রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ইস্যু by মেজর সুধীর সাহা (অব.)
বাংলাদেশের
স্বাধীনতায় এদেশের সংখ্যালঘুদের বিশেষ একটি স্থান ছিল। পাকিস্তানের
তৎকালীন কর্তৃপক্ষ সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের শত্র“ভাবাপন্ন
দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রথমদিকে পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর লোকদের ভুল ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, এদেশের হিন্দু এবং
পার্শ্ববর্তী শত্র“দেশ ভারতের অনুচররাই মুক্তিযুদ্ধ করছে। পাকিস্তান সেনা
সদস্যরা তাদের নিধনে তাই বেছে বেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করতে
চেয়েছে। পরবর্তী সময়ে তাদের অবশ্য এই ভুল ভেঙেছিল এবং তারা বুঝতে পেরেছিল,
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষই মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল।
তারপরও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন নিগৃহীত হয়েছে অধিক হারে। রাস্তায়
রাস্তায় মানুষকে থামিয়ে প্যান্ট খুলে পরীক্ষা করা হতো তারা হিন্দু কি-না।
কলেমা পড়তে বলা হতো বোঝার জন্য যে তারা সত্যি সত্যি মুসলমান কি-না। ইসলাম
ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে হবে- এই ছিল তাদের যুক্তি।
তাই সংখ্যালঘু হিন্দুদের তারা সহজেই টার্গেট করতে পেরেছিল। সংখ্যালঘুরা
বেশিরভাগই ছিল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, ভক্ত, সমর্থক। ’৭৫-এর
আগে গুটিকয়েক বাম দলের নেতাকর্মী ছাড়া অবশিষ্ট হিন্দুরা ছিল আওয়ামী লীগের
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিএনপির জন্ম হলে হাতেগোনা কিছু সংখ্যালঘু সেই দলে ভিড়লেও
সংখ্যালঘুদের মূলধারাটি রয়ে যায় আওয়ামী লীগের সমর্থনেই। জিয়াউর রহমানের
নেতৃত্বে যতদিন বিএনপি ছিল, ততদিন তিনি চেষ্টা করেছিলেন সংখ্যালঘুদের এক
অংশকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে শামিল করতে। কিছুটা কাজ হলেও খুব বেশি সফলতা
লাভ করতে পারেননি জেনারেল জিয়া। পরবর্তী সময়ে বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার
নেতৃত্বে আসার পর তার দলে সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমে প্রায় শূন্যের কোঠায়
পৌঁছে। একসময় এরশাদের জাতীয় পার্টিও সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা
করে। কিছু সংখ্যালঘু এরশাদের সঙ্গে এখনও আছে। তবে সংখ্যার বিচারে তা উল্লেখ
করার মতো নয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিকায় বিভিন্ন বাম দল
সংখ্যালঘুদের একটি অংশকে ধরে রাখলেও সংখ্যালঘুদের মূল অংশটি আওয়ামী লীগের
সমর্থক হিসেবেই এখনও আছে। খালেদা জিয়ার বিএনপিতে হাতেগোনা কয়েকজন নেতা
থাকলেও ওই নেতাদের পরিবারের নিকটতম আত্মীয় ছাড়া আর বিশেষ কেউ তাদের সঙ্গে
নেই বলেই মনে হয়। বিএনপি সংখ্যালঘুদের সমর্থনের বিষয়ে কখনও ইতিবাচক ভূমিকা
পালন করতে পারেনি। অদৃশ্য কারণে এবং ধর্মীয় রাজনীতির কারণে খালেদা জিয়ার
নেতৃত্বাধীন বিএনপি সংখ্যালঘুদের ভোট বা সমর্থনের চেষ্টা কখনও করতে পারেনি।
জামায়াত পুরোপুরিভাবেই মৌলবাদভিত্তিক রাজনীতি করে বিধায় মহিলা ও ধর্মীয়
সংখ্যালঘুরা তাদের দল থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেছে সবসময়। জামায়াত তার দলে
একজন সংখ্যালঘুকেও নিয়ে দেখাতে পারেনি যে, তাদের সঙ্গে অন্তত একজন
সংখ্যালঘু আছে।
রাজনৈতিক দলে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব থাকুক আর নাই থাকুক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব দলেই সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে একটি রাজনীতি সব সময়ই চলেছে এবং এখনও আছে। জামায়াতের মতো দলেও সংখ্যালঘু ইস্যু নানাভাবে গবেষণার উপাদান হয়ে ওঠে। রাজনীতির মাঠে তাণ্ডব অথবা আলোড়ন সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করলে জামায়াত সবার আগে টার্গেট করে সংখ্যালঘুদের জানমাল আর মন্দিরকে। মন্দির ভেঙে দিয়ে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বিপদে ফেলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় জামায়াত। সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়লে জামায়াতের মতো মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর দু’দিক থেকে লাভ। প্রথমত, ভোটের হিসাবে যারা নিশ্চিত বিপক্ষে অবস্থান করবে, তারা দেশ ছাড়লে ভোটের হিসাবে লাভ হয়। দ্বিতীয়ত, হিন্দুরা দেশ ছাড়া মানেই বাড়িঘর-সম্পত্তি ছেড়ে যাওয়া। আর সেখানে বিনা অর্থে অথবা কম মূল্যে নতুন সম্পত্তি অর্জনের সুযোগ। সংখ্যালঘু ইস্যুতে উল্লিখিত দুটি সুবিধার সুযোগ যে শুধু জামায়াতের মতো কট্টর মৌলবাদী দলই গ্রহণ করছে তাই নয়, বরং এর সুবিধা নিয়েছে অন্যান্য দলও। এমনকি হিন্দুদের বাড়িঘর অবৈধভাবে দখল করার তালিকায় আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলেরও অনেকে আছে। কাজেই ঘুরেফিরে সংখ্যালঘুরা রাজনীতির সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব নিয়ে বসবাস করছে। সংখ্যালঘুদের এমন গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি যে শুধু বাংলাদেশেই রয়েছে তা নয়, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ইস্যুটি নানা দেশেই দৃশ্যমান। সংখ্যালঘুদের বিষয়ে বিশ্ব সমাজও সতর্ক ও সোচ্চার। তাই যখন ভারতের গুজরাটে সংখ্যালঘু মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছিল, তখন সারা বিশ্ব এর নিন্দায় সুর মিলিয়েছিল। গুজরাটের সংখ্যালঘু নিধনের হোতা মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ মোদি তাই আজও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মধ্যে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমার সফরে এসে সবার আগে সে দেশে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বাংলাদেশে যখন বিএনপি ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপকভাবে অত্যাচার করেছিল, তখনও বিশ্ব সমাজ তার নিন্দায় সোচ্চার ছিল।
হিন্দু হলেই যে কারও সঙ্গে ভারতের কাল্পনিক সম্পর্ক খুঁজে বেড়ানো একশ্রেণীর রাজনৈতিক দলের পুরনো অভ্যাস। এভাবে অপরাজনীতির চর্চা করে তারা দেশপ্রেমিক সংখ্যালঘুদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ করেছে বারবার। মনের কষ্টে সহায়-সম্পত্তি ত্যাগ করে অনেক সংখ্যালঘুই দেশ ছেড়েছে ইতিমধ্যে। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, অধিকতর শিক্ষিত ও সম্পদশালী সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশ ছেড়ে শুধু ভারতেই নয় বরং বেশি মাত্রায় গিয়েছে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে।
সংখ্যালঘু সংখ্যায় কম হলেও একটি দেশের রাজনৈতিক বিচারে তাদের অস্তিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যালঘুদের অত্যাচার করা, তাদের ঘরবাড়ি দখল করা, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা- এসব কাজ খুব সহজ মনে হলেও বিশ্ব দরবারে এর ক্ষতিকর দিকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্র ও সরকার যে কোনো দেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে আজকের বিশ্বে সেই সরকার ও রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সমাজের সমালোচনার সম্মুখীন হয়। বিশ্বায়নের যুগে আজ কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। তাই বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভের আশায় সংখ্যালঘুদের আস্থার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলামিস্ট
