প্রত্যাশা বন্দি হয়ে আছে মাননীয়দের মগজে by মোকাম্মেল হোসেন

জ্ঞান ফিরতেই লোকটার মুখ দেখতে পেল সাবিকুন। পাশের বিছানায় চিত হয়ে পড়ে আছে। সারা শরীর সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। দেখে মনে হচ্ছে, কাফনে আবৃত একটি লাশ। বাসের মহিলা আসনে সাবিকুন ছাড়া আর কেউ ছিল না। লোকটা পাঁচ-ছয় বছরের একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাসে ওঠার পর সাবিকুনের পাশেই বসেছিল। বাস শাহবাগ পৌঁছার পর ছেলেটি হঠাৎ হাত নেড়ে বলে ওঠে-
: আব্বু- পতাকা।
-কই!
এক ফেরিওয়ালা ফুটপাতে লাল-সবুজের পতাকা ফেরি করছিল। ছোট্ট ছেলেটি সেদিকে লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে-
: ওই যে...
কৌতূহলী এক জোড়া নবীন চোখের সঙ্গে এক জোড়া বয়স্ক চোখ লাল-সবুজে নিমগ্ন হয়। ছেলেটি বায়না ধরে-
: আব্বু, আমারে একটা পতাকা কিইন্যা দিবা! অসীম মমতা নিয়ে লোকটিকে ছেলের মুখের দিকে তাকাতে দেখে সাবিকুন। ছেলের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে লোকটা ফেরিওয়ালাকে ডাক দেয়। বাসের চাকা নড়তে শুরু করার ঠিক আগ মুহূর্তে সাবিকুনের মনে হল, জানালা দিয়ে একটা কালো বাদুড় উড়ে এসে বাসের মধ্যে আছড়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা বাসটাকে গ্রাস করে ফেলে। সাবিকুন বাসের দরজা লক্ষ্য করে লাফ দেয়। পোড়া শরীর নিয়ে বাস থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ার পরপরই জ্ঞান হারায় সে। সে যে একটা হাসপাতালে আছে, এটা সাবিকুন বুঝতে পারে। হাসপাতালের পরিচয় উদ্ধারের জন্য চারপাশে নজর বুলায় সাবিকুন। সাবিকুনকে নড়াচড়া করতে দেখে একজন নার্স এগিয়ে আসে। নার্সের কাছে সাবিকুন জানতে চায়-
: এইটা কোন হাসপাতাল?
নার্স যান্ত্রিক গলায় উত্তর দেয়-
: এটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আপনি এ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আছেন।
মোবাইল ফোনটা হাতব্যাগের মধ্যে রেখেছিল সাবিকুন। লাফ দেয়ার সময় কোলের ওপর রাখা হাতব্যাগটা সে হাতে নিয়েছিল কিনা মনে করতে পারল না। বাসায় খবর দেয়া দরকার। নার্সকে কথাটা জানাতেই সে বলল-
: ফোন নম্বর বলতে পারবেন?
-পারব।
: বলেন।
নার্স এপ্রোনের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে সাবিকুনের দেয়া নম্বরে কল করে। ওপাশ থেকে হ্যালো শোনা যেতেই সাবিকুনের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয় নার্স। সাবিকুন কানে ফোন ঠেকিয়ে শাশুড়ির গলা শুনতে পায়।
শাশুড়ির কণ্ঠ শুনে সাবিকুনের দুই চোখে প্লাবনের ধারা নামে। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-
: মা, মাগো- আমি বাঁইচ্যা আছি...
কথা বলতে গিয়ে সাবিকুন দেখল, সে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। গলা দিয়ে শুধু ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ বের হচ্ছে। বুকের গভীর থেকে উৎসারিত অন্তহীন হাহাকার ও কান্নার স্রোত পাথরচাপা দিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ সংবাদটা শাশুড়িকে জানায় সে। ঘড় ঘড় আওয়াজ শুনে সকচিত হয় সাবিকুন। লোকটা হাঁ করে দম নেয়ার চেষ্টা করছে। কোরবানি দেয়া পশুর কণ্ঠনালী থেকে বের হওয়া আওয়াজের সঙ্গে এ আওয়াজের অনেকটা মিল রয়েছে। সাবিকুন নিজেকে প্রশ্ন করে, মানুষ পশু কোরবানি করে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য। এ মানুষটা কার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি হয়েছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেশের চলমান রাজনীতির কথা মনে হয় তার। সাবিকুন ভাবে, এ কেমন রাজনীতি- যা নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার বদলে জীবনসংহারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়! বিপজ্জনক এ রাজনীতি তার মতো অসংখ্য মানুষের জীবন এমন একবৃত্তে বন্দি করে ফেলেছে-তারা ঘরে বসে থাকলেও বিপদ, বাইরে বের হলেও বিপদ। সাবিকুন কাজে না গেলে রাজনীতি তার খাবারের সংস্থান করবে না। তাকে না খেয়ে মরতে হবে। আবার খাবারের সংস্থানের জন্য কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হলে জীবিত অবস্থায় ঘরে ফিরতে পারবে কিনা, তা তার জানা নেই। অবস্থাটার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে সাবিকুনের ছোটবেলার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। সাবিকুন বান্ধবীদের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছিল। হঠাৎ শোনে- পাশের বাড়ির হাতেম বেপারি খুব হৈচৈ করছে। সাবিকুন ও তার বন্ধুরা সেখানে গিয়ে দেখে, বেপারির বউ রান্নাঘরে বসে চাল বাছছে। বেপারি চিৎকার-চেঁচামেচি করে চাল বাছতে বউকে নিষেধ করছে। বেপারির কথায় তার বউ কর্ণপাত না করায় বেপারি লাফ দিয়ে তার সামনে গিয়ে বলল-
: তরে নিষেধ দিছি, হেরপরও তুই চাইল বাছতেছস কী জন্য?
