গণতান্ত্রিক উত্তরণ- সুশাসনের জন্যক্ষমতার ভারসাম্য জরুরি by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

একটি রাষ্ট্রের কিছু সার্বভৌম অধিকার আছে। ঐতিহ্যগতভাবে সেই অধিকারকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়—নির্বাহী ক্ষমতা, আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ও বিচারিক ক্ষমতা। এই তিন ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য পৃথক্করণের কথা বলা হয়েছে।
যেন কোনো একটি বিভাগ অতিরিক্ত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করে তুলতে না পারে। রাষ্ট্রক্ষমতার এই হরাইজন্টাল বা সমান্তরাল পৃথক্করণের পাশাপাশি ভার্টিকাল বা উলম্ব পৃথক্করণের কথা আলোচিত হচ্ছে। যেটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের শীর্ষবিন্দু থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রক্ষমতার এমন বিন্যাস করতে হবে, যেখানে স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিক কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়, উভয় সরকারের সুপরিচালনায় সমৃদ্ধ হতে পারে।
আমরা গত ৪১ বছরে স্বাধীনতা অর্জনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারকে অবহেলা করে এসেছি। নির্বাচিত লোকের দ্বারা স্থানীয় সরকার পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের নায়েব-গোমস্তা-মুৎসুদ্দীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ধারণা, স্থানীয় সরকার একটি বিজাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেই প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে দিলে অদক্ষ হস্তে দেশের অর্থের অপচয় ঘটবে। এমন কথা অতীতে ঔপনিবেশিক প্রভুরা এবং বর্তমান দাতাগোষ্ঠীরা প্রায়ই আকার-ইঙ্গিতে বলে থাকে। আমি একাধিকবার বলেছি, বাংলাদেশ যদি বহু উপনিবেশসংবলিত একটি সাম্রাজ্যের অধিকারী হতো, তবে সেই ক্ষমতাধরের কোনো অধীনস্থ উপনিবেশ স্বাধীনতার মুখদর্শন করতে পারত না।
প্রত্যেক সার্বভৌম রাষ্ট্রের কতগুলো বিশেষ অধিকার থাকে। আমি আপাতত একটি অধিকারের কথা উল্লেখ করতে চাই। যেহেতু অপরাধের মামলায় রাষ্ট্র প্রধান পক্ষ, রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে যেকোনো মামলা প্রত্যাহার করতে পারে। এই প্রত্যাহার করার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত, বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত বা কারণের জন্য ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। যখন এই ক্ষমতা ঢালাওভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারক্ষমতা ব্যাহত হয়।
অত্যধিক সুখের কথা এই যে, পৃথিবীর বুদ্ধিধর অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশ এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমের বহু দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। আমি ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করি না। হেনরি কিসিঞ্জার যখন বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন, তখনো আমি বিমর্ষ হইনি। সাম্প্রতিক আশাব্যঞ্জক কথায়ও আমি উল্লসিত হইনি। আমি জানি, এখন আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে অবাসযোগ্য শহরে বাস করছি। এই শহরকে যাঁরা তিলোত্তমা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা সুশাসনের কথা স্মরণে রাখেননি। তিলোত্তমা দূরের কথা, সামান্য সহনযোগ্য বাসভূমি গড়ে তুলতে সুশাসন এক অপরিহার্য উপাদান। এ ব্যাপারে প্রথমেই আমাদের প্রয়োজন সুদক্ষ প্রশাসন কর্মকর্তা। অনেকের মতে, আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র শতকরা ২০ ভাগ কর্মদক্ষ। ইদানীং খবরের কাগজের মারফত আমরা জানতে পারছি, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে বাইরে থেকে বা আউটসোর্সিং করে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় মৌখিক নম্বর নাকি ২০০ করা হয়েছে নিজেদের লোককে সাহায্য করার জন্য। আউটসোর্সিং করে প্রশাসনে কর্মকর্তা নিয়োগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধিকার ও দায়িত্বের সঙ্গে কি সামঞ্জস্যপূর্ণ?
আমি এখানে দু-একটি প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। আমার বলার উদ্দেশ্য সুশাসনের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কম্পট্রোলার জেনারেল, অ্যাটর্নি জেনারেল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশন সর্বোপরি বিচার বিভাগকে দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে না দিয়ে সুশাসনের কথা বড়ই ফাঁপা শোনাবে।
আজ সুজনের জাতীয় সম্মেলন ও দশম বর্ষপূর্তি উৎসবে এ কয়েকটি কথা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। সুজনের সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও সুজন ও প্রথমা প্রকাশনের উদ্যোগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ‘অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি’ শিরোনামে প্রকাশিত গ্রন্থে মুখবন্ধ লিখে দিই। এটি একটি তথ্যভান্ডার। এখানে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থীর হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য সংকলিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের ভাইস চেয়ারম্যানদের তথ্যসংবলিত আরও একটি বই শিগগিরই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এ কর্মপ্রয়াসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত।
সুজন একটি নির্দলীয় নাগরিক উদ্যোগ। সচেতন নাগরিকদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সুজন দীর্ঘদিন যাবৎ গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে আসছে। বিশেষত নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুজনের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া ও ইতিবাচক ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সুজন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য আলোচনা এবং নির্বাচনী অলিম্পিয়াড, নির্বাচনী বিতর্ক, গণতন্ত্র অলিম্পিয়াড ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সূচনা করে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সংস্কারের লক্ষ্যে কতগুলো সুদূরপ্রসারী প্রস্তাব উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সুজন বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করার উদ্যোগ নেয়, যাতে তারা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। বস্তুত প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য জানার অধিকার সুজন-এর প্রচেষ্টায় ও আদালতের নির্দেশনায় নির্বাচনী আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়।
আজ আমি সুজনের সাবেক সভাপতি মরহুম ড. মোজাফ্ফর আহমদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমি তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আমার একটি প্রকাশিতব্য বই তাঁকে উৎসর্গ করেছি। আমি জানি পরিবারের সদস্যদের মতো আপনারাও তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত। তাঁর পরিবারের সব সদস্য ও আপনাদের সমবেদনা জানাই।
আমি মনে করি, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সংস্কারের পাশাপাশি এসব কার্যক্রম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সুজনের দশম বর্ষপূর্তি ও সম্মেলন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্য
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।

No comments

Powered by Blogger.