রাজনৈতিক দলে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব থাকুক আর নাই থাকুক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব দলেই সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে একটি রাজনীতি সব সময়ই চলেছে এবং এখনও আছে। জামায়াতের মতো দলেও সংখ্যালঘু ইস্যু নানাভাবে গবেষণার উপাদান হয়ে ওঠে। রাজনীতির মাঠে তাণ্ডব অথবা আলোড়ন সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করলে জামায়াত সবার আগে টার্গেট করে সংখ্যালঘুদের জানমাল আর মন্দিরকে। মন্দির ভেঙে দিয়ে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বিপদে ফেলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় জামায়াত। সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়লে জামায়াতের মতো মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর দু’দিক থেকে লাভ। প্রথমত, ভোটের হিসাবে যারা নিশ্চিত বিপক্ষে অবস্থান করবে, তারা দেশ ছাড়লে ভোটের হিসাবে লাভ হয়। দ্বিতীয়ত, হিন্দুরা দেশ ছাড়া মানেই বাড়িঘর-সম্পত্তি ছেড়ে যাওয়া। আর সেখানে বিনা অর্থে অথবা কম মূল্যে নতুন সম্পত্তি অর্জনের সুযোগ। সংখ্যালঘু ইস্যুতে উল্লিখিত দুটি সুবিধার সুযোগ যে শুধু জামায়াতের মতো কট্টর মৌলবাদী দলই গ্রহণ করছে তাই নয়, বরং এর সুবিধা নিয়েছে অন্যান্য দলও। এমনকি হিন্দুদের বাড়িঘর অবৈধভাবে দখল করার তালিকায় আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলেরও অনেকে আছে। কাজেই ঘুরেফিরে সংখ্যালঘুরা রাজনীতির সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব নিয়ে বসবাস করছে। সংখ্যালঘুদের এমন গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি যে শুধু বাংলাদেশেই রয়েছে তা নয়, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ইস্যুটি নানা দেশেই দৃশ্যমান। সংখ্যালঘুদের বিষয়ে বিশ্ব সমাজও সতর্ক ও সোচ্চার। তাই যখন ভারতের গুজরাটে সংখ্যালঘু মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছিল, তখন সারা বিশ্ব এর নিন্দায় সুর মিলিয়েছিল। গুজরাটের সংখ্যালঘু নিধনের হোতা মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ মোদি তাই আজও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মধ্যে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমার সফরে এসে সবার আগে সে দেশে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বাংলাদেশে যখন বিএনপি ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপকভাবে অত্যাচার করেছিল, তখনও বিশ্ব সমাজ তার নিন্দায় সোচ্চার ছিল।
হিন্দু হলেই যে কারও সঙ্গে ভারতের কাল্পনিক সম্পর্ক খুঁজে বেড়ানো একশ্রেণীর রাজনৈতিক দলের পুরনো অভ্যাস। এভাবে অপরাজনীতির চর্চা করে তারা দেশপ্রেমিক সংখ্যালঘুদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ করেছে বারবার। মনের কষ্টে সহায়-সম্পত্তি ত্যাগ করে অনেক সংখ্যালঘুই দেশ ছেড়েছে ইতিমধ্যে। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, অধিকতর শিক্ষিত ও সম্পদশালী সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশ ছেড়ে শুধু ভারতেই নয় বরং বেশি মাত্রায় গিয়েছে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে।
সংখ্যালঘু সংখ্যায় কম হলেও একটি দেশের রাজনৈতিক বিচারে তাদের অস্তিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যালঘুদের অত্যাচার করা, তাদের ঘরবাড়ি দখল করা, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা- এসব কাজ খুব সহজ মনে হলেও বিশ্ব দরবারে এর ক্ষতিকর দিকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্র ও সরকার যে কোনো দেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে আজকের বিশ্বে সেই সরকার ও রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সমাজের সমালোচনার সম্মুখীন হয়। বিশ্বায়নের যুগে আজ কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। তাই বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভের আশায় সংখ্যালঘুদের আস্থার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলামিস্ট
No comments