না—এই ঘরানার তাত্ত্বিকদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন আছে। অতীত সাক্ষ্য দেবে, আমরা যত সহজে অসাংবিধানিক কর্তৃপক্ষকে হালাল মনে করি, তত সহজে সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ মানতে পারি না। নিয়োগকর্তার একটা সহজাত অধিকার থাকে অপসারণের। এ মুহূর্তে তারানকোর সফর সফল না হলে হতাশা আরও বাড়বে। নেলসন ম্যান্ডেলার নীতি-আদর্শ এই রাষ্ট্র মানে না। কিন্তু এই মহানায়ককে শ্রদ্ধা জানাতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে আর রাষ্ট্রপতি ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিভিন্ন মহলে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আদৌ আলোচনা হলো কি না তা বঙ্গভবন মুখপাত্র বলেননি।
প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণে রাজা বা রানির ক্ষমতা সংসদীয় গণতন্ত্রে স্বীকৃত। ১৮৩৪ সালে রাজা চতুর্থ উইলিয়াম লর্ড মেলবোর্নকে কার্যত বরখাস্ত করেছিলেন। যদিও প্রকাশ্যে তাঁকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। জনগণ অবশ্য প্রধানমন্ত্রী মেলবোর্নের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন। মেলবোর্ন তাই নতুন নির্বাচনে আরেক মেয়াদে দেশ শাসন করেন।
সংসদীয় রেওয়াজ সম্পর্কে ব্রিটিশ সংবিধান বিশেষজ্ঞ কিথ লিখেছেন, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন থাকা পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ রাষ্ট্রপতি করবেন না। বাংলাদেশে এটা অত্যন্ত সীমিত অর্থে নিতে হবে। কারণ, ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর পরাস্ত হওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। তবে কিথের এই কথাটি মনে রাখতে হবে ‘ব্রিটেনে ১৭৮১ এবং ১৮০৭ সালে সর্বশেষ মন্ত্রিসভা অপসারণের প্রকৃত কিংবা কার্যত অপসারণের ঘটনা ঘটেছিল। ১৮৩২ সালের রিফর্ম অ্যাক্ট পাসের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সরানোর ক্ষমতা জনগণকে দেওয়া হয়।
কিথ লক্ষণীয়ভাবে বলেছেন এবং যেটা বাংলাদেশের জন্য এখন প্রাসঙ্গিক সেটা কিথের ভাষাতেই বলি, ‘এটা বলা অসম্ভব যে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এ ধরনের (প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের) কর্তৃত্বের প্রয়োগ একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বলে গণ্য হবে (ব্রিটিশ কেবিনেট সিস্টেম, ১৯৫২, পৃ-২৭৯)।
এরপর প্রখ্যাত ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসু যা লিখেছেন তাকে আমরা সংবিধান থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থাসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ছুড়ে ফেলার ঘটনার আলোকে বিচার করব। বিচারপতি বসু লিখেছেন, ‘কেবল যথেষ্ট ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতেই একটি মন্ত্রিসভার অপসারণ যথার্থতা পেতে পারে। যেমন মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কোনো একটি দলের পক্ষে নেওয়ার মতো অসাংবিধানিক কাজ করা।’ ইংরেজি ভাষ্যটি এ রকম: ‘Only most exceptional circumstances would justify the dismissal of a ministry. Such as unconstitutional conduct like...fundamental modifications of the electroral system in the interest of one party...’ (Commentary on the Constitution of India, Durga Das Basu. 8th edition. LexisNexis. Volume-4, 2008, Page 4668).
ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিলোপ করা যে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে গেছে, তা কি আর বিতর্কিত বিষয়? আমরা মনে রাখব যে, বসুর মৃত্যুর পরে ওই বইটি ২০০৮ সালে সম্পাদনা করেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচুদ। এ বইয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সরানোর ঐতিহাসিক তথ্য আছে।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে বলা ছিল, গভর্নর তাঁর বিশেষ দায়িত্ব পালনে মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী চলতে বাধ্য নন। গভর্নর যদি মনে করেন সরকার জনস্বার্থের হানি ঘটাচ্ছে, তাহলে সংসদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও গভর্নর প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করতে পারতেন।
দুর্গাদাস বসুর ওই বইয়ের ৪৬৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, সিন্ধের মুখ্যমন্ত্রী আলা বক্স অপসারিত হয়েছিলেন। বেঙ্গলের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হককে ১৯৪৩ সালের ২৯ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। যদিও সংসদে সে সময় তাঁর প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ১৯৪৪ সালের ২৬ এপ্রিল পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শওকত হায়াত খান অসদাচরণের জন্য অপসারিত হন। বসু আরও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন থেকে গভর্নরের বিশেষ দায়িত্বের বিধান তুলে নেওয়ার পরও ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনকে অপসারণ করেছিলেন। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তিনি তাঁর দেশের পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সুরাহা দিতে পারেননি। বসু লিখেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই, নীতিনির্ধারণবিষয়ক কোনো প্রশ্নে এভাবে মুখ্যমন্ত্রীর অপসারণের ঘটনা বিরল।
আমরা মনে রাখব, বাংলাদেশের মতো ভারতের সংবিধানেও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী অপসারণের ক্ষমতা দেয়নি। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতি এলে? বসু এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ইংল্যান্ডে যদিও রাজার দ্বারা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার অপসারণের রীতি পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এটা স্মরণ রাখতে হবে, কেবল সেই ক্ষমতা প্রয়োগ না করার কারণে [রাষ্ট্রপতির] বিশেষ অধিকার কখনো হারিয়ে যায় না। রাজারা ইংল্যান্ডের বাইরে তাঁদের ব্রিটিশ ভূখণ্ডগুলোয় এই ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। কিংবা তাঁদের প্রাচীন উপনিবেশগুলো সংসদীয় পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। এবং তারা তাদের সাংবিধানিক প্রধান করেছে রাষ্ট্রপতিকে। তাই অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্গত বিধিব্যবস্থাকে অনুধাবন করা সমীচীন ও লাভজনক হবে।’ এ কথা আমাদের জন্য হুবহু প্রযোজ্য।
ব্রিটিশ ও ভারতের অভিজ্ঞতা স্মরণ রাখা এই মুহূর্তে আমাদের জন্য লাভজনক ও পথের দিশা পেতে সহায়ক। বসু লিখেছেন, ‘যে মন্ত্রিসভা এখন পর্যন্ত সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা নির্ভর রয়েছে, তাকে অপসারণ করা সাধারণভাবে অসাংবিধানিক বা অযথাযথ।’ আমরাও সাধারণভাবে এটাই মানি ও মানব। গোলাম মোহাম্মদ তৈরি করতে আমরা কেন চাইব? যারা এটা নিয়ে চিৎকার জুড়বেন তাদের বলব, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না।
৪৬৭২ পৃষ্ঠায় বসু যা লিখেছেন তাতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দুই মেয়াদের রায় ও ৯০ দিনের পরে নির্বাচন করা-সংক্রান্ত বিচারপতি আবদুর রশীদের রায় মনে করিয়ে দেয়। এবং সেটা যে কোনো প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজনে সরানোর সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়। বসু লিখেছেন, ‘But even under this situation according to some scholars, the Crown might be justified in dismissing a Prime Minister, commanding a majority in the Legislature, if he seeks to subvert the democratic basis of the Constitution.’(এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও কতিপয় সাংবিধানিক পণ্ডিতের মতে, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন কোনো প্রধানমন্ত্রীকেও অপসারণে রাজার ক্ষমতা গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। যদি সেই প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের গণতান্ত্রিক ভিত্তি সম্পর্কে জনগণের মনে যে প্রত্যয়, তা তিনি উৎখাত বা পরাহত করতে চান।)
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন যে গণতন্ত্রের ভিত্তি তা সন্দেহাতীত। আমরা মনে রাখব, যদিও দুই শতাব্দী ধরে ব্রিটেনে রাজার ওই ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটেনি কিন্তু বসু যে কতিপয় পণ্ডিতের কথা বলেছেন তাঁর মধ্যে আছেন দ্য স্মিথ ও হালসবারি। উভয়ে মস্ত বড় পণ্ডিত ও সংবিধানবিশারদ হিসেবে সমগ্র সংসদীয় দুনিয়ার উচ্চ আদালতগুলোয় সমাদৃত।
আমি বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা ও লাশ বানানোর আন্দোলনের তীব্র নিন্দা করি। এটা বিচারযোগ্য মনে করি। তারা ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বলে বিশ্বাস করি না। অথচ এটা হতেই হবে। এই বিচার এবং আরও অনেক মূল্যবোধের জন্য আওয়ামী লীগকে সমর্থন ও পছন্দ করি। কিন্তু সেটা দুই দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত না করার বিনিময়ে হতে পারে না। কারণ তা টিকবে না। আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের ওই কণ্টকিত পথ বাতলে দিলাম এ জন্য যে, সংবিধান অনুযায়ী সংকট উতরানোর এটাও একটা উপায়। একটা বিকল্প। যেকোনো মূল্যে সংবিধান টিকে থাক।
সুপ্রিম কোর্ট এই রূঢ় বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারেন না। সংবিধান রক্ষার শপথ মানে মামলাসূত্রে সংবিধান ব্যাখ্যা করা বোঝায় না। সামরিক ফরমানকে তাঁরা যখন বৈধতা দেন, তখন তাঁরা আসলে রাজনীতিই করেন। সুপ্রিম কোর্ট রাজনীতি থেকে পালাতে চান। আসলে পারেন না। করেনও না। করেন প্রধানত শাসকের শর্তে। মানুষের শর্তের বেলায় নানা ওজর। বিচারককে স্যালুট না ঠুকলে কী হয়? সবাই জানে। শত শত নিরীহ প্রাণ ঝরলে কী হয়? আদালতের অবমাননা হয় না।
এই লেখাটিতে তর্কের খাতিরে ধরে নিই সংলাপ-সমঝোতায় সুরাহা হবে না। ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ট্রেডমার্ক শার্ট পরতেন। বিশপ বলেছিলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার সবই ভালো। কেবল এই শার্ট ছাড়া।’ ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘আসুন, আমরা একমত হই যে, যা সুরাহাযোগ্য নয়, তা নিয়ে আলোচনা না করা।’ আমরাও বুঝি, সুরাহা-অযোগ্য বিষয় নিয়ে দুই দলের সংলাপে লাভ কী। কিন্তু সুরাহা একটা লাগবেই। কারা করবেন?
বিশ্বজুড়েই সুপ্রিম কোর্টের রাজনৈতিক ভূমিকা অনস্বীকার্য। অরাজনৈতিক সুপ্রিম কোর্টের একটি রাজনৈতিক ভূমিকা সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে অস্বীকৃত নয়। তাই হাতিয়ার হলো দুটি বেসামরিক ক্ষমতার সমন্বিত প্রয়োগ। সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ বাতলে সর্বাগ্রে একটি দূরদর্শী রাজনৈতিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সেটা মেনে রাষ্ট্রপতি দরকার হলে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে আহ্বান জানাবেন। নাগরিকদের যে কেউ প্রশ্নটিকে এখনই সুপ্রিম কোর্টের সামনে নিতে পারেন। এর আগে প্রধান বিচারপতির ব্যর্থতায় এক-এগারো এসেছিল। এবার সুপ্রিম কোর্ট সুয়োমটো পার্টি হয়েছেন। এখন তাঁকে পতাকা বইতে হবে। যথাপ্রক্রিয়া নিয়ে মাননীয় বিচারকেরাও নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সলাপরামর্শ শুরু করতে পারেন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.