আমরা কবে পৌঁছাব গণতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে? by কারার মাহমুদুল হাসান
গত
১৮ নভেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকালীন রুটিন কাজ পরিচালনার
লক্ষ্যে ৮ সদস্যের একটি মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। এ ৮
জনের মধ্যে ৫ জনই এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য। দু’জন আওয়ামী
লীগের, যারা গত পাঁচ বছর দৃশ্যমানভাবে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে কমবেশি
অবহেলা-অনাদরে দিন কাটিয়েছেন এবং অন্যজন ওয়ার্কার্স পার্টির। ইতিমধ্যে এ
মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হয়েছে। তাদের সবাইকে নিয়েই এ আপৎকালীন মন্ত্রিসভা। এ
মন্ত্রিসভাকে বর্তমান সরকারি মহল অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রিসভা নামে অভিহিত
করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। আর বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এ নতুন মন্ত্রিসভাকে
নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার না বলে একে সদ্য বিদায়ী মহাজোট সরকারেরই
নতুন সংস্করণ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বিগত কয়েকটি সাধারণ
নির্বাচনের ভোটচিত্র দেখা যেতে পারে। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া প্রার্থীদের দলগত অবস্থান ছিল এরকম : ক. আওয়ামী
লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ৩০০ প্রার্থীর মধ্যে ২ জন, খ. বিএনপির
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ২৫২ জন প্রার্থীর মধ্যে ৭ জন, গ. আনোয়ার হোসেন
মঞ্জুর জেপি’র ১৪০ জনের মধ্যে ১৩৬ জন, ঘ. জামায়াতে ইসলামীর ৩১ জন প্রার্থীর
মধ্যে ৪ জন, ঙ. ওয়ার্কার্স পার্টির ৩২ জনের মধ্যে ৩২ জনই, চ. গণফোরামের ১৭
জনের মধ্যে ১৭ জনই এবং ছ. বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের ত্রিধা বিভক্ত
বিভিন্ন ‘ফেরকা’র মোট ৪৬ জন প্রার্থীর সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। অন্য
আরও প্রায় চার ডজন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ (স্বতন্ত্র ৪৮৬ জন
প্রার্থীসহ) করেছিল এবং সেসব দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ৯৫ থেকে ১০০ ভাগ
প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে এরশাদ সাহেবের দল
(জাপা) অংশ নিলেও দলগতভাবে দেয় ভোটের ১.১২ ভাগ ভোট লাভ করেছিল এবং আনোয়ার
হোসেন মঞ্জুর জেপির প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ০.৪৪ ভাগ। ওই নির্বাচন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।
৭ম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১২ জুন ১৯৯৬ সালে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট দেয় ভোটের ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট পেয়ে ১৪৬টি সদস্যপদে জয়ী হয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়। এ নির্বাচনে (যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়) বিএনপি মোট দেয় ভোটের ৩৩.৬০ ভাগ (১১৬ সংসদ সদস্যপদে জয়ী), জাতীয় পার্টি মোট দেয় ভোটের ১৬.৪০ ভাগ (প্রাপ্ত সংসদ সদস্যপদ ৩২), জামায়াতে ইসলামী মোট দেয় ভোটের ৮.৬১ ভাগ (প্রাপ্ত সংসদ সদস্যপদ ৩টি) ভোট লাভ করে।
১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৩০০ আসনের মধ্যে ২ জন, বিএনপির ৩৬ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির ৩৪ জনের মধ্যে ৩৩ জন, জাসদের (ইনু) ৩০ জনের মধ্যে ২৯ জন এবং বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের ৪ জনের সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় অতিশয় নিরপেক্ষ ও কঠোরভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে। সে নির্বাচনে বিএনপি ৩০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মোট ১৪০টি সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয় এবং বিএনপির মোট প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫ লাখ ৭ হাজার ৫৪৯, যা মোট দেয় ভোটের ৩০.৮১ ভাগ। দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে মোট ২৬৪টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮৮টি আসনে বিজয়ী হয় এবং দলটির মোট প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬৬, যা মোট দেয় ভোটের ৩০.০৮ ভাগ। এছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের (তিনি তখন কারাগারে অন্তরীণ) জাতীয় পার্টি ২৭২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩৭ ভোট পায় (শতকরা হারে প্রাপ্ত ভোট ১১.৯২ ভাগ) এবং ৩৫টি আসন লাভে সক্ষম হয়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ২২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ দলের মোট প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬১। দলটি জাতীয় পার্টি থেকে বেশি ভোট পেয়েও (শতকরা হারে প্রাপ্ত ভোট ১২.১৩ ভাগ) মাত্র ১৮টি আসন লাভে সক্ষম হয়।
ওই নির্বাচনে বিগত মহাজোটের অংশীদার জাসদ (ইনু) ৬৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাকুল্যে ভোট পেয়েছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ১১টি। তবে কোনো আসন লাভ করতে পারেনি। বিগত মহাজোটের আরেক অংশীদার ওয়ার্কার্স পার্টি (তখন দলটি ভাগ হয়নি) ৩০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাকুল্যে ভোট পেয়েছিল ৬৩ হাজার ৪৩৪টি, যদিও ওই নির্বাচনে তারা একটি আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। একইভাবে জোটের অংশ বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল মোট ৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাকুল্যে ১১ হাজার ২৭৫টি ভোট লাভ করেছিল। সে দলের এক কাণ্ডারি দিলীপ বড়–য়া ছিলেন সদ্য বিদায়ী মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী। ওই নির্বাচনে সিপিবিও অংশ নিয়েছিল জোটের দল হিসেবে। তাদের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭ হাজার ৫১৫ এবং প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল পাঁচ।
এখানে উল্লেখ করার বিষয় হল, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শতকরা হারে বিএনপির প্রায় সমান ভোট লাভ করলেও বিএনপির তুলনায় অর্ধশতাধিক আসন কম পায়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদরা কোনো গবেষণা করেছেন কি-না জানা নেই।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করতে চাই। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়, ‘ঘরে ঘরে চাকরি’ প্রদানের ঘোষণাসহ বড় বড় ওয়াদা। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের অংশ হিসেবে জাসদ (ইনু) হাসানুল হক ইনুসহ ৩টি আসনে এবং ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন) সাকুল্যে ২টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। দল দুটি এ নির্বাচনে সাকুল্যে ৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩৭টি ভোট লাভ করেছিল। দিলীপ বড়–য়ার সাম্যবাদী দল পেয়েছিল ২৯৭ ভোট।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত ওয়াদাগুলোর কতভাগ গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বড় বড় বিলবোর্ডে দৃষ্টিনন্দন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ্ গ্র“প, রেলওয়ের কালো বিড়াল এবং পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট কথিত দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটনা মহাজোট সরকারকে জনসমর্থনে এগিয়ে নিতে পারেনি, যার আলামত পাওয়া গেছে সদ্য সমাপ্ত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা বাংলাদেশের জনগণ অতি আশা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রা শুরু করেছিলাম। এ দুই দশকে এবং তার আগের দশকেও দেশে অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, সন্দেহ নেই। তবে ‘গণতন্ত্রে’র ধারণা আমাদের রাজনীতিকদের কাছে একটি নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এবং কমবেশি পাঁচ বছর পরপর এ কাজটি সম্পন্ন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। দেশের জনগণ পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য নিজেদের সবকিছুর ‘মালিক’ মনে করে উৎফুল্ল ও আনন্দবোধ করেন। নির্বাচনের পর তাদের কথা ভাবার সময় পান না ক্ষমতাসীনরা। সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, সরকারি দলের নব্য ও পুরনো সমর্থকরা তখন নির্বাচন-পরবর্তী সব ভাবনা, সময় ও শক্তি নিয়োজিত করেন নতুন টেলিভিশনের লাইসেন্স, রাজউকের প্লট বরাদ্দ, নতুন ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ খোলার ও সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার ক্রয়ের পারমিট, সেই সঙ্গে ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশে লোক পাঠানো ও দেশে চাকরি প্রদানের নামে মাথাপিছু ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট নেয়ার কাজগুলো সূচারুভাবে সম্পন্ন করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে। এ অবস্থায় তাদের আমজনতার কথা ভাবার ফুরসত কোথায়! উদ্বেগের সঙ্গে অনুমান করা যায়, নাদান দেশবাসী আরও কয়েক বছর এভাবেই ‘গণতন্ত্র’ বিষয়ে ধাক্কাধাক্কির সুমহান কাজগুলো সহিসালামতে সম্পন্ন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে তথা মনজিল মক্সুদে একদিন না একদিন পৌঁছে যেতেও পারে।
কারার মাহমুুদুল হাসান : সাবেক সচিব; ’৬২-এর শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা কলেজ থেকে রাস্টিকেটকৃত ১১ জনের একজন
৭ম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১২ জুন ১৯৯৬ সালে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট দেয় ভোটের ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট পেয়ে ১৪৬টি সদস্যপদে জয়ী হয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়। এ নির্বাচনে (যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়) বিএনপি মোট দেয় ভোটের ৩৩.৬০ ভাগ (১১৬ সংসদ সদস্যপদে জয়ী), জাতীয় পার্টি মোট দেয় ভোটের ১৬.৪০ ভাগ (প্রাপ্ত সংসদ সদস্যপদ ৩২), জামায়াতে ইসলামী মোট দেয় ভোটের ৮.৬১ ভাগ (প্রাপ্ত সংসদ সদস্যপদ ৩টি) ভোট লাভ করে।
