হাইতি ট্র্যাজেডি আমাদের সতকতর্ by নিয়ামত হোসেন

হাইতির মহাদুর্যোগ চমকে দিয়েছে সবাইকে। চোখের পলকে কী এক ভয়াবহ বিপর্যয় সেখানে নেমে এসে নিমেষে সবকিছু ল-ভ- করে দিয়ে গেছে। রাজধানী নগরীর কিছুই যেন এখন আর নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে বদলে গেছে।
ঘরবাড়ি থেকে শুরম্ন করে মানুষের গড়ে তোলা সবকিছু ধুলিস্যাত হয়ে গেছে। মানুষের বাড়ি হাসপাতাল, দেশের প্রেসিডেন্টের বাসভবনসহ প্রায় সবকিছু মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। ৫০ হাজার থেকে এক লাখ লোক মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উদ্ধার করার মতো লোকের প্রচ- অভাব। যন্ত্রপাতি নেই। এ ধরনের বিপর্যয় এলে কীভাবে সবকিছু সামলাতে হবে তার কোন ব্যবস্থাও সে দেশের নেই। অনেক মানুষকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। অনেক লাশও উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সেগুলোর সংখ্যা সামান্যই। চাপা-পড়াদের বহুজনকেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেই ব্যবস্থা, সেই লোকবল, যন্ত্রপাতি কিছুই ওদের নেই। তাই দ্রম্নত উদ্ধার করতে পারলে যে মানুষগুলো বেঁচে যেত, উদ্ধার না পাওয়ায় তারা যে আর বেঁচে নেই সেটা ধারণা করা যায়। লাশও বহু চাপা পড়ে আছে ধ্বংসসত্মূপের ভেতর। উদ্ধার না হওয়ায় এখন দুর্গন্ধ চতুর্দিকে। পরিবেশ হয়ে উঠেছে মারাত্মক ধরনের অস্বাস্থ্যকর। যারা বেঁচে আছে তাদেরও রয়েছে বহু সমস্যা। প্রথমত খাদ্য নেই পর্যাপ্ত। খাদ্য ভা-ার লুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষজনের থাকার জায়গা নেই। এমনি মহা দুর্যোগ, মহা দুর্বিপাকের মধ্যে পড়েছে হাইতির মানুষ। তাদের এই অবর্ণনীয় দুর্যোগে বিশ্বের মানুষ সহানুভূতি জানিয়েছে।
ভূমিকম্প অল্প কিছু কালের মধ্যে অনেক দেশে হয়ে গেল। ইরান, ভারত, পাকিসত্মান, ইন্দোনেশিয়ায়। ২০০৮ সালে চীনের সিচুয়ানের ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল ৮৭ হাজার মানুষ। ২০০৫-এ পাকিসত্মানে ভূমিকম্পে ৭৫ হাজার মানুষ, ইরানে ২০০৩-এর ভূমিকম্পে ৩১ হাজার লোক মারা যায়, ২০০১-এ ভারতের গুজরাটের ভূমিকম্পে মারা যায় ২৫ হাজার মানুষ। এসব সাম্প্রতিক সময়ের ভূমিকম্প। এর আগেও অনেক বড় ভূমিকম্প হয়েছে নানা দেশে। ছোট আকারের ভূমিকম্প বহু দেশেই হয়। আমাদের দেশেও মাঝেমধ্যেই হয়েছে ছোট আকারে অনেক ভূমিকম্প। বড় আকারের ভূমিকম্প আমাদের দেশে হয়েছে, তবে বেশ কিছুকাল আগে। সেসব ভূমিকম্প ৰতি হয়ে যায় অনেক। লোকসংখ্যা অতীতে অত বেশি ছিল না, তাই মৃতু্যর সংখ্যা বেশি ছিল না, কিন্তু ভূমিকম্প এমন প্রচ- ছিল যার জন্য ভূমিতেই তোলপাড় হয়ে গেছে। ভূমিকম্পের ধাক্কায় আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদের চেহারা বা স্থান পাল্টে যায় এক সময়।
ভূমিকম্প একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ঝড়, ঝঞ্ঝা, হ্যারিকেন, সাইকোন, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি অর্থাৎ সমুদ্রের তলায় হওয়া ভূমিকম্প_ এমন কত ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে, যেগুলো প্রায়ই আঘাত হানছে কোন না কোন দেশকে। এসবের কোন কোনটি আমাদের দেশেও আঘাত হেনেছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস টর্নেডো এক সময় এদেশে এমন বিপুল ৰতি করেছে যেগুলো এখন ইতিহাসের বেদনাদায়ক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। এখন অবশ্য ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি আবহাওয়াগত দুর্যোগের পূর্বাভাসদান সহজ হয়ে গেছে। সে জন্য এখন সাবধানতার কারণে ওসবে প্রাণহানি ও ৰতির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। তবে সম্পদের ৰতির পরিমাণ এখনও কম নয়। এসব দুর্যোগ মাঝেমধ্যেই আমাদের দেশে আঘাত হানছে। সাম্প্রতিক আমলে সিডর, আইলা ইত্যাদি দুর্যোগে আমাদের যে ৰতি হয়েছে তার তুলনা হয় না।
