বাড়িভাড়া বৃদ্ধিজনিত অসহায় জীবনের পাঁচালি by আশরাফুল আযম খান

বছর শেষ হওয়ায় নতুন করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বাড়িওয়ালারা ভাড়া বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে বলে আবারও খবর বেরিয়েছে। নগরবাসীর আশঙ্কা, এ বিষয়ে সরকার সময়োচিত কোনো পদক্ষেপ না নিলে অন্য বছরের মতোই বাড়ির মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার বলি হতে হবে তাদের।
বাড়িভাড়া বৃদ্ধিজনিত অসহায় জীবনের পাঁচালি পত্রিকায় বারবার প্রকাশিত হলেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে সাধারণ মানুষ একই সঙ্গে বিক্ষুব্ধও। কিন্তু তা সত্ত্বেও করার কিছু নেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে দ্রব্যমূল্য, বাসাভাড়া ও জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজধানীর একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে আট হাজার টাকা। নিত্যপণ্যের কথা বাদ দিলেও পোশাকের দাম বৃদ্ধি, সন্তানের শিক্ষা উপকরণ, স্কুলে নেওয়ার ব্যয়, সাবান, প্রসাধনী, দৈনন্দিন কাঁচাবাজার হিসেবে সবজি, প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয়সহ নানাভাবে খরচ বেড়েছে। তাদের দিনযাপন দিন দিন মারাত্মক সংকটের মধ্যে পড়ছে। এক দশক আগে জীবননির্বাহের পর সামান্য সঞ্চয় করতে পারলেও এখন সঞ্চয় তো দূরের কথা, ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের আওতাধীন নগর গবেষণা কেন্দ্রের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার ৭০ শতাংশ মানুষ উপার্জনের ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে বাড়িভাড়া বাবদ। ফলে বাকি ৪০ শতাংশ দিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ব্যয় নির্বাহ করতে প্রতিনিয়তই খাটো হয়ে আসছে প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা। এতে পুষ্টি যেমন বিঘি্নত হচ্ছে, তেমন বাড়ছে সংসারের টানাপড়েন। কম খেয়ে বাজার খরচ কমানো গেলেও বাসাভাড়া কমানোর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
বাড়িভাড়া যন্ত্রণার সবচেয়ে করুণ শিকার হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প-কারখানার শ্রমিক ও নগরের নিম্নবিত্ত মানুষ। ডিসিসির বস্তি উন্নয়ন বিভাগের সূত্র মতে, তাদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। যা নগরের মোট জনসংখ্যার ৩৩.৩৩ শতাংশ। বছর দশেক আগে শ্রমিকরা অনেকে মিলে আধাপাকা বাসায় থাকতে পারত। এখন নগরের শেষ মাথায় উপার্জিত আয়ে টিনশেডের বাসা ভাড়া পাওয়াও তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসাভাড়ার অতিরিক্ত খরচ সামলাতে গিয়ে এক সময় যেসব এলাকায় নিম্নবিত্তরা বসবাস করত, সেখানে চলে গেছে মধ্যবিত্তরা। আর নিম্নবিত্তরা সরে গেছে শহরের আরো প্রান্তে অথবা বস্তি এলাকায়।
১৯৯১ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একটি আইন প্রণীত হলেও এ আইনের কোনোরূপ তোয়াক্কা করছে না কোনো বাড়িওয়ালা। ভাড়া নির্ধারণ ও ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব আইনকানুনের ধার ধারছে না কেউ। কাজির গরু গোয়ালে না থাকলেও কিতাবে আছে। বাস্তবতা এই- জামানত ছাড়া কোনো বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না। ছয় মাস বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছরের অগ্রিমও দাবি করা হয় ভাড়াটিয়ার কাছে। মাস শেষে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি বিল তো আছেই। ভাড়াটিয়াদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে সার্ভিস চার্জ, দারোয়ান, নাইট গার্ড, লিফটের বিল, সিঁড়ি পরিষ্কার ইত্যাদি অসংখ্য খাতে নিত্যনতুন কৌশলে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এমন অনেক বাসা রয়েছে যেখানে গ্যাস সুবিধা নেই, পানির সরবরাহ লাইন নেই- তা সত্ত্বেও ভাড়ার কমতি নেই। সেখানেও মর্জিমাফিক ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। লিখিত চুক্তি তো দূরের কথা- বেশির ভাগ বাড়ির মালিক বাড়িভাড়ার রসিদও প্রদান করছে না। রাত ১১টার পর প্রধান দরজা বন্ধ করা নিয়ে চলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার মধ্যে বচসা। মাসের ভাড়া ১ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে দিতে না পারলে মালিকের বিভিন্ন অশোভন কথা এবং আচরণের মুখোমুখি হতে হয় ভাড়াটিয়াদের। বেশি মেহমান আসা বড়িওয়ালাদের পছন্দ নয়। ছাদে উঠতে মানা। বাসায় উচ্চ স্বরে কথা বলা যাবে না। একটু জোরে গান শুনলেও কৈফিয়ত খুঁজে বাড়িওয়ালারা। ট্যাক্স অফিসের লোকজন এলে ভাড়া কম বলতে হবে- এমন অনৈতিক নির্দেশনা দিতে দ্বিধা করে না। কিছু বললে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়। নতুন ভাড়াটিয়া এলে বাড়ানো হয় আরেক দফা ভাড়া। দুঃখের বিষয়, সরকার বা প্রশাসনের নাকের ডগায় এত কিছু হলেও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে সরকার কোনো ভূমিকা রাখছে না। ২০১০ সালের মে মাসে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদ, আইন মন্ত্রণালয় ও মেয়রকে জবাব দেওয়ার জন্য চার সপ্তাহ সময় বেঁধে দিলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ডিসিসির উদ্যোগে ২০০৭ সালে ঢাকা সিটিকে ১০টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বলে আমরা জানি।
গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের রক্ষাকবচ। ভাড়াটিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুবিচার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা গণতান্ত্রিক সরকারের অন্যতম কাজ। আইন আছে কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন না হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনকে কার্যকর করতে হবে, প্রয়োজনে আইনটি সংশোধন করে যুগোপযোগী ও ভাড়াটিয়াবান্ধব করতে হবে। কোন এলাকায় কত বাড়িভাড়া হবে সেটি নির্ধারণ করতে হবে এবং সেটি যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে অভিযান চালানো উচিত। এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র স্থায়ী কমিশন গঠন করা যেতে পারে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইনে বাড়িভাড়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি- এটি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সম্প্রতি গঠিত জাতীয় ভোক্তা অধিকার কমিশন এ সমস্যা নিয়ে কাজ করতে পারে। যেকোনোভাবেই হোক অর্থলোভী বাড়িওয়ালাদের স্বার্থের নিষ্ঠুর গ্রাস থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তকে রক্ষা করতে হবে। বাড়িভাড়া যেন আতঙ্কের কারণ না হয় সেই সুরক্ষা আইনও সরকারের কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে। প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে আমরা আর কত দিন চলব?
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ

No comments

Powered by Blogger.