প্রধানমন্ত্রীর অনড় অবস্থানই বাধা

একতরফাভাবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে সংঘাতময় অবস্থা আরও ঘনীভূত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা’ও গঠন করেছে। অথচ সেখানে প্রধান বিরোধী দল অনুপস্থিত। মূল সমস্যা, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী।
সব দলের সব মন্ত্রী যদি কোনো সিদ্ধান্তও নেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া তা বাস্তবায়িত হবে না। এ কারণেই প্রধান বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবি জানাচ্ছে, যাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা যেতে পারে। স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতা এবং তা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সেই ক্ষমতা ত্যাগ না করাই সংকটের গোড়ার কারণ। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর যে একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত দেওয়ার ও মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া না-দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে, সবার আগে তার মীমাংসা হতে হবে। নির্বাচনের সময়ের জন্য যদি এই ক্ষমতা স্থগিত করে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়, যা নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা পরিবর্তন ও পুনর্গঠন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী থাকবে, তাহলে বিরোধী দলের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি অনেকটা পূরণ হবে।
কেননা, প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী রেখে গঠিত মন্ত্রিসভা আসলে ক্ষমতাবিহীন মন্ত্রিসভা, প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী কেবল দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি আওয়ামী লীগেরও সভাপতি, সেহেতু তাঁকে স্বপদে বহাল রেখে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, এমন বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ নেই। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই নির্বাচনের সময় একচ্ছত্র নির্বাহী ক্ষমতা ত্যাগ করে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। যে সরকারের মন্ত্রিসভা মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রশাসনিক অদলবদলসহ নির্বাচন কমিশনেরও পুনর্গঠনের অধিকারী থাকবে। এ ছাড়া সংঘাতময় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নেই। এই অনিশ্চয়তা অনির্দিষ্ট সময় ধরে চললে জানমালের ক্ষতি হবে, অর্থনীতি ধ্বংস হবে এবং বহু কষ্টে অর্জিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্ক দেখা দেবে। এ অবস্থা তৈরির দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিধান জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে করা হয়নি। উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা ছিল: রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংসদ ইচ্ছা করলে দেশের স্বার্থে আগামী দুই-তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের উচিত ছিল বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করে গ্রহণযোগ্য অবস্থান নেওয়া।
অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই সরকার সংবিধান সংশোধন করে ফেলল! সুপ্রিম কোর্টের আপিলাত ডিভিশনের সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর তাদের এতই যদি আস্থা থাকত, তাহলে রায়ে উল্লিখিত ওই পর্যবেক্ষণে কর্ণপাত না করে হঠাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিত না। আজকের এই সংঘাতময় অবস্থার জন্য দায়ী এই একতরফা রদবদল। আমাদের নির্বাচন কমিশনেরও উচিত ছিল রায়ের দিকনির্দেশনা আমলে নেওয়া। ওই রায়ে লেখা ছিল, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকারও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, নির্বাচন কমিশনও ভ্রুক্ষেপ করেনি। আইনজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, এই রায় বাইন্ডিং কিছু নয়। যদি রায়ের ওপর এতই সমীহ থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের স্বার্থে এই পর্যবেক্ষণ তো পালনীয় ছিল।আমরা আশা করব, সাংবিধানিকভাবে যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সমঝোতার ভিত্তিতে দেশকে এই সংঘাতময় অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য বলবেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন।
তাঁরও উচিত হবে একগুঁয়েমি করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পথ থেকে সরে আসা। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন বিধি তথা আরপিও পরিবর্তন করে মনোনয়ন-বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে। আগে কমপক্ষে তিন বছর কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না থাকলে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারতেন না। কিন্তু এখন যেকোনো দলের যেকোনো ব্যক্তি বহিষ্কৃত হলে বা পদত্যাগ করে অন্য দলে যোগ দিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। এটা প্রকারান্তরে দল ভাঙার প্ররোচনা এবং টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন কেনার সুযোগ করে দেওয়া। ফলে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যে রাজনীতিবিদ কোনো দল থেকে মনোনয়ন পাবেন না, অর্থের বিনিময়ে তিনি অন্য দল থেকে নির্বাচনের প্রচেষ্টা চালাবেন। নির্বাচন কমিশন এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষিত করছে।
এসব কারণে নির্বাচন কমিশনের ওপর বিরোধী দলের আস্থা নেই। এ রকম এক সংঘাতময় অবস্থায় নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব করেছে। এটা হবে হঠকারী। এই একদলীয় নির্বাচনে সংঘাতের মুহূর্তে, যখন নির্বাচন নিয়ে জনমনে বিভক্তি বিরাজ করছে, তখন সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা যাবে না। পরিহাস হলো, আমরা যখন নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী থাকার প্রস্তাব করেছিলাম, তখন নির্বাচন কমিশন বলেছে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। এমনকি আরপিওতেও তারা সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। কিন্তু এখন জনরোষের কবল থেকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীকে ঢাল করা হচ্ছে। এতে সেনাবাহিনী কেবল দেশের মধ্যেই বিতর্কিত হবে না, আন্তর্জাতিকভাবেও তাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। খোন্দকার মাহবুব হোসেন: আইনজীবী ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.