উদ্ভট ঘটনা কেন ঘটে by মশিউল আলম

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পে ঢাউস কাঁঠালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে জ্বলজ্যান্ত এক নারী। প্রেমিক-প্রেমিকা পালিয়ে যাবে বলে নৌকায় চাপে, তারা টের পায় না রাতের অন্ধকারে বিরূপ বাতাসে নৌকা এগোয়নি। সকালের আলোয় যখন তারা দেখতে পেল, প্রেমিকার বাপ-চাচারা ছোটলোকের সন্তান প্রেমিকটিকে মারার জন্য তীরে টেঁটা-বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তখন প্রেমিক-প্রেমিকা নৌকা থেকে নেমে পড়ল হাওরে। হাওর হয়ে গেল মাঠ। সেই মাঠ ধরে হেঁটে চলল তারা।

এ রকম, তাঁর কোনো গল