একজন কমিউনিস্টের বিদায়

বাবা তাকে লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন আইসিএস হওয়ার জন্য। লন্ডনে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। তবে আইসিএস হননি। ব্যারিস্টারি পাস করেন। আর ভারতে ফিরে আসেন একজন পুরোদস্তুর কমিউনিস্টকর্মী হিসেবে।
এই কমিউনিস্টকর্মী জ্যোতি বসুর জীবনাবসান হয়েছে রোববার বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টায়। মৃতু্যর আগে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। এই ৯৫ বছর বয়স অবধি তিনি একজন কমিউনিস্টই ছিলেন। বিচু্যতি ঘটেনি তার নীতি থেকে। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগও তিনি গ্রহণ করেননি, দল ও আদর্শের বাইরে গিয়ে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রানত্মে ভারতসহ গোটা পৃথিবীতে শিৰিত এক শ্রেণীর তরম্নণের ভেতর কমিউনিস্ট আদর্শ গ্রহণ করার একটি জোয়ার এসেছিল। জ্যোতি বসু সেই জোয়ারের সনত্মান। কিন্তু হাজার হাজার কমিউনিস্টটের সঙ্গে জ্যোতি বসুর পার্থক্য হলো, তার জীবনে কমিউনিজম নিয়ে কোন ভাটার টান আসেনি। বরং পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি কমিউনিজমকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ভারতে কমিনিউজমকে এগিয়ে নেওয়ার ৰেত্রে যে পথ ও পন্থা গ্রহণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি জ্যোতি বসু। তবে একজন প্রকৃত কমিউনিস্টের যে কাজ সেটাই তিনি করেছিলেন। দলের সিদ্ধানত্ম থেকে সরে আসেননি। সেজন্য স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে তাকে সহ্য করতে হয়েছিল এক চরম দুর্বিষহ জেল-জুলুম এবং পলাতক জীবন। একটা সময়ে এসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই সিদ্ধানত্ম থেকে সরে আসে। সেখানে এ নিয়ে নানান উত্থান পতন হয়। এরপর ধীরে ধীরে পশ্চিমবাংলার কমিউনিস্ট আদর্শের মূল ধারা গড়ে তোলেন জ্যোতি বসু। এবং ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিনি হয়ে উঠতে থাকেন মূলধারার রাজনীতিক। এই মূলধারার রাজনীতিক হয়ে ওঠার পথে জ্যোতি বসুকে দুই দিকে সমানতালে পা ফেলতে হয়েছিল। এক, কমিনিস্ট সংগঠন ও আদর্শের বিসত্মারের রাজনীতিতে অন্যদিকে পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে। লন্ডন থেকে ফিরে তরম্নণ কমিউনিস্টকর্মী জ্যোতি বসু রেল শ্রমিক ইউনিয়নে পার্টির কাজ করা শুরম্ন করেন। আর সেখান থেকেই তিনি নির্বাচিত হন পার্লামেন্ট মেম্বার। তরম্নণ এই নেতা শুরম্নতেই ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদদের মতো ঝানু নেতাদের ভেতর একজন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। এর পরে যখন তিনি তার দলকে পার্লামেন্টারিয়ান রাজনীতিতে একশ ভাগ নিয়ে আসেন তখন তিনি এখন অনেক উঁচু মাপের পার্লামেন্টারিয়ান এবং এই পার্লামেন্টারি রাজনীতির সমঝোতা তিনি নিয়ে আসেন পার্লামেন্টের বাইরেও। গড়ে তোলেন সমঝোতার রাজনীতি। যার প্রকাশ বামফ্রন্ট। যে ফ্রন্টকে নিয়ে জ্যোতি বসু নিজেই পশ্চিমবঙ্গে ২২ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এবং ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের একক নেতা এবং ভারতের অন্যতম নেতা।
জ্যোতি বসুর ২২ বছরের ৰমতাকাল হয়তো তার মৃতু্যর পরে বিচার-বিশেস্নষণ হবে। সেখানে তার সাফল্য ও ব্যর্থতার পালস্না হিসাব করা হবে। এই ব্যর্থতার পালস্নায় পড়বে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন ও শিল্পনির্ভর অর্থনীতি। তিনি সেৰেত্রে সফল হতে পারেননি। এর জন্য তিনি কতটা ব্যর্থ এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় অসহযোগিতা কতটা দায়ী সেটা বিচারের দাবি রাখে। তবে তার পরেও যুগানত্মকারী সাফল্য তিনি রেখে গেছেন। যেমন ভারতসহ এই উপমহাদেশের সব থেকে জটিল সমস্যা ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি বণ্টন। জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গে সেৰেত্রে সফল হন। তিনি সফল হন পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারের ব্যাপ্তিকে বাড়ানোর সঠিক পথ শক্তিশালী লোকাল গর্বনমেন্ট গঠন করতে। তার পঞ্চায়তে প্রথা পৃথিবীর জন্য উদাহরণ। এছাড়া তিনি জাত পাতে ভরা ভারতের একটি রাজ্যে পারিবারিক আইন অনেক ৰেত্রে আধুনিক করতে সমর্থ হন। সর্বোপরি তার নেতৃত্বে পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গই ভারতের একমাত্র রাজ্য যেটা গত তিন দশক সামপ্রদায়িক দাঙ্গা মুক্ত। এভাবে তার সাফল্যর পালস্নাকে অনেক দীর্ঘ করা করা যাবে। এমনকি আজ ভারত যে প্রতিবেশীর সঙ্গে সহানুভূতিশীল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে চলেছে এর শুরম্নও জ্যোতি বসুদের হাত ধরে। তাদের নেতৃত্বাধীন গুজরাল সরকার, দেবে গৌড়া সরকার আমলে এর শুরম্ন। আর সামপ্রতিককালে জ্যোতি বসুর সব থেকে বড় অবদান যে কোন মূল্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে ভারত থেকে জ্যোতি বসুর ভাষায় বর্বর বিজেপির শাসনের অবসান ঘটানো। বলা যেতে পারে ভারতসহ উপমহাদেশকে এক চরম ৰতির হাত থেকে রৰা করে গেছেন এই নেতা তার জীবনের শেষ প্রানত্মের দৃঢ় ভূমিকার দ্বারা।
তাই যদিও তিনি ছিলেন ভারতের একটি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তারপরেও তার মৃতু্যতে উপমহাদেশ হারালো একজন প্রকৃত রাজনীতিককে। আর রাজনৈতিক ইতিহাস হারালো একজন কমিউনিস্টকে। তাই পরিণত বয়েসে তার মৃতু্য হলেও এ মৃতু্য অনেক বেদনার। এ বেদনা বাংলাদেশকে একটু বাড়তি ছুঁয়ে যায় কারণ, তিনি এই ঢাকার নারায়ণগঞ্জের বারম্নদী গ্রামের সনত্মান। তাছাড়া তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু।

No comments

Powered by Blogger.