অস্বীকার পুলিশেরঃ অবহেলায় মৃত্যু ‘ভারতকন্যা’র! by হুসাইন আজাদ

প্রায় একঘণ্টা রক্তাক্ত ও বিবস্ত্র হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলেও পথচারী কিংবা পুলিশ কেউই এগিয়ে আসেনি দিল্লির ধর্ষিতা সেই ‘ভারতকন্যা’ ও তার বন্ধুর সহায়তায়!
শুক্রবার ভারতের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল জি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মনুষ্যত্ববোধের এমন অধঃপতনের কথাই সখেদে প্রকাশ করলেন নয়াদিল্লির বাসে গণধর্ষণের শিকার ‘ভারতকন্যা’র বন্ধু অরুণ (ছদ্মনাম)!
চ্যানেলটির কাছে দেওয়া সাক্ষাতকারের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সামনে এই প্রথম মুখ খুললেন সেই জঘণ্য নৃশংসতার অন্যতম শিকার অরুণ।

মানবরূপী দানবদের পাশবিক লিপ্সা চরিতার্থ করতে বাধা দেওয়ায় নির্মমভাবে মারধর করে অরুণকে অজ্ঞান করে ফেলে দুর্বৃত্তরা। শুধু তাই নয় বেহুঁশ মৃতপ্রায় ওই তরুণী ও তার বন্ধুকে বাস থেকে চলন্ত অবস্থাতেই ছুঁড়ে ফেলে ওই পাষণ্ডরা।

অরুণের ভাষায়, “ওরা আমাদের বাসের চাকায় পিষ্ট করে মারতে চেয়েছিলো।”

বাস থেকে ফেলে দেওয়ার পরও প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে কাঁতরাতে থাকেন তারা। কিন্তু এক পলকের জন্যও পাশ কাটিয়ে চলা পথচারীরা তাদের দিকে ভ্রক্ষেপ করেনি, কেউই তাদের গাড়ি থামিয়ে বাড়িয়ে দেয়নি সাহায্যের হাত।

অরুণ বলেন, “ওই সময় অনেক অটোরিকশা, গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। সাহায্য করার জন্য তখন আমি চিৎকার করছিলাম। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তখন কেউই আমাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি।”

মারাত্মক আহত হওয়া অরুণ ক্ষোভ ভরে বলেন, “এ সময় কিছু লোক জড়ো হয়েছিলো সত্যি, কিন্তু কেউই আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেনি।”

তরুণীর বন্ধু অরুণ বলেন, “যখন পুলিশ আমাদের কাছে পৌঁছালো তখন আমি তাদের বলছিলাম ‘কিছু পোশাক দিন!’ কিন্তু কোন থানায় আমাদের মামলাটি লিপিবদ্ধ করা হবে তা নিয়েই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তারা।”

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ‘ভারতকন্যা’ মারা যান এমন বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে অরুণ জানান, “বিতর্ক করে শেষ পর্যন্ত প্রায় দেড়ঘণ্টা পর হাসপাতালে নেয়া হয় আমাদের।”

সাক্ষাৎকারে অরুণ বলেন, “মানুষের ধারণার অতীত ছিলো ওই ভয়ংকর আক্রমণ, আমি তা বলে বোঝাতে পারব না...পশুরাও এমন আচরণ করতে পারে না।”

‘ভারতকন্যার’ বন্ধুর অভিযোগ অস্বীকার পুলিশের

‘পুলিশের অবহেলা ও সময়ক্ষেপণের কারণেই ‘ভারতকন্যা’র রক্তক্ষরণ বেশি ঘটেছে। এ কারণে, সংগ্রামী তরুণী শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি।’

অরুণের এমন বক্তব্য অস্বীকার করে নিজেদের  যুক্তি উপস্থাপন করেছে পুলিশ।

একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে দিল্লি পুলিশ জানায়, “রাস্তার ধারে দু’জন রক্তাক্ত পড়ে রয়েছে এ মর্মে রাত ১০:২২ মিনিটে প্রথম কল পায় স্থানীয় পুলিশের কন্ট্রোল রুম।”
বিবৃতি দাবি করা হয়, কল পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশের ভ্যান ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তারপর মাত্র ৩৩ মিনিটের মধ্যেই আহত দু’জনকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়ে পুলিশ জানায়, ১০:২২:২২ টায় পুলিশ প্রথম কল পায় এবং তারপরই ‘জেড-৫৪’ নামক ভ্যানটি ঘটনাস্থলে পৌঁছে।

অন্যদিকে, ‘ই-৪২’ নামক আরেকটি ভ্যান ঘটনাস্থলে পৌঁছে চার মিনিটের মধ্যে ১০:২৬ মিনিটে। আর জেড-৫৪ ভ্যানটি পৌঁছে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ১০:২৮ মিনিটে। আর এই ভ্যানটি আহতদের নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যে ১০:৩১ মিনিটে। আর এটি সফদারজং হাসপাতালে পৌঁছে মাত্র ২৪ মিনিটের মধ্যে ১০:৫৫ মিনিটে। (এ সবই আন্তর্জাতিক সময় হিসেব অনুযায়ী)।

তবে, গণধর্ষণের সময় পাঁচটি চেকপোস্টের মধ্যে কয়েকবার চক্কর দিলেও কেন পুলিশ গাড়িটিকে আটক করেনি সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি বিবৃতিতে।

সোমবারের জন্য সমন জারি

বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত ৫ জনের বিরুদ্ধে সাকেত মহানগর আদালতে ১ হাজার পৃষ্ঠা অভিযোগপত্র দায়ের করা হলে আদালত শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন শনিবার।

প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালত অভিযুক্ত পাঁচজনকে ‍আগামী সোমবার (০৭ ‍জানুয়ারি) আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন।

অন্যদিকে, অভিযুক্ত ষষ্ঠ ব্যক্তি কিশোর হওয়ায় তাকে কিশোর বিচার আইনের মুখোমুখি করা হবে বলে জানায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ।

‘ধর্ষণের রাজধানী’ খ্যাত নয়াদিল্লিতে গত ১৬ ডিসেম্বর ৬ পাষণ্ডের পাশবিকতার শিকার হন ‘ভারত কন্যা’, ‘দামিনী’ ও ‘আমানত’ প্রভৃতি ছদ্মনামে অভিহিত হওয়া ওই তরুণী।

সেদিন সন্ধ্যায় সিনেমা দেখে বাসায় ফেরার পথে পাষণ্ডরা ‘ভারতকন্যা’ ও তার ছেলে বন্ধুর উপর বর্বর নির্যাতন চালায়।

দু’সপ্তাহ বাঁচার লড়াই চালিয়ে অবশেষে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মেয়েটি।

এ বর্বর ঘটনার প্রতিবাদে ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। নরপিশাচদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান বিক্ষোভকারীরা।

ঐ পৈশাচিক ঘটনায় অভিযুক্ত ৫ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রায় ১ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে। বয়সে কিশোর হওয়ায় হত্যা ও ধর্ষণ মামলা থেকে বাদ পড়ে ষষ্ঠ ব্যক্তি।

No comments

Powered by Blogger.