আন্দোলন কোথায়?

থাইল্যান্ডে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীদের দাবি প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রার পদত্যাগ। তিনি নাকি তাঁর দুর্নীতিবাজ ভাইকে বাঁচাতে পার্লামেন্টে আইন পাস করেছেন। আন্দোলন ঠেকাতে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। গত রোববার শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ এর পরও চলছে। রাস্তায় নেমেছেন আন্দোলনকারীরা। বেশ কিছু সরকারি মন্ত্রণালয় অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে চার দিন ধরে। এই বিক্ষোভে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। বিবিসি, সিএনএন ও আল-জাজিরার পর্দায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি। বাংলাদেশে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল মঙ্গলবার সকালে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৮+৬=১৪। এই দুর্ভাগাদের মধ্যে নারী-পুরুষ, বিরোধী-সরকারি, শ্রমজীবী মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। কীভাবে মারা গেলেন এঁরা? আগুনে পুড়ে, ককটেল হামলায়, গুলিতে, কোপাকুপিতে! এখানে আন্দোলন কোথায়? এসব তো দুর্বৃত্তদের কাজ। ফৌজদারি অপরাধ। সোমবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের ‘তফসিল’ ঘোষণার পর বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এর নাম ‘অবরোধ’।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ। ব্যস, বিরোধী দলের দায়িত্ব শেষ! আর দেশের মানুষের উদ্বেগের শুরু। অবরোধে গাড়ি চলবে তো? অবরোধ কি নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়? স্কুল খোলা থাকবে তো? দোকানপাটেরই বা কী হবে? হরতাল আর অবরোধের মধ্যে পার্থক্যটাই বা কী? কারও তরফে এর কোনো জবাব নেই। ভয়ে পরদিন গাড়ি বের করেননি অনেকে। অনেক স্কুল খোলা হয়েছে, আবার অনেক স্কুল ছিল বন্ধ। কেউ কেউ বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে গিয়ে ফেরত এসেছেন। কেউ সেই ঝুঁকিই নেননি কিন্তু স্কুল ছিল খোলা। একই পরিবারের দুটি শিশু—একজনের স্কুল ছিল খোলা, অন্যজনের বন্ধ! ‘অবরোধ’ নামের আন্দোলনটি এ দেশে নতুন নয়। এর আগে এ ধরনের কর্মসূচিগুলোর কিছু নির্দিষ্ট দিক ছিল। কোন কোন জায়গায় রাজপথ, রেলপথ বা নৌপথ অবরোধ হবে বা কোন নেতারা কোন কোন স্পটে থাকবেন, সেটাও বলা হতো। এখন এসবের কোনো বালাই নেই। সাংবাদিকদের ডেকে বলে দিলেই হলো কাল থেকে অবরোধ! এর কোনো ব্যাখ্যা, কর্মসূচির বিস্তারিত কিছু—এসবের দরকারই নেই। দরকার থাকবেই বা কেন, কর্মসূচি বলতে যা বোঝায় সে ধরনের কিছুতে তো আর আন্দোলন নেই। বলা হচ্ছে রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ, কিন্তু অবরোধকারী বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা কই? তাঁরা নিরাপদে বাসায় বসে কিছু দুর্বৃত্তকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন।
এই দুর্বৃত্তরা নিজেদের সুবিধামতো জায়গা বেছে নিয়ে বাস, গাড়ি ও সিএনজিতে আগুন দিচ্ছে, লোকজন পুড়িয়ে মারছে। ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, উপড়াচ্ছে রেলপথ। অবরোধ সফলের ভালো পথই বেছেছে বিরোধী দল! রাস্তায় বিরোধী দলের কেউ নেই, এর পরও এর নাম নাকি আন্দোলন! অবরোধ ডাকা হয়েছে কিন্তু অবরোধ করার কেউ নেই। বিরোধী দলের নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছেন সরকার তাঁদের মাঠে নামতে দিচ্ছে না, আটক করছে, জেলে ভরছে। ঘটনা সত্যি, কিন্তু জেল-জুলুমের এত ভয় থাকলে আন্দোলনের দরকার কী! নিজেরা ঘরে বসে থাকবেন আর দুর্বৃত্তরা মাথায় ককটেল ফুটিয়ে মারবে আনোয়ারা বেগমের মতো এক চতুর্থ শ্রেণীর ব্যাংক কর্মচারীকে! আগুনে পোড়ানো হবে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক সাবেদ আলীকে। রাস্তা অবরোধ করতে হলে তো রাস্তায় নামতে হবে। রেলগাড়ি থামাতে হলে রেলপথের ওপর শুয়ে পড়তে হবে। রাতের অন্ধকারে রেললাইনের নাটবল্টু খুলে ট্রেন ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু সেটা কি আন্দোলন হলো? ‘অবরোধ’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে সাংবাদিকেরা অনেক কষ্ট করে এর একটি ব্যাখ্যা বের করতে সক্ষম হলেন বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিএনপির এক নেতা। বলেছেন, হরতাল আর অবরোধের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো হরতালে সবকিছুই বন্ধ রাখা হয়।
যেমন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যান চলাচল, দোকানপাট, অফিস-আদালত—সব। কিন্তু অবরোধে শুধু যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। অর্থাৎ অবরোধ হলে ওই সড়কে যান চলাচল করতে পারবে না। নৌপথ ও রেলপথের ক্ষেত্রেও নাকি একই কথা প্রযোজ্য। বাহ, বেশ! যেদিন রাতে কর্মসূচি দেওয়া হলো তখনই কি এটা বলা যেত না? আর এই ব্যাখ্যাতে কি বিষয়টি পুরো পরিষ্কার হলো? অবরোধ হলে নাকি ‘শুধু যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়’। প্রতিবন্ধকতা তৈরির তেমন কোনো নমুনা তো আমার দেখলাম না। যা হলো তা তো বিভিন্ন স্থানে যানবাহনের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা, ককটেল ছোড়া, গাড়িতে আগুন দেওয়া। প্রতিবন্ধকতা বা অবরোধ হলো কোথায়? আর এই পরিস্থিতিতে নাকি স্কুল অবরোধের আওতামুক্ত! সত্যিই বড় এক তামাশা! যানবাহন চলবে না, চললে ককটেল পড়বে, আগুন দেওয়া হবে—বাচ্চারা স্কুলে যাবে কিসে করে? আমাদের দেশটা তো ইংল্যান্ড বা ইউরোপ হয়ে যায়নি যে বাচ্চারা নিজ নিজ এলাকার স্কুলেই পড়ে। ধানমন্ডির যে বাচ্চাটি উত্তরায় স্কুল করে তার যাওয়ার উপায় কী? আগে প্রতি হরতালের সময় পত্রিকায় ‘হরতালের আওতামুক্ত’ বলে একটি ঘোষণা থাকত। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এ নিয়ে একটি প্রেস রিলিজ দেওয়া হতো। এখন দলগুলো আর এর মধ্যে নেই। দলগুলো আর আন্দোলনে নেই। নিজেরা ঘরে বসে ‘আন্দোলন’ নামক কাজটি এখন সারা হচ্ছে দুর্বৃত্তদের দিয়ে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.