শুধু বেতন বাড়ালেই চলবে না by ধীরাজ কুমার নাথ
অবশেষে
অর্থমন্ত্রী তার প্রতিশ্র“তি রাখলেন। তিনি ২০১৩-২০১৪ সালে বাজেট বক্তৃতার
১৮৯ অনুচ্ছেদে একটি স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, আমরা উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারি কর্মচারীদের
বেতন-ভাতা ২০০৯ সাল থেকে বৃদ্ধি করে আসছি। কিন্তু এভাবে ঘন ঘন কমিশন না করে
একটি স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে
বেতন-ভাতাদি সমন্বয় করা যাবে এবং তা বেতন বৈষম্য দূরীকরণে সহায়ক হবে। এরই
পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ নভেম্বর বাজেট ঘোষণার ৫ মাস পর তিনি মাত্র ৬ মাসের জন্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ
ফরাসউদ্দীনকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের একটি বেতন ও চাকরি কমিশন গঠন
করলেন। এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, যা নিতান্তই সঙ্গত ও স্বাভাবিক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যার মেয়াদ মাত্র দুই মাস, তাদের এ ধরনের
নীতিনির্ধারণীমূলক কমিশন গঠনের ক্ষমতা আছে কি? মাত্র এক মাস আগে সরকারি
কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা বাড়ানো হয়েছে ২০ শতাংশ হারে, যার জন্য খরচ হবে
প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ১৩ লাখ সরকারি কর্মচারীর
জন্য বছরে রাজস্ব খাতে ব্যয় হয় প্রায় ২৭,৫০০ কোটি টাকা। কী কারণে সরকারি
কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের খুশি করতে সরকার উঠে পড়ে লাগল, এ ব্যাপারে সুশীল
সমাজের অনেকের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে কি সরকারি কর্মচারীরা
নির্বাচনের প্রাক্কালে রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার বা পোলিং
অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন বলে এ সুযোগ? তারা এ সময়ে স্বপক্ষে থাকলে
সুবিধা হবে- এ ধরনের ভাবনা মাথায় রেখে অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছে
সরকার? যদি তাই হতো তবে সরকারি কর্মচারীরা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধাচরণ করতেন না কোনোদিন, কারণ তিনিই ১৯৮৫ সালে তাদের
বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করেছিলেন এবং এনাম কমিটি গঠন করে সরকারের প্রশাসনিক
কাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক অসামান্য অবদান রেখেছিলেন।
বর্তমান কমিশন হচ্ছে অষ্টম বেতন কমিশন। এর আগে বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭৩, ১৯৭৬, ১৯৮৪, ১৯৯০, ১৯৯৭, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে। প্রতিটি কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছে এবং মহার্ঘ ভাতা মূল বেতনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তবে এবারের কমিশনকে বলা হচ্ছে বেতন ও চাকরি কমিশন, যার অর্থ হচ্ছে- এ কমিশন বেতন-ভাতা ছাড়াও চাকরির বিষয়টি দেখবে, যা হবে অনেক বেশি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। সপ্তম বেতন কমিশন তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রদানে ১৪ মাস সময় নিয়েছিল। তাই বর্তমান কমিশন কিভাবে ৬ মাসের মধ্যে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করবে? অবশ্যই সময় বাড়াতে হবে।
এছাড়া এরূপ মৌলিক সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে জনপ্রিয় ও সদিচ্ছাসম্পন্ন সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার প্রয়োজন আছে। সরকার যে তার আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চায়, এ ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে। সরকার ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গৃহীত সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টকে ২০১৩ সালের নভেম্বর অবধি অনুমোদন দেয়নি। তাহলে তারা কি আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী দেখতে চাইবে? এমন প্রশ্ন অনেকের। এ কথা মনে রেখেই সম্ভবত নবগঠিত কমিশনকে কাজ শুরু করতে হবে।
তবে আরও অনেক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, যেমন- সপ্তম বেতন কমিশন পরিবারের সদস্য সংখ্যা ধরেছে ৪ জন, এবার ধরা হবে ৬ জন, কারণ পরিবারের দু’সন্তানের সঙ্গে মাতা ও পিতাকে যুক্ত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিু বেতনের অনুপাত কত হবে- এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। সপ্তম বেতন কমিশন সচিবের বেতন ধরেছিল ৪৫ হাজার টাকা এবং একজন এমএলএসএসের বেতন ধরেছিল ৪০০০ টাকা। অনুপাতটি দাঁড়ায় ১১:১, যার বিরুদ্ধে নিুপদস্থ কর্মচারীরা প্রতিবাদ করেছিল। এবার এ সমস্যার একটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে হবে। এছাড়াও বর্তমান বেতন স্কেল বা গ্রেড আছে ২০টি, যার সংশোধন হওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের ধারণা, এর সংখ্যা হতে পারে ঊর্ধ্বে ১১টি। এসব জটিল বিষয় নিয়ে শুধু কমিশনকে এককভাবে ভাবলে চলবে না; উপকারভোগী, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের অভিমত নিতে হবে। এছাড়াও দেশ-বিদেশে অনুসৃত ও সফল কর্মসূচি দেখে এবং সরকারের আর্থিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ করে সুপারিশ প্রণয়ন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বেতন-ভাতা বাড়িয়ে বাজারমূল্যকে প্রভাবিত করা কোনো টেকসই ও বিধিসম্মত সমাধান নয়। আবার অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র প্রায় ৩ শতাংশ ব্যয় করে। কর্মচারীদের খুশি করার জন্য আরও বেশি ব্যয় করা হলে তা উন্নয়নের গতিধারাকে মন্থর করে দেবে, যা অবশ্যই অনভিপ্রেত।
এছাড়াও অনেক বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ মনে করে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলে ব্যবসায়ী ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব পড়ে, যার দায়ভার বহনের ক্ষমতা কোম্পানির মুনাফার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন দেখা যায়, তৈরি পোশাক শিল্পে এবার সর্বনিু ৫৩০০ টাকা বেতন নির্ধারণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল বিজিএমইএ। ওয়েজ বোর্ডের বিনির্ণয় বা রোয়েদাদ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের প্রতিপালনের জন্য বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা ছাড়াও এর মৌলিক দর্শন বা লক্ষ্য হতে হবে, সচ্ছল জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা প্রদান করে তাদের দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং শুদ্ধাচারের পথে চলতে অনুপ্রাণিত করা। এমনটি করতে পারাই হচ্ছে সরকারের দূরদর্শিতা এবং দেশবাসীর অভিপ্রায়।
জনগণের সেবক ও দেশের উন্নয়নকর্মী হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের অবদান রাখার সুযোগ দেবে সরকার। নীতিমালা অনুসারে আইন ও ন্যায়ের পক্ষে তাদের অবস্থান হবে সুদৃঢ় এবং তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর নিদর্শন রাখবে তাদের আচরণ ও দায়িত্ব পালনে- এটাই জনগণের প্রত্যাশা। যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি কোনো কাজে না লাগে বা দৃশ্যমান না হয়, তাহলে এ খাতে অর্থব্যয় শুধু অপব্যয় হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে বলে অনেকের অভিমত।
আবার অপর একশ্রেণীর অর্থনীতিবিদ মনে করেন, নগদ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পরিবর্তে সরকার অধিগম্য বা বাস্তবমুখী সুযোগ প্রদান করে সরকারি কর্মচারীদের যাপিত জীবনে অবদান রাখতে পারে। চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ভাতা প্রদান, যানবাহনের সুবিধা, বিশ্রাম ও বিনোদন ভাতা বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, গৃহ ঋণের অর্থিক সুবিধা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর অধিক সুদ প্রদান, যৌথ বীমা ছাড়াও জীবন বীমার প্রিমিয়াম প্রদানে সহযোগিতা দান করে সরকারি কর্মচারীদের জীবনে স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। কমিশনকে অবশ্যই এসব বিষয় পর্যালোচনা করতে হবে নিবিড়ভাবে।
তবে এ কমিশনকে চাকরির বিষয়গুলোও সম্ভবত দেখতে হবে। কমিশনের কর্মপরিধি যদিও এখনও পরিষ্কার নয়, তা সত্ত্বেও বলা যায়, বেতন-ভাতার সঙ্গে কর্মীর মর্যাদা ও অবস্থানকে অবশ্যই বিবেচ্য বিষয় হিসেবে আমলে নিতে হবে। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি অর্থবহ ও দক্ষ আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। এ কাজটি আরও বেশি জটিল এবং সরকারের বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। কোনো দুর্বল ও দলবাজিতে বিশ্বাসী সরকারের পক্ষে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে অতীতে অনেক কমিশন হয়েছে এবং তারা অনেক ভালো ভালো সুপারিশ দিয়েছে, যার কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে আবার অনেক কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, এ কমিশন কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিষয়টি ছাড়াও বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যাতে সততা ও দক্ষতার নিদর্শন রেখে জনগণের কাছে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে এমন সব সুপারিশ রাখবে, যা যে কোনো সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, কলাম লেখক
বর্তমান কমিশন হচ্ছে অষ্টম বেতন কমিশন। এর আগে বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭৩, ১৯৭৬, ১৯৮৪, ১৯৯০, ১৯৯৭, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে। প্রতিটি কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছে এবং মহার্ঘ ভাতা মূল বেতনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তবে এবারের কমিশনকে বলা হচ্ছে বেতন ও চাকরি কমিশন, যার অর্থ হচ্ছে- এ কমিশন বেতন-ভাতা ছাড়াও চাকরির বিষয়টি দেখবে, যা হবে অনেক বেশি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। সপ্তম বেতন কমিশন তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রদানে ১৪ মাস সময় নিয়েছিল। তাই বর্তমান কমিশন কিভাবে ৬ মাসের মধ্যে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করবে? অবশ্যই সময় বাড়াতে হবে।
এছাড়া এরূপ মৌলিক সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে জনপ্রিয় ও সদিচ্ছাসম্পন্ন সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার প্রয়োজন আছে। সরকার যে তার আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চায়, এ ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে। সরকার ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গৃহীত সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টকে ২০১৩ সালের নভেম্বর অবধি অনুমোদন দেয়নি। তাহলে তারা কি আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী দেখতে চাইবে? এমন প্রশ্ন অনেকের। এ কথা মনে রেখেই সম্ভবত নবগঠিত কমিশনকে কাজ শুরু করতে হবে।
তবে আরও অনেক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, যেমন- সপ্তম বেতন কমিশন পরিবারের সদস্য সংখ্যা ধরেছে ৪ জন, এবার ধরা হবে ৬ জন, কারণ পরিবারের দু’সন্তানের সঙ্গে মাতা ও পিতাকে যুক্ত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিু বেতনের অনুপাত কত হবে- এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। সপ্তম বেতন কমিশন সচিবের বেতন ধরেছিল ৪৫ হাজার টাকা এবং একজন এমএলএসএসের বেতন ধরেছিল ৪০০০ টাকা। অনুপাতটি দাঁড়ায় ১১:১, যার বিরুদ্ধে নিুপদস্থ কর্মচারীরা প্রতিবাদ করেছিল। এবার এ সমস্যার একটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে হবে। এছাড়াও বর্তমান বেতন স্কেল বা গ্রেড আছে ২০টি, যার সংশোধন হওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের ধারণা, এর সংখ্যা হতে পারে ঊর্ধ্বে ১১টি। এসব জটিল বিষয় নিয়ে শুধু কমিশনকে এককভাবে ভাবলে চলবে না; উপকারভোগী, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের অভিমত নিতে হবে। এছাড়াও দেশ-বিদেশে অনুসৃত ও সফল কর্মসূচি দেখে এবং সরকারের আর্থিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ করে সুপারিশ প্রণয়ন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বেতন-ভাতা বাড়িয়ে বাজারমূল্যকে প্রভাবিত করা কোনো টেকসই ও বিধিসম্মত সমাধান নয়। আবার অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র প্রায় ৩ শতাংশ ব্যয় করে। কর্মচারীদের খুশি করার জন্য আরও বেশি ব্যয় করা হলে তা উন্নয়নের গতিধারাকে মন্থর করে দেবে, যা অবশ্যই অনভিপ্রেত।
এছাড়াও অনেক বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ মনে করে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলে ব্যবসায়ী ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব পড়ে, যার দায়ভার বহনের ক্ষমতা কোম্পানির মুনাফার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন দেখা যায়, তৈরি পোশাক শিল্পে এবার সর্বনিু ৫৩০০ টাকা বেতন নির্ধারণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল বিজিএমইএ। ওয়েজ বোর্ডের বিনির্ণয় বা রোয়েদাদ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের প্রতিপালনের জন্য বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা ছাড়াও এর মৌলিক দর্শন বা লক্ষ্য হতে হবে, সচ্ছল জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা প্রদান করে তাদের দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং শুদ্ধাচারের পথে চলতে অনুপ্রাণিত করা। এমনটি করতে পারাই হচ্ছে সরকারের দূরদর্শিতা এবং দেশবাসীর অভিপ্রায়।
জনগণের সেবক ও দেশের উন্নয়নকর্মী হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের অবদান রাখার সুযোগ দেবে সরকার। নীতিমালা অনুসারে আইন ও ন্যায়ের পক্ষে তাদের অবস্থান হবে সুদৃঢ় এবং তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর নিদর্শন রাখবে তাদের আচরণ ও দায়িত্ব পালনে- এটাই জনগণের প্রত্যাশা। যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি কোনো কাজে না লাগে বা দৃশ্যমান না হয়, তাহলে এ খাতে অর্থব্যয় শুধু অপব্যয় হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে বলে অনেকের অভিমত।
আবার অপর একশ্রেণীর অর্থনীতিবিদ মনে করেন, নগদ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পরিবর্তে সরকার অধিগম্য বা বাস্তবমুখী সুযোগ প্রদান করে সরকারি কর্মচারীদের যাপিত জীবনে অবদান রাখতে পারে। চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ভাতা প্রদান, যানবাহনের সুবিধা, বিশ্রাম ও বিনোদন ভাতা বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, গৃহ ঋণের অর্থিক সুবিধা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর অধিক সুদ প্রদান, যৌথ বীমা ছাড়াও জীবন বীমার প্রিমিয়াম প্রদানে সহযোগিতা দান করে সরকারি কর্মচারীদের জীবনে স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। কমিশনকে অবশ্যই এসব বিষয় পর্যালোচনা করতে হবে নিবিড়ভাবে।
তবে এ কমিশনকে চাকরির বিষয়গুলোও সম্ভবত দেখতে হবে। কমিশনের কর্মপরিধি যদিও এখনও পরিষ্কার নয়, তা সত্ত্বেও বলা যায়, বেতন-ভাতার সঙ্গে কর্মীর মর্যাদা ও অবস্থানকে অবশ্যই বিবেচ্য বিষয় হিসেবে আমলে নিতে হবে। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি অর্থবহ ও দক্ষ আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। এ কাজটি আরও বেশি জটিল এবং সরকারের বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। কোনো দুর্বল ও দলবাজিতে বিশ্বাসী সরকারের পক্ষে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে অতীতে অনেক কমিশন হয়েছে এবং তারা অনেক ভালো ভালো সুপারিশ দিয়েছে, যার কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে আবার অনেক কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, এ কমিশন কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিষয়টি ছাড়াও বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যাতে সততা ও দক্ষতার নিদর্শন রেখে জনগণের কাছে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে এমন সব সুপারিশ রাখবে, যা যে কোনো সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments