এই ট্রাজিক রাজনৈতিক নাটকের পরবর্তী দৃশ্য কী হবে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বুড়িগঙ্গার
স্রোত থমকে আছে। কোন্দিকে প্রবাহিত হবে তা কেউ জানে না। স্রোত অবরুদ্ধ হয়ে
থাকলে তাতে ময়লা জমে, পানি দূষিত হয়। বাংলাদেশে রাজনীতির অবরুদ্ধ স্রোত
মুক্ত না হলে, গতি না পেলে তা দূষিত হবে। জনজীবন বিপন্ন হবে। এই অবরুদ্ধ
স্রোতকে গতি দেয়া, আবার চলমান করার জন্য অনেক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
হয়েছে, সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা তারানকো
সাহেব ঢাকায় এসেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, রাজনৈতিক,
কূটনৈতিক মহল সবার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন ও করছেন। কিন্তু জটিলতার
গিঁট খুলছে না। শেখ হাসিনার নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে
বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। বেশ কিছু প্রার্থী বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতও হয়ে গেছেন। এই অবস্থা থেকে ঘড়ির কাঁটা পেছানো
মুশকিল। অন্যদিকে বিরোধী জোট নির্বাচনের তফসিল পেছানো এবং সরকারপ্রধানের
পদ থেকে শেখ হাসিনাকে অপসারণ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতে অনড় হয়ে
আছেন।
বিশ্ববিপ্লবী নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা মারা গেছেন। সারা বিশ্বে শোক ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বাংলাদেশেরও বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ একবার সফর করে গেছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশে তিন দিনের জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতির প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য তিন দিনের এই শোক দিবসে হরতাল-অবরোধ যেন স্থগিত রাখা হয়। বিএনপি সেই অনুরোধও রক্ষা করেনি। অর্থাৎ তারা কোনো কারণেই নমনীয় হতে রাজি নন। এই অচলাবস্থার মধ্যে চলছে হরতাল ও অবরোধের নামে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, নিরীহ মানুষ হত্যা। এতদিন রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে, ট্রেনে আগুন দেয়া হয়েছে। এখন যাত্রীবাহী লঞ্চেও আগুন দেয়া হচ্ছে। মনে হয় জামায়াত তার একাত্তরের পূর্ব চরিত্রে ফিরে গেছে। তাদের যুদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জনগণের বিরুদ্ধে। একাত্তর সালে তাদের সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতির কভার ছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। এবার তাদের কভার বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি রাজনৈতিক আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে। তার ছাতার আড়ালে জামায়াত চালাচ্ছে দেশময় নৃশংস জ্বালাও-পোড়াও হত্যাকাণ্ড। বিএনপির আন্দোলনের লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তাদের পছন্দসই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান। জামায়াতের লক্ষ্য বিএনপির আন্দোলনের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা এবং দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য দেশময় একাত্তরের মতো বর্বরতার অনুষ্ঠান। এখানে এসে বিএনপির আন্দোলন ও জামায়াতের নাশকতা একসূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে। এই নাশকতার মৈত্রীর গিঁট ছাড়িয়ে বিএনপি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারছে না। এখানেই রাজনৈতিক জটিলতার গিঁট সহজে খুলতে চাইছে না। তারানকো সাহেবের মধ্যস্থতাও এখানে কাজ করবে কিনা তা বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন যেন নাটকের একটি ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। একই সঙ্গে বহু দৃশ্যের অভিনয় চলছে। এই ঘূর্ণায়মান মঞ্চে জনগণ একদিকে দেখছে আওয়ামী লীগ সরকার ও বিরোধী বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি। অন্যদিকে দেখছে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একটা বড় অংশের মধ্যে পরের আলুর গুদামে আগুন লাগায় পোড়া আলু খাওয়ার মহোৎসব। তার পাশে আবার নতুন দৃশ্য যোজিত হয়েছে, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির আকস্মিক নতুন অবস্থান গ্রহণের দরুন। এই দৃশ্য দেশময় দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতির ঢাকার বাড়ির সামনে কৌতূহলী জনতার ভিড় কমছে না।
এখন এই বয়োবৃদ্ধ জেনারেল এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি কি করবেন, তা কেউ জানেন না। তিনি নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদানের দু’দিন পরই এই সরকার ও নির্বাচন দুই-ই বর্জনের ঘোষণা দেন এবং মন্ত্রিসভায় তার দলের যেসব মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন, তাদের অধিকাংশের পদত্যাগপত্র নিজের কাছে জমা রাখেন। কিন্তু এই পদত্যাগপত্রগুলো তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেননি। তার নির্বাচন বর্জনও এখন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। জাতীয় পার্টি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি।
বর্তমানে কিছুদিনের জন্য হলেও দেশের রাজনৈতিক তাস খেলার তুরুপের তাসটি এরশাদ সাহেবের হাতে রয়েছে। তিনি যদি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় না থাকেন এবং নির্বাচন বর্জন করেন, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের শক্তি বাড়বে। কোনো কোনো দেশ যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চসংখ্যক দলের (সর্বদলের নয়) অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন, তা অনুষ্ঠান করাও বর্তমান সরকারের পক্ষে সহজ হবে না। সরকার কোনো রকমে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হলেও দেশে-বিদেশে তা কতটা ক্রেডিবিলিটি পাবে, তা এখন বলা মুশকিল। তবে এরশাদ সাহেব নির্বাচন বর্জন নীতিতে অটল থাকলে তার নির্দেশ মান্য না করে যদি তার দলের একাংশ সরকারের সঙ্গে থেকে যায় তাহলে অন্য কথা।
নির্বাচনকালীন সরকারে জাতীয় পার্টি থাকলে এবং নির্বাচনে অংশ নিলে অবশ্যই দেশে বিএনপিকে ছাড়াই একটি ক্রেডিবল নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। ১৯৭০ সালে ভাসানী ন্যাপের মতো তখনকার একটি বড় এবং প্রভাবশালী দল নির্বাচন বর্জন করা সত্ত্বেও যেমন একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছিল; নেপালে অন্যতম বৃহৎ দল মাওবাদী সংগঠন নির্বাচন বর্জন সত্ত্বেও যেমন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল; বাংলাদেশেও তেমন নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। নির্বাচনের জোয়ার শুরু হলে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোটার যে নির্বাচনে ভোট দিতে ছুটে আসবে তাতে সন্দেহ নেই।
বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না এলে দলের হার্ডলাইনের নেতারা হয়তো আশা করতে পারেন, জামায়াতের সঙ্গে মিলে দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তারা ভোটদাতাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে তাদের ভোটদানে বিরত রাখতে পারবেন। যদি তারা তা পারেন তাহলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত তা পারবে বলে মনে হয় না। প্রথমত, সন্ত্রাস দ্বারা জনসমর্থন আদায় করা যায় না। পাকিস্তানে উগ্র মৌলবাদীরা নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের সময় সন্ত্রাস দমনে সরকারের গণতান্ত্রিক শিথিলতা থাকবে না, সঙ্গে থাকবে সেনাবাহিনীর তৎপরতা। সুতরাং ভীতি ছড়িয়ে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন বানচাল করা যাবে না।
নির্বাচন যদি হয় তাহলে তার পরবর্তী দৃশ্যের কথা এখন ভেবে লাভ নেই। কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। নির্বাচন বানচাল বা বন্ধ রাখতে না পারলে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান শুধু দুর্বল হওয়া নয়, অনেকটাই ভেঙে পড়তে পারে। আর বিএনপির কভার ছাড়া জামায়াতের পক্ষে দেশে সন্ত্রাস চালানো অসম্ভব হবে। তখন নতুন সরকার হয়তো জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আরও শক্ত হাতে তাদের দমনের জন্য এগিয়ে যাবে। যদি তা হয়, তাহলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই (পাকিস্তানসহ) উগ্র মৌলবাদের চূড়ান্ত পরাজয় ও পতনের সূচনা হবে বাংলাদেশ থেকেই। ভারত যত বড় দেশ হোক, তার গণতন্ত্র যত পুরনো হোক, সেখানেও ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ছোট প্রতিবেশী হতে পারে কিন্তু দেশটিতে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম সুরক্ষা পেলে ভারতেও অনুকূল প্রভাব বিস্তার করবে।
বিএনপি কেন তুচ্ছ ছুঁতোনাতায় নির্বাচন বর্জন করতে চায় তা আমার হিসাবে আসে না। জামায়াত নামক সিন্দবাদের দৈত্যটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বিএনপি নির্বাচনে এলে এখনও তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি বলে অনেকে মনে করেন। আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়নে সর্বাধিক কাজ করা সত্ত্বেও কেউ কেউ মনে করেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সরকারের বিরুদ্ধে একটি ‘সাইকো’ তৈরি হয়েছে। তার সুযোগ নিয়ে বিএনপি পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের অধিকারী হয়েছে। এই একই সাইকোর সুযোগ নিয়ে হাসিনা সরকারের অধীনেই তাদের নির্বাচন জয়ের সম্ভাবনা ছিল বেশি। কেন, ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া-জান্তার এলএফও মেনে নিয়ে নির্বাচনে গিয়ে তখনকার আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হয়নি?
আমার একান্ত আশা এবং প্রার্থনা, তারানকো সাহেবের মধ্যস্থতা সফল হোক। বিএনপির সুমতি ফিরুক। তারা নির্বাচনে আসুন। দেশে রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ হোক। জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসুক। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি এখন পর্যন্ত বড় নাজুক। তার ভিত্তি নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণে শক্ত হোক। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মধ্যযুগীয় মৌলবাদী অভ্যুত্থান প্রতিহত হোক। বাঙালির হাজার বছরের লোকায়ত সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস রক্ষা পাক।
বাংলাদেশে দ্রুত রাজনৈতিক দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটবে তা আশা করা যায় না। বর্তমানে যা চলছে তা একটি ট্রাজিক নাটক। এর পরবর্তী দৃশ্য কি হবে তার জন্য নিষ্ক্রিয় দর্শক সেজে বসে না থেকে এবং সেমিনার ও টকশোতে আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যদি ‘নিরপেক্ষ বিদূষক’ না সেজে অতীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের মতো সন্ত্রাস প্রতিরোধে সক্রিয় হতেন, বর্তমানের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণে প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির ওপর চাপ সৃষ্টিতে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতেন, তাহলে আজকের সমস্যা এতটা জটিল সংকটে পরিণত হতে পারত না। দেশ সংকটমুক্ত হোক তা আমরা সবাই চাই। কিন্তু সে জন্য প্রত্যেকের সাধ্যমতো নিজ নিজ দায়িত্ব পালনেও আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। কেবল অন্যের সমালোচনা করে ও উপদেশ দিয়ে এবং বিদেশীদের ওপর নির্ভর করে সমস্যা দূর করা যাবে না।
বিশ্ববিপ্লবী নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা মারা গেছেন। সারা বিশ্বে শোক ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বাংলাদেশেরও বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ একবার সফর করে গেছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশে তিন দিনের জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতির প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য তিন দিনের এই শোক দিবসে হরতাল-অবরোধ যেন স্থগিত রাখা হয়। বিএনপি সেই অনুরোধও রক্ষা করেনি। অর্থাৎ তারা কোনো কারণেই নমনীয় হতে রাজি নন। এই অচলাবস্থার মধ্যে চলছে হরতাল ও অবরোধের নামে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, নিরীহ মানুষ হত্যা। এতদিন রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে, ট্রেনে আগুন দেয়া হয়েছে। এখন যাত্রীবাহী লঞ্চেও আগুন দেয়া হচ্ছে। মনে হয় জামায়াত তার একাত্তরের পূর্ব চরিত্রে ফিরে গেছে। তাদের যুদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জনগণের বিরুদ্ধে। একাত্তর সালে তাদের সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতির কভার ছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। এবার তাদের কভার বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি রাজনৈতিক আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে। তার ছাতার আড়ালে জামায়াত চালাচ্ছে দেশময় নৃশংস জ্বালাও-পোড়াও হত্যাকাণ্ড। বিএনপির আন্দোলনের লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তাদের পছন্দসই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান। জামায়াতের লক্ষ্য বিএনপির আন্দোলনের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা এবং দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য দেশময় একাত্তরের মতো বর্বরতার অনুষ্ঠান। এখানে এসে বিএনপির আন্দোলন ও জামায়াতের নাশকতা একসূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে। এই নাশকতার মৈত্রীর গিঁট ছাড়িয়ে বিএনপি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারছে না। এখানেই রাজনৈতিক জটিলতার গিঁট সহজে খুলতে চাইছে না। তারানকো সাহেবের মধ্যস্থতাও এখানে কাজ করবে কিনা তা বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন যেন নাটকের একটি ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। একই সঙ্গে বহু দৃশ্যের অভিনয় চলছে। এই ঘূর্ণায়মান মঞ্চে জনগণ একদিকে দেখছে আওয়ামী লীগ সরকার ও বিরোধী বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি। অন্যদিকে দেখছে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একটা বড় অংশের মধ্যে পরের আলুর গুদামে আগুন লাগায় পোড়া আলু খাওয়ার মহোৎসব। তার পাশে আবার নতুন দৃশ্য যোজিত হয়েছে, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির আকস্মিক নতুন অবস্থান গ্রহণের দরুন। এই দৃশ্য দেশময় দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতির ঢাকার বাড়ির সামনে কৌতূহলী জনতার ভিড় কমছে না।
এখন এই বয়োবৃদ্ধ জেনারেল এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি কি করবেন, তা কেউ জানেন না। তিনি নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদানের দু’দিন পরই এই সরকার ও নির্বাচন দুই-ই বর্জনের ঘোষণা দেন এবং মন্ত্রিসভায় তার দলের যেসব মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন, তাদের অধিকাংশের পদত্যাগপত্র নিজের কাছে জমা রাখেন। কিন্তু এই পদত্যাগপত্রগুলো তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেননি। তার নির্বাচন বর্জনও এখন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। জাতীয় পার্টি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি।
বর্তমানে কিছুদিনের জন্য হলেও দেশের রাজনৈতিক তাস খেলার তুরুপের তাসটি এরশাদ সাহেবের হাতে রয়েছে। তিনি যদি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় না থাকেন এবং নির্বাচন বর্জন করেন, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের শক্তি বাড়বে। কোনো কোনো দেশ যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চসংখ্যক দলের (সর্বদলের নয়) অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন, তা অনুষ্ঠান করাও বর্তমান সরকারের পক্ষে সহজ হবে না। সরকার কোনো রকমে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হলেও দেশে-বিদেশে তা কতটা ক্রেডিবিলিটি পাবে, তা এখন বলা মুশকিল। তবে এরশাদ সাহেব নির্বাচন বর্জন নীতিতে অটল থাকলে তার নির্দেশ মান্য না করে যদি তার দলের একাংশ সরকারের সঙ্গে থেকে যায় তাহলে অন্য কথা।
নির্বাচনকালীন সরকারে জাতীয় পার্টি থাকলে এবং নির্বাচনে অংশ নিলে অবশ্যই দেশে বিএনপিকে ছাড়াই একটি ক্রেডিবল নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। ১৯৭০ সালে ভাসানী ন্যাপের মতো তখনকার একটি বড় এবং প্রভাবশালী দল নির্বাচন বর্জন করা সত্ত্বেও যেমন একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছিল; নেপালে অন্যতম বৃহৎ দল মাওবাদী সংগঠন নির্বাচন বর্জন সত্ত্বেও যেমন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল; বাংলাদেশেও তেমন নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। নির্বাচনের জোয়ার শুরু হলে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোটার যে নির্বাচনে ভোট দিতে ছুটে আসবে তাতে সন্দেহ নেই।
বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না এলে দলের হার্ডলাইনের নেতারা হয়তো আশা করতে পারেন, জামায়াতের সঙ্গে মিলে দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তারা ভোটদাতাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে তাদের ভোটদানে বিরত রাখতে পারবেন। যদি তারা তা পারেন তাহলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত তা পারবে বলে মনে হয় না। প্রথমত, সন্ত্রাস দ্বারা জনসমর্থন আদায় করা যায় না। পাকিস্তানে উগ্র মৌলবাদীরা নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের সময় সন্ত্রাস দমনে সরকারের গণতান্ত্রিক শিথিলতা থাকবে না, সঙ্গে থাকবে সেনাবাহিনীর তৎপরতা। সুতরাং ভীতি ছড়িয়ে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন বানচাল করা যাবে না।
নির্বাচন যদি হয় তাহলে তার পরবর্তী দৃশ্যের কথা এখন ভেবে লাভ নেই। কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। নির্বাচন বানচাল বা বন্ধ রাখতে না পারলে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান শুধু দুর্বল হওয়া নয়, অনেকটাই ভেঙে পড়তে পারে। আর বিএনপির কভার ছাড়া জামায়াতের পক্ষে দেশে সন্ত্রাস চালানো অসম্ভব হবে। তখন নতুন সরকার হয়তো জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আরও শক্ত হাতে তাদের দমনের জন্য এগিয়ে যাবে। যদি তা হয়, তাহলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই (পাকিস্তানসহ) উগ্র মৌলবাদের চূড়ান্ত পরাজয় ও পতনের সূচনা হবে বাংলাদেশ থেকেই। ভারত যত বড় দেশ হোক, তার গণতন্ত্র যত পুরনো হোক, সেখানেও ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ছোট প্রতিবেশী হতে পারে কিন্তু দেশটিতে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম সুরক্ষা পেলে ভারতেও অনুকূল প্রভাব বিস্তার করবে।
বিএনপি কেন তুচ্ছ ছুঁতোনাতায় নির্বাচন বর্জন করতে চায় তা আমার হিসাবে আসে না। জামায়াত নামক সিন্দবাদের দৈত্যটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বিএনপি নির্বাচনে এলে এখনও তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি বলে অনেকে মনে করেন। আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়নে সর্বাধিক কাজ করা সত্ত্বেও কেউ কেউ মনে করেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সরকারের বিরুদ্ধে একটি ‘সাইকো’ তৈরি হয়েছে। তার সুযোগ নিয়ে বিএনপি পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের অধিকারী হয়েছে। এই একই সাইকোর সুযোগ নিয়ে হাসিনা সরকারের অধীনেই তাদের নির্বাচন জয়ের সম্ভাবনা ছিল বেশি। কেন, ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া-জান্তার এলএফও মেনে নিয়ে নির্বাচনে গিয়ে তখনকার আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হয়নি?
আমার একান্ত আশা এবং প্রার্থনা, তারানকো সাহেবের মধ্যস্থতা সফল হোক। বিএনপির সুমতি ফিরুক। তারা নির্বাচনে আসুন। দেশে রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ হোক। জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসুক। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি এখন পর্যন্ত বড় নাজুক। তার ভিত্তি নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণে শক্ত হোক। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মধ্যযুগীয় মৌলবাদী অভ্যুত্থান প্রতিহত হোক। বাঙালির হাজার বছরের লোকায়ত সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস রক্ষা পাক।
বাংলাদেশে দ্রুত রাজনৈতিক দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটবে তা আশা করা যায় না। বর্তমানে যা চলছে তা একটি ট্রাজিক নাটক। এর পরবর্তী দৃশ্য কি হবে তার জন্য নিষ্ক্রিয় দর্শক সেজে বসে না থেকে এবং সেমিনার ও টকশোতে আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যদি ‘নিরপেক্ষ বিদূষক’ না সেজে অতীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের মতো সন্ত্রাস প্রতিরোধে সক্রিয় হতেন, বর্তমানের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণে প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির ওপর চাপ সৃষ্টিতে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতেন, তাহলে আজকের সমস্যা এতটা জটিল সংকটে পরিণত হতে পারত না। দেশ সংকটমুক্ত হোক তা আমরা সবাই চাই। কিন্তু সে জন্য প্রত্যেকের সাধ্যমতো নিজ নিজ দায়িত্ব পালনেও আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। কেবল অন্যের সমালোচনা করে ও উপদেশ দিয়ে এবং বিদেশীদের ওপর নির্ভর করে সমস্যা দূর করা যাবে না।
No comments