সীতাকুণ্ডে কী হচ্ছে!

ভীতি-আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে সীতাকুণ্ড। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এ এলাকায় হেন কোনো অপকর্ম নেই, যা ঘটেনি। অথচ প্রশাসন যেন কিছুতেই কিছু করতে পারছে না। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অস্থায়ী ক্যাম্প করেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না পরিস্থিতি। তুচ্ছ যেকোনো অজুহাতে মহাসড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, যাত্রীদের ওপর হামলা, তাদের মালপত্র লুটপাট ইত্যাদি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আশ্বাসবাণী শোনানো হচ্ছে, কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারছে না সাধারণ মানুষ। একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে এই এলাকার কিছু দুর্বৃত্ত যেন ঘোষণা করেছে, এটি তাদের অভয়ারণ্য। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি জিম্মি হয়ে পড়ায় সাধারণ যাত্রীরা যেমন পোহাচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ, তেমনি বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানিপণ্যের আনা-নেওয়ায় প্রতিবন্ধকতার কারণে বিরাট অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়ছে দেশ। এই নৈরাজ্যের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের এক সভায় চেম্বারের একজন পরিচালক বলেছেন, ‘যেসব রাজনৈতিক নেতা মহাসড়কে গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, তাঁদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করার জন্য পরিবহনশ্রমিকদের আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রয়োজনে আমরা পরিকল্পনাকারীদের ঠিকানা শ্রমিকদের হাতে তুলে দেব।’ কতটা হতাশা থেকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কতটা আস্থাহীনতা থেকে একজন ব্যবসায়ী নেতা শ্রমিকদের প্রতি আইন হাতে তুলে নেওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পুলিশ কমিশনার। তাঁরাও গলা মিলিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে। ডিআইজি সাহেব গাড়িতে লাঠি রাখার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, দুষ্কৃতকারীদের সংখ্যা সাত-আটজনের বেশি হবে না। লাঠি হাতে শ্রমিকেরা প্রতিরোধ করলে কেউ গাড়িতে আগুন দেওয়ার বা ভাঙচুর করার সাহস পাবে না। খোদ ডিআইজি বলছেন, দুষ্কৃতকারীরা মাত্র সাত-আটজন, লাঠি হাতে প্রতিরোধ করলেই হবে, ব্যাপারটা এতই সাধারণ? তাহলে এই প্রশ্ন আমাদের মনে জাগবে না, এত জনবল নিয়েও কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই অরাজকতার নিরসন করতে পারল না? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড এলাকায় শত শত গাড়ি আটকা পড়েছে, রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাচের টুকরা, দাউ দাউ করে পুড়ছে গাড়ি। এসব দৃশ্য নিয়মিত উঠে আসছে পত্রিকার পাতায়। কিন্তু প্রতিকার কিছুই হয়নি।
কয়েক দিন আগে ছুটির দিন শুক্রবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসার পথে সীতাকুণ্ডে এ রকম এক অবরোধের কবলে পড়ে পথে দুঃসহ রাত কাটাতে হয়েছে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীকে। অবরোধ তুলে নেওয়ার পর বিশাল যানজটের কবলে পড়ে নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি প্রায় আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রী। সেই ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকদের কান্নায় সেদিন অবর্ণনীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল ক্যাম্পাসে। যেসব ছাত্রছাত্রী (প্রায় দেড় হাজার) বাড়তি দেড় ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন কেন্দ্রে, তাঁরা পাননি পরীক্ষা দেওয়ার বাড়তি সময়। তাহলে এই চার হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবনের এত বড় বিপর্যয়ের দায় কার? গত ঈদের সময় বাড়ি ফেরার পথে সীতাকুণ্ড এলাকায় এ রকম সহিংসতার কবলে পড়া এক নারী সাংবাদিক তাঁর বীভৎস অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন। যে গাড়িতে তিনি ছিলেন, দুর্বৃত্তরা সেই গাড়ির চালকের গায়ে আগুন দিতে গেলে লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন ওই সাংবাদিক। সেখানে সম্মুখীন হয়েছিলেন আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির। কিছু লোক যাত্রীদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে মালামাল, টাকাপয়সা। এমনকি মেয়েদের গায়ে হাত দিতেও দ্বিধা করছে না এই দুর্বৃত্তরা। কারা এরা? মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণা শুরু হওয়ার পর থেকেই সীতাকুণ্ডের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নাশকতার ঘটনা ঘটতে থাকে। তবে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে বিরোধী দলের টানা হরতাল কর্মসূচি শুরু হলে নাশকতার মাত্রা বেড়ে যায়। তিন দফায় ১০ দিনের হরতালের সময় প্রায় প্রতিদিন অবরোধ,
গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সুতরাং, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা যে এর সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপির এক স্থানীয় নেতা ও শিল্পপতি এ কর্মকাণ্ডে অর্থের জোগান দিচ্ছেন এবং তাঁর মালিকানাধীন শিপইয়ার্ডের বহিরাগত শ্রমিকেরা ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহূত হচ্ছেন, এমন তথ্য ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। কিন্তু মাঠে বিএনপির চেয়ে জামায়াতের উৎসাহ যে এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি, এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন সাংবাদিকসহ প্রত্যক্ষদর্শী সবাই। এমনকি বিরোধী দলের কর্মসূচিতে যোগ দিতে সীতাকুণ্ড জামায়াতের এই গ্রুপ চট্টগ্রাম শহরে এসেও ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ে অংশ নিয়েছে বলে অভিযোগ। সীতাকুণ্ডের সাংসদ বা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান—সবাই আওয়ামী লীগের। এমনকি পার্শ্ববর্তী মিরসরাই এলাকার সাংসদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও আওয়ামী লীগের। এ এলাকার সাংসদ দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোশাররফ হোসেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের এলাকায় এমন দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। কোন্দলে জর্জরিত স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়তে যতটা উৎসাহী, ততটা আর কিছুতেই নয়। অবশেষে গতকাল শনিবার সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এক সভায় মিলিত হয়েছেন করণীয় নির্ধারণ করতে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা মান-অভিমান আছে বলে জানিয়েছেন মোশাররফ হোসেন। জানি না মাঠে নামানোর কাজে কতটা সফল হবেন তাঁরা।
তবে এ রকম অরাজক পরিস্থিতিতে যে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ‘অভিমান’ করে ঘরে বসে থাকতে পারেন, তাঁদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করা কঠিন। সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা থেকে বটতল এলাকা পর্যন্ত ১৫টি পয়েন্টকে ‘বিপজ্জনক এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বিপদ চিহ্নিত করা গেছে, কিন্তু এর প্রতিকার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডিআইজি বলেছেন, দুষ্কৃতকারীরা সাত-আটজনের বেশি হবে না। প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে এ কথা বলেছেন বলে মনে হয় না, কিংবা সাধারণ মানুষ যাতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে না পড়ে, এ জন্যও বলে থাকতে পারেন। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? আমাদের ধারণা, এ ধরনের ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে দুর্বৃত্তদের (কিংবা বিক্ষোভকারী) সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে আগেভাগেই তাদের চিহ্নিত করা ও আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পথটিই অধিকতর কার্যকর। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কাজটি যথাযথভাবে করতে পারেননি, অন্তত মাসাধিককাল ধরে চলতে থাকা নৈরাজ্য সেই ইঙ্গিতই দেয়। ভবিষ্যতে পারবেন কি না, তা-ও জানি না। পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সীতাকুণ্ডের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চট্টগ্রামের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত হওয়ায় উদ্বেগটা আরও বেশি বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। এই উদ্বেগের চাপে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কতটা সক্রিয়হয়, দেখার বিষয় সেটাই!
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.