বেপারির বউ নির্বিকার ভঙ্গিতে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। বউয়ের নির্লিপ্ততা দেখে বেপারি আরও রেগে যায়। বলে-
: এই চাইল বাইছ্যা তুই ভাত রানবি- আর অই ভাত আমি খামু! তর ভাতের খ্যাতা পুড়ি। তুই আমার পাকঘর থেইক্যা অহনই বাইর হ।
বেপারির বউ এ কথা অগ্রাহ্য করে চুলার কাছে যেতেই বেপারি দাঁত কিড়মিড় করে বলে-
: আমার বাপ একটা- জবানও একটা। তুই অহন ভাত রানলেও মাইর খাবি- না রানলেও মাইর খাবি...
সাবিকুনের মনে হয়- দেশের রাজনীতি এখন হাতেম বেপারির সেই কথারই প্রতিধ্বনি করছে। সে সহিংস মূর্তি ধারণ করে দেশবাসীকে বলছে- তোরা ঘরে বইসা থাকলেও মরবি, বাইর হইলেও মরবি...
সাবিকুন সামনে চোখ রাখতেই দেখে, কেউ একজন উড়তে উড়তে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই শাশুড়িকে চিনতে পারল সাবিকুন। রওশন আরা ছেলের বউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। তাকে কাঁদতে দেখে একজন টিভি সাংবাদিক এগিয়ে আসে। ক্যামেরাম্যনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রওশন আরার সামনে দাঁড়িয়ে সে বলতে শুরু করে-
: দর্শক, আপনারা জানেন, আজ শাহবাগ এলাকায় যাত্রীবাহী একটি বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অন্তত ১৭ জন যাত্রী দগ্ধ হয়, যাদের চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। আমরা এখন সেই ঘটনার শিকার হয়েছেন এমন একজনের আÍীয়ের সঙ্গে কথা বলছি।
টিভি সাংবাদিক রওশন আরার মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে বলেন,
: কাইন্ডলি আপনার নামটা বলবেন?
-রওশন আরা।
: পেশেন্ট আপনার কী হয়?
-আমার ছেলের বউ।
: সহিংস রাজনীতির নৃশংসতার শিকার হয়ে আপনার ছেলের বউ এখন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
টিভি সাংবাদিকের কথা শুনে রওশন আরা আঁচলে চোখ মুছে বললেন-
: বাবা রে! আমার প্রতিক্রিয়া জাইন্যা কী করবেন? বউমার এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী- আপনি তাদের কাছে যান।
-রাজনীতিকরা তো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দেবেন। আমরা আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাচ্ছি।
: আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। প্রতিক্রিয়া জানাইয়া লাভ কী? প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া জানাইতেছে। কোনো কাজ কি হইতেছে? এইটা আমাদের নিয়তি হইয়া গেছে- এই দেশে যারা রাজনীতি করবেন, তাদের সন্তানরা ইউরোপ-আমেরিকায় সুন্দর জীবন কাটাবে। আর রাস্তাঘাটে অসহায়ভাবে মৃত্যুর শিকার হবে আমার মতো সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনরা। এটাই আমাদের রাজনীতির আসল চেহারা। এই রাজনীতি আমরা চাই না। আমরা এই রাজনীতিরে ঘেন্না করি...
পাশের বিছানা থেকে এবার গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে। ডাক্তার ও নার্সরা ব্যস্ত পায়ে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ছেলেটা কোথায়? সাবিকুন ডানে-বাঁয়ে দৃষ্টি মেলে বার্ন ইউনিটের সারি সারি বেডে ছোট্ট কোনো শরীর পড়ে আছে কিনা- তার সন্ধান করে। কোথাও দেখতে না পেয়ে তার মনের কোণে আশংকার মেঘ ঘনীভূত হয়- তবে কি ছেলেটি অগ্নিদগ্ধ হয়ে বাসের মধ্যেই মারা গেল! এখন সে পড়ে আছে লাশকাটা ঘরে, নাম-পরিচয়হীন লাশ হয়ে? সাবিকুন ব্যাকুল হয়ে উত্তর খুঁজতে থাকে- আগুনে দগ্ধ হওয়ার সময়ও কি ছেলেটির হাতে বাবার কিনে দেয়া লাল-সবুজ পতাকাটা ছিল? কে আগে পুড়েছে? পতাকা, না সে?
সাবিকুন তলপেটে হাত রাখে। তার গর্ভে একটা ভ্রুণ আস্তে আস্তে মানবশিশুর আকার ধারণ করছে। অনাগত শিশুটিকে ঘিরে সাবিকুনের অনেক স্বপ্ন। অনেক আশা। অনেক প্রত্যাশা। সাবিকুন জানে না, তার স্বপ্ন, আশা ও প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে কিনা! কারণ-এগুলো বন্দি হয়ে আছে রাজনীতির কুশীলব মাননীয়দের মগজে।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.