মুক্তিযুদ্ধের মর্মচেরা গাথা by আখতার হুসেন

কাহিনির পটভূমি রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে জয়দেবপুরের অদূরবর্তী ব্রহ্মডাঙ্গা ও তার আশপাশের পাঁচটি গ্রাম বা জনপদ। এখানে ‘দু-চার পাঁচটা বাদ দিলে মাঝারি গোছের সচ্ছল পরিবার খুব একটা নেই।’ কাহিনির কেন্দ্রে আছে ‘বাতিঘরের’ মতো সেই ব্রহ্মডাঙ্গা বাজার, যেখানে ইংরেজি কোনো পত্রিকা আসে না। বাংলা পত্রপত্রিকা যাও আসে, তাও দু-এক দিন পর পর। শৌখিন গোছের চায়ের স্টলে রেডিও-ট্রানজিস্টার বাজে। ‘সেই সুবাদে দু-চারজন দিনের খবরাখবর পায়। মুখে মুখে ছড়ায়ও কিছুটা।’ একাত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এরকমটাই ছিল উল্লেখ করা ওই জনপদের দিনানুদৈনিকতার চালচিত্র।

এ উপন্যাসে অনেক চরিত্রের সমাগম। ক্রমশ তারা মূর্ত হলেও সময়ের ব্যবধানে তাদের অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তারা মনের পটে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। মনে হয়, তাদের সবাই আমাদের অনেক চেনাজানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে বসবাসকারী সুবিমল, একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পরেও যে ঘরে ফেরে না, যাকে হন্যে হয়ে যে সন্ধানরত, সন্তানের প্রতীক্ষায় যার ঘুম নেই, সেই লক্ষ্মণ এমনই একটি চরিত্র। একাত্তরে লক্ষ্মণের মতো এ রকম পিতা-মাতার সংখ্যা ছিল বেশুমার। লক্ষ্মণের হাহাকার আমাদেরও দীর্ণ-বিদীর্ণ করে।
গজারিয়া, ইনদুরকুমা, তিতাসের টেক, ডাহুককান্দা ও উজানীর চর, আমার বিশ্বাস, রেজাউর রহমানের অন্তরঙ্গভাবে দেখা সব জনপদ। না-হলে তাদের রূপরসগন্ধসমেত এত ধ্রুবচিত্র তিনি আঁকলেন কী করে! প্রতিটি চরিত্রই জীবন্ত। সহজ-সরল তাদের জীবনের ধারা। তবে সেই জীবন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিলোড়নরহিত থাকার এতটুকু অবকাশ পায়নি।
অন্ধকারে নয় মাস-এর কাহিনি বা ঘটনাক্রম যতই অগ্রসর হতে থাকে, ততই প্রকাশমান হতে থাকে চন্দন, ইসরাফিল, কুসুমী আর মালতীর চরিত্র। তাদের চোখ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট গ্রামজনপদে মুক্তিযুদ্ধের চলমান ঘটনাধারা এবং তার পরিণতি আমরা লক্ষ করি। পাকিস্তানি বাহিনীর মারণযজ্ঞ, তাদের পরিচালিত নিপীড়ন-নির্যাতন এবং ত্রাস কীভাবে জনপদের পর জনপদের মানুষকে গ্রাস করেছিল, তার সমূল চিত্র মূর্ত হয়ে ওঠে। খুবই জ্বলন্ত তখনকার পরিপার্শ্ব ও প্রকৃতির বিবরণ।
এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ইসরাফিলকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কখনোই অস্ত্র হাতে দেখি না। তবে অস্ত্র হাতে না নিলেও সে মুক্তিযুদ্ধ-সৃষ্ট অভিঘাতের বাইরে চলে যায় না। নেপথ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয় সমর্থন জুগিয়ে চলে। দোতারা হাতে লালনের গান গায় কখনো কখনো। কিন্তু তার সেই সাংগীতিক জীবন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একপর্যায়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয় ইসরাফিল। তবুও দমে না। বরং মুক্তিযুদ্ধে দুঃসহ রকমে পীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের জন্য তার সহমর্মিতা অন্তহীন। তাদের প্রত্যেকের জন্য সে কাতর, উদ্বেল ও উৎকণ্ঠ।
কুসুমী—এ বইয়ের অন্যতম নারী চরিত্র, বেদে বহরের সদস্যা। তাদেরও জীবন নিরাপদ নয়। পঁচিশে মার্চের পর তারা ঢাকার ডেমরাঘাট থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছে। আকস্মিক পরিচয়ের সুবাদে ক্রমেই ইসরাফিলের সঙ্গে একটা হার্দ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে কুসুমীর। হয়তো পরোক্ষ ভালোবাসা। না হলে যখন রাতের অন্ধকারে তাদের বেদে বহর নিয়ে কুসুমীরা আরও নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যায়, তখনো তার অবচেতনে জেগে থাকবে কেন কুসুমী? তাই তো হঠাৎ করেই সে দেখে, ‘মালতী বেদে নৌকার গলুইয়ে বসে একটানা হেসে চলেছে। পরনে তার কলকে পেড়ে শাড়ি। এলোচুলে লাল বুনো ফুল। কপালে টিপ। সে নদীর জলে মৃদু মৃদু পা নেড়ে চলেছে হালকা খেলাচ্ছলে। ইসরাফিলের ঘুম ভেঙে যায়।’ এ সবকিছুই তো তার অবচেতনে সংগুপ্ত বাসনারই আঁকিবুকি।
বস্তুত এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি অভিঘাত যেমন চিত্রিত, তেমনি সেই অভিঘাত সৃষ্ট পরিণতিও সমভাবে উপস্থিত। মালতী চরিত্রও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ পরিণতি। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মালতী যেন ইসরাফিলের জীবনে আবির্ভূত হয় কুসুমীর বিকল্প মানবীসত্তার রূপ ধরে। মালতী যেন তার হারিয়ে যাওয়া কুসুমী। মানসিকভাবে বিকল মালতীকে তাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তার চেষ্টার অন্ত নেই। যখন ভোর রাতে ‘সে শোনে, কুয়োতলায় ঝপঝপ পানি ঢালার শব্দ’, যখন দেখে বিবস্ত্র মালতী বালতি বালতি পানি ঢালছে তার গায়ে, যেন শরীরে লেপটে থাকা নয় মাসের সমস্ত পঙ্কিলতা ধুয়েমুছে ফেলতে উন্মুখ, তখন তার সঙ্গে সে ‘বেদের মেয়ে কুসুমীর মুখশ্রীর অদ্ভুত মিল খুঁজে পেতে থাকে।’ আর তার একার একাগ্র চেষ্টায় মালতীর সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণে তার চোখেমুখে পরিতৃপ্তির আভাস। ঠোঁটে অমলিন হাসির ঝিলিক। তাই দেখে চন্দন ইসরাফিলকে বলে, ‘বনে জঙ্গলে বন্দুক লইয়া ঘুরছি। আইজ বুঝলাম, আসল যোদ্ধা তুই। তরে আম চিনি নাই...’, এ কথা বলে আর ‘চন্দনের দুই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামে।’
অশ্রু চন্দনের দুগাল বেয়ে নামে তো বটেই, আমাদেরও দুচোখ আপনাআপনি সিক্ত হয়ে ওঠে।

No comments

Powered by Blogger.