ভূমিকম্পের ব্যাপারে সমস্যা হচ্ছে এর তেমন নিখুঁত পূর্বাভাস দেয়া এখনও সম্ভব হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করেছেন। বিভিন্ন ভূমিকম্প পর্যালোচনা করে তারা নানা হিসাবনিকাশের মাধ্যমে সম্ভাব্য ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারেন। সেসব পূর্বাভাসে কবে কখন ভূমিকম্প হবে এমন দিন-তারিখ বলা সম্ভব না হলেও এক সময় যে হবে সে ধরনের সম্ভাবনার কথা বলা যায়। অনেক ৰেত্রে দেখা যাচ্ছে সেগুলোর পূর্বাভাস বাসত্মবে মিলে যাচ্ছে। হাইতির এই যে ভূমিকম্প সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এরকমই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ২০০৮ সালে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে হাইতিতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আঘাত আসতে পারে। তাদের সে পূর্বাভাসের সম্ভাবনা খানিকটা দেরিতে হলেও এবার হাইতিতে দেখা গেল সেটা ঘটে গেল। বিজ্ঞানীরা দেশে দেশে ভূমিকম্প নিয়ে নিরনত্মর গবেষণা করছেন। দিন দিন নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এসব গবেষণার ৰেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে। আশা করা যায়, হয়তো একদিন নিখুঁতভাবে ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া বিজ্ঞানীদের পৰে সম্ভব হবে।
ভূমিকম্পের পূর্বভাসের ব্যাপারে মানুষ অতীতে তেমন কিছুই জানত না বললেই চলে। তবে শোনা যায় কোন কোন প্রাণী নাকি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বুঝতে পারে। বলা হয়, আফ্রিকার এক ধরনের মাছ নাকি ভূমিকম্প হবে এমনটা আগে থেকে টের পায়। কেউ কেউ বলেন, ঘোড়াও নাকি এটা টের পায়। ঘোড়াগুলো ভূমিকম্পের আভাস বুঝতে পারলে নাকি চিঁহি চিঁহি করে। এমনি আরও অনেক কথা শোনা যায়। এগুলোর কতটুকু সত্যি, কতটুকু নয়, সেটা বলা মুশকিল। তবে আধুনিক বিজ্ঞান যেটা বলছে সেটাকেই ঠিক বলে মানুষ মনে করে। কারণ বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে যা কিছুই করেন বা বলেন সেুগলো পরীৰা-নিরীৰা তথা গবেষণার মাধ্যমেই অর্জিত জ্ঞান থেকেই বলেন বা করেন। ভূমিকম্পের গবেষণার ব্যাপারে বিজ্ঞান অনেকখানি যে এগিয়েছে সেটা এখনই বলা যায়, ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক অগ্রগতি হবে এই ৰেত্রটিতে। মানুষ আছে তারই প্রতিৰাতে।
ভূমিকম্প রোধ করা সম্ভব নয়। ভূমিকম্পের ফলে যে ৰতির সম্ভাবনা থাকে সেই ৰতি রোধ করা সম্ভব। সে জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সতর্কতা বা সাবধানতা। ঠিকমতো ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ভূমিকম্পের ৰতি এড়ানো সম্ভব। সেই ব্যবস্থাটাই সবার জন্য, সব দেশের জন্য জরম্নরী।
আমাদের দেশটিও ভূমিকম্পের সম্ভাবনার বাইরে নয়। একাধিক বড় ভূমিকম্প এদেশে হয়ে গেছে অতীতে। এখন যেহেতু লোক সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে এবং বাস ভবনসহ অন্যান্য ভবন ব্যাপকভাবে ঢাকাসহ দেশের নানা এলাকায় গড়ে উঠেছে তাই এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে জরম্নরী হচ্ছে সাবধান হওয়া, সতর্ক হওয়া। আমাদের নগরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভবন তথা বিল্ডিং তৈরি হয়েছে ঢাকা নগরীতে। এগুলোর কিছু অনেক দৃঢ় তথা মজবুত সন্দেহ নেই। মজবুত, দৃঢ় অর্থাৎ ভূমিকম্প রোধ করতে সৰম। তবে ভূমিকম্প রোধে সৰম ভবনের সংখ্যা খুব বেশি নয়। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সেটা রোধ করার মতো ভবনের সংখ্যা খুবই কম। হাইতিতে ভূমিকম্প হয়েছে সাত দশমিক দুই মাত্রার। এই মাত্রাটি অধিকমাত্রার তো বটেই। এতেই সেখানকার ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে এক মুহূর্ত। সেখানে এখন রীতিমতো মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ধার কাজে সমস্যা, খাদ্য নেই, আশ্রয় নেই, পর্যাপ্ত চিকিৎসা নেই। সাত দশমিক দুই মাত্রার কম্পন যেন ভয়াবহ ধরনের তোলপাড় সৃষ্টি করে গেছে ঐ দ্বীপ দেশটির মানুষের জীবনে।
আমাদের দেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির বাইরে নয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দেশের অভ্যনত্মরে চারটি চু্যতি রেখা সক্রিয় রয়েছে সেগুলো থেকে কখনও হয়ত বড় ধরনের কম্পনের সৃষ্টি হতেও পারে, এ আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত ১ বছর দেশে অর্ধ শতাধিক ভূমিকম্প হয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগের উৎপত্তিস্থল দেশের বাইরে অনেক দূরে এবং কম্পনের মাত্রাও অনেক কম। তবে দূর উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা কখনও ৬ বা ৭-এর বেশি হলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে দেশ। বহুতল ভবনের ওপর প্রভাব পড়তে পারে এর। আর দেশের কাছাকাছি বা ভেতরে যদি ঐ একই উচ্চ ৰমতার ভূমিকম্প কোনদিন হয় তাহলে স্বল্প উচ্চতার ভবনের ৰতির সম্ভাবনা বেশি। বিশেষজ্ঞরা এমনই আশঙ্কা করেন।
যাই হোক, কবে হবে, কখন হবে, আদৌ হবে কি হবে না_ এসব দুশ্চিনত্মা না করে আমাদের একটি কাজই করা দরকার_ যতদূর সম্ভব সাবধান হওয়া, সতর্ক হওয়া।
যদি বড় ধরনের কোন কম্পন কখনও না হয়, তাহলে তো খুব আনন্দের কথা, কিন্তু বড়, ছোট বা মাঝারি, যে কোন মাত্রার কম্পন যদি কখনও আমাদের দেশে হয় তাহলে যাতে কোন ৰতি না হয় সে ব্যাপারে যতদূর সম্ভব সাবধান থাকতে হবে। সর্বপ্রথম কথা হচ্ছে, এটাকে স্বাভাবিক বলে মনে রাখতে হবে, ভয় বা আতঙ্কের কোন কারণ নেই। ঝড়, টর্নেডোকে আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে সতর্ক হই। এটাকেও তেমন মনে করতে হবে। ভূমিকম্প শীঘ্রই হবে না দেরি করে হবে_ এসব বিষয় বলবেন বিজ্ঞানীরা। আমাদের উচিত সাবধান হয়ে থাকা। হঠাৎ যদি কখনও কম্পন আঘাত হানে তাহলে আতঙ্কিত না হয়ে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে হবে এবং সেজন্য সকল ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। রান্নার চুলো বিনা প্রয়োজনে জ্বালিয়ে না রেখে কাজ হয়ে গেলে বন্ধ করে রাখা দরকার। সংশিস্নষ্ট কর্তৃপৰেরও উচিত ভূমিকম্পের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন_ ভূমিকম্পের পরিস্থিতিতে যাতে গ্যাস লাইন কোন এলাকায় অতি দ্রম্নত বন্ধ করা যায় সে ব্যবস্থা করে রাখা, যাতে লাইনের ৰতি হলেও দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। রাজধানীতে বাড়ি তৈরির কাজ দেখা যাদের দায়িত্ব তাদের শুধু ভূমিকম্পের ব্যাপারে লিখিতভাবে কোন নির্দেশ বা নিয়ম বেঁধে দিলে চলবে না, সেটা ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে। সরকারকে সতর্কতামূলক সকল কাজের সমন্বয় দেখতে হবে। হাইতির ট্র্যাজেডি বিশ্বকে নাড়া দিয়ে গেছে। কোথাও যাতে এ বিপর্যয় আর না ঘটে সে প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গে সকলকেই সতর্ক থাকতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে বিশেষ করে আমাদের মতো ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র দেশের মানুষকে।

No comments

Powered by Blogger.