নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যখন নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার হুমকি দিয়ে চলেছে, তখন নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সোমবার সন্ধ্যায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন। ফলে আগামী ৫ জানুয়ারি ঘোষিত নির্বাচনটি একতরফাভাবেই সম্পন্ন করার প্রয়াস স্পষ্টতর হলো। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় এটি বাড়তি উদ্বেগ যোগ করেছে। কেননা তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (প্রনিক) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ‘আনন্দঘন পরিবেশে’। যেকোনো জাতীয় নির্বাচন ঘিরে গোটা জাতির আশাবাদ এমনটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এখন বাস্তবতা উল্টো। বিএনপিসহ ১৮-দলীয় জোট এই ‘একতরফা’ নির্বাচন প্রতিহত করতে পূর্ণ মাত্রায় তৎপর হলে কী বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা ভেবে আমরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন। কিন্তু সত্যিই আনন্দঘন পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হতো, যদি প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নিত। যদিও নির্বাচন কমিশনের এমন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই যে সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করানোর পরেই কেবল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হয়, তবু অবস্থাদৃষ্টে আমাদের বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে পারত। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের প্রথম বিবেচনা হওয়া উচিত একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
যে নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিযোগী দলের একটি অনুপস্থিত থাকে, সেটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্বের ইতিহাসে তো নয়ই, বাংলাদেশের ইতিহাসেও এমন নজির নেই। আওয়ামী লীগের বর্জনের মুখে বিএনপি সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য একতরফা নির্বাচনের একটি বড় দৃষ্টান্ত। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনে রাখা উচিত, তাদের যেকোনো পদক্ষেপের সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতার (লিগ্যালিটি) চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের জনগণের কাছে এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা (লেজিটিমেসি)। স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের এমন আচরণ করা উচিত নয়, যার ফলে মনে হতে পারে যে প্রতিষ্ঠানটি কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে তাদের হাতে এখনো সপ্তাহ দুই সময় আছে। সময় আছে সরকারের হাতেও, এবং আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে এই সময়ের মধ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে পারে। সরকারকে প্রথমে এই আন্তরিকতা দৃশ্যমান করে তুলতে হবে যে তারা সব দলের অংশগ্রহণে একটি সবর্জনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়; আওয়ামী লীগ সত্যিই চায় যে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। এই চাওয়া প্রকৃত চাওয়া হলে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অনিষ্পন্ন বিরোধের একটা মীমাংসা খুঁজে পাওয়া এখনো সম্ভব। শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, সরকারেরও বোঝা উচিত যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন দেশে-বিদেশে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া সম্ভব নয়।

No comments

Powered by Blogger.