শিশু মতামত জরিপ ২০১৩- বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে শিশুদের প্রত্যাশা

তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি যৌথ প্রকল্পের আওতায় ইউনিসেফের পরিচালনায় ও সেভ দ্য চিলড্রেন, অ্যাকশন এইড,
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, ওয়ার্ল্ড ভিশন ও জাতীয় শিশু টাস্ক ফোর্স (এনসিটিএফ) এবং চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যাসেম্বলির (সিআরজিএ) সহযোগিতায় ‘শিশু মতামত জরিপ ২০১৩: বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে শিশুদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক জরিপ পরিচালিত হয়।

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তারাই একদিন এই দেশ পরিচালনা করবে। কিন্তু শিশুরা দেশ সম্পর্কে কী ভাবছে, এটা কখনো জানার চেষ্টা করা হয় না। সমাজের একজন সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিশুদের জীবনের ওপর পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে শিশুদের ভাবনা কী? শিশুরা কী চায় তাদের কাছ থেকে? এসব জানা খুব জরুরি। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শিশুরা স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করবে। ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শিশুদের স্বাধীনভাবে সংগঠন বা সমিতি গড়ে তোলার অধিকার রয়েছে। ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শিশুদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকার রয়েছে। ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে শিশুর তথ্য পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এসব অনুচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের উদ্যোগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিলসেন শিশুদের ওপর একটি জরিপ চালায়। ‘শিশু মতামত জরিপ ২০১৩: বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে শিশুদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক জরিপে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদির অধিকার, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য, শিশুদের গণমাধ্যম ব্যবহার, রাজনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। বিশেষ করে সাংসদ, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছে শিশুদের প্রত্যাশা এবং ভবিষ্যতে শিশুরা নেতা হলে কী ভূমিকা পালন করবে ইত্যাদি বিষয় জরিপের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়।

উদ্দেশ্য

এই জরিপের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের আর্থসামাজিক অধিকার, তাদের মতামত ও চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সরবরাহ করা যাতে, এর ভিত্তিতে তারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের অধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে। রাজনৈতিক দলগুলো যাতে বাংলাদেশের শিশুদের আর্থসামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের সহায়তা করা এ জরিপের উদ্দেশ্য।

পদ্ধতি

মাঠপর্যায়ে ও অনলাইনে—দুভাবে এ জরিপ চালানো হয়। মাঠপর্যায়ে জরিপ চালানো হয় গত ১৯ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত। মাঠপর্যায়ে চার হাজার ২০০ শিশুর ওপর জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে শহরের শিশু এক হাজার ৪০০ এবং গ্রামের শিশু দুই হাজার ৮০০। অনলাইনে চালানো জরিপে ৩৩৩ জন শিশু অংশ নেয়। ছেলের সংখ্যা ছিল ১৭৬ ও মেয়ের সংখ্যা ছিল ১৫৭। অনলাইনে জরিপ চালানোর জন্য ইউনিসেফ একটি ওয়েবসাইট খোলে। ১৮ আগস্ট থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এটি সক্রিয় ছিল। মাঠপর্যায় ও অনলাইন—দুই ধরনের জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের গড় বয়স ছিল ১৪ বছর।

গুণগত ও সংখ্যাগত উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে এ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যেসব শিশু পড়তে ও লিখতে পারে, তাদের কাছ থেকে সংখ্যাগত পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সংখ্যাগত পদ্ধতির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী শিশুরা নিজেরাই প্রশ্নপত্র পূরণ করেছে। যেসব শিশু লিখতে ও পড়তে পারে না, তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের সময় গুণগত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) ও ইন ডেপথ ইন্টারভিউ (আইডিআই) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রতিটি এফজিডির মাধ্যমে ছয় থেকে আটজন শিশুর কাছ থেকে দলগত আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আইডিআইয়ের মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর সঙ্গে গবেষণার বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখিত গুণগত তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে আর্থসামাজিক অধিকার, সুশাসন ও শিশুদের অংশগ্রহণ রয়েছে—এমন সব বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য ও মতামত জানার চেষ্টা করা হয়েছে।

জরিপে অংশ নিয়েছে যেসব শিশু

ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে এ জরিপ চালানো হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তির শিশু, পথশিশু, চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, নদীবিধৌত চর এলাকা, উপকূলীয় চর এলাকা, হাওরাঞ্চল, চা-বাগান ও সুন্দরবন অঞ্চলের শিশুরা জরিপে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে সরকারি বাংলা মাধ্যমের স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রী, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের ছাত্রছাত্রী, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী ও ফেসবুক ব্যবহারকারী শিশুও ছিল।

মাঠপর্যায়ে যেসব শিশুর ওপর জরিপ চালানো হয়, তাদের সবাই কখনো না কখনো স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু জরিপ চলাকালীন ৯৬ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা বর্তমানে স্কুলে যায়। বাকি ৪ শতাংশ কোনো কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। সংখ্যাগত জরিপে অংশগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করছে, ২৬ শতাংশ প্রাথমিক স্তরে এবং ৪ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করছে। প্রতিটি শিশুর পরিবারের সদস্যসংখ্যা পাঁচ থেকে ছয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৩ শতাংশ শিশু শিক্ষার্থী, ৩ শতাংশ পড়াশোনার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করে, ২ শতাংশ শিশু পড়াশোনাও করে না, কাজও করে না এবং শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ শিশু গৃহবধূূ।

অনলাইন জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের সবাই কখনো না কখনো স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে ৯২ শতাংশ শিশু জরিপ চলার সময়ে স্কুলে ভর্তি ছিল। এর মধ্যে ৬৯ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরে পড়ালেখা করছে, ১৭ শতাংশ প্রাথমিক স্তরে ও ১৫ শতাংশ উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়ালেখা করছে। বেশির ভাগ (৯০ শতাংশ) শিশু হচ্ছে শিক্ষার্থী। ৭ শতাংশ কাজ করে। ৩ শতাংশ পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে, শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ শিশু গৃহবধূ, শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত।

No comments

Powered by Blogger.