১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৩০০ আসনের মধ্যে ২ জন, বিএনপির ৩৬ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির ৩৪ জনের মধ্যে ৩৩ জন, জাসদের (ইনু) ৩০ জনের মধ্যে ২৯ জন এবং বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের ৪ জনের সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় অতিশয় নিরপেক্ষ ও কঠোরভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে। সে নির্বাচনে বিএনপি ৩০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মোট ১৪০টি সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয় এবং বিএনপির মোট প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫ লাখ ৭ হাজার ৫৪৯, যা মোট দেয় ভোটের ৩০.৮১ ভাগ। দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে মোট ২৬৪টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮৮টি আসনে বিজয়ী হয় এবং দলটির মোট প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬৬, যা মোট দেয় ভোটের ৩০.০৮ ভাগ। এছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের (তিনি তখন কারাগারে অন্তরীণ) জাতীয় পার্টি ২৭২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩৭ ভোট পায় (শতকরা হারে প্রাপ্ত ভোট ১১.৯২ ভাগ) এবং ৩৫টি আসন লাভে সক্ষম হয়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ২২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ দলের মোট প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬১। দলটি জাতীয় পার্টি থেকে বেশি ভোট পেয়েও (শতকরা হারে প্রাপ্ত ভোট ১২.১৩ ভাগ) মাত্র ১৮টি আসন লাভে সক্ষম হয়।
ওই নির্বাচনে বিগত মহাজোটের অংশীদার জাসদ (ইনু) ৬৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাকুল্যে ভোট পেয়েছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ১১টি। তবে কোনো আসন লাভ করতে পারেনি। বিগত মহাজোটের আরেক অংশীদার ওয়ার্কার্স পার্টি (তখন দলটি ভাগ হয়নি) ৩০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাকুল্যে ভোট পেয়েছিল ৬৩ হাজার ৪৩৪টি, যদিও ওই নির্বাচনে তারা একটি আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। একইভাবে জোটের অংশ বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল মোট ৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাকুল্যে ১১ হাজার ২৭৫টি ভোট লাভ করেছিল। সে দলের এক কাণ্ডারি দিলীপ বড়–য়া ছিলেন সদ্য বিদায়ী মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী। ওই নির্বাচনে সিপিবিও অংশ নিয়েছিল জোটের দল হিসেবে। তাদের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭ হাজার ৫১৫ এবং প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল পাঁচ।
এখানে উল্লেখ করার বিষয় হল, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শতকরা হারে বিএনপির প্রায় সমান ভোট লাভ করলেও বিএনপির তুলনায় অর্ধশতাধিক আসন কম পায়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদরা কোনো গবেষণা করেছেন কি-না জানা নেই।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করতে চাই। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়, ‘ঘরে ঘরে চাকরি’ প্রদানের ঘোষণাসহ বড় বড় ওয়াদা। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের অংশ হিসেবে জাসদ (ইনু) হাসানুল হক ইনুসহ ৩টি আসনে এবং ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন) সাকুল্যে ২টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। দল দুটি এ নির্বাচনে সাকুল্যে ৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩৭টি ভোট লাভ করেছিল। দিলীপ বড়–য়ার সাম্যবাদী দল পেয়েছিল ২৯৭ ভোট।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত ওয়াদাগুলোর কতভাগ গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বড় বড় বিলবোর্ডে দৃষ্টিনন্দন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ্ গ্র“প, রেলওয়ের কালো বিড়াল এবং পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট কথিত দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটনা মহাজোট সরকারকে জনসমর্থনে এগিয়ে নিতে পারেনি, যার আলামত পাওয়া গেছে সদ্য সমাপ্ত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা বাংলাদেশের জনগণ অতি আশা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রা শুরু করেছিলাম। এ দুই দশকে এবং তার আগের দশকেও দেশে অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, সন্দেহ নেই। তবে ‘গণতন্ত্রে’র ধারণা আমাদের রাজনীতিকদের কাছে একটি নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এবং কমবেশি পাঁচ বছর পরপর এ কাজটি সম্পন্ন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। দেশের জনগণ পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য নিজেদের সবকিছুর ‘মালিক’ মনে করে উৎফুল্ল ও আনন্দবোধ করেন। নির্বাচনের পর তাদের কথা ভাবার সময় পান না ক্ষমতাসীনরা। সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, সরকারি দলের নব্য ও পুরনো সমর্থকরা তখন নির্বাচন-পরবর্তী সব ভাবনা, সময় ও শক্তি নিয়োজিত করেন নতুন টেলিভিশনের লাইসেন্স, রাজউকের প্লট বরাদ্দ, নতুন ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ খোলার ও সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার ক্রয়ের পারমিট, সেই সঙ্গে ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশে লোক পাঠানো ও দেশে চাকরি প্রদানের নামে মাথাপিছু ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট নেয়ার কাজগুলো সূচারুভাবে সম্পন্ন করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে। এ অবস্থায় তাদের আমজনতার কথা ভাবার ফুরসত কোথায়! উদ্বেগের সঙ্গে অনুমান করা যায়, নাদান দেশবাসী আরও কয়েক বছর এভাবেই ‘গণতন্ত্র’ বিষয়ে ধাক্কাধাক্কির সুমহান কাজগুলো সহিসালামতে সম্পন্ন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে তথা মনজিল মক্সুদে একদিন না একদিন পৌঁছে যেতেও পারে।
কারার মাহমুুদুল হাসান : সাবেক সচিব; ’৬২-এর শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা কলেজ থেকে রাস্টিকেটকৃত ১১ জনের একজন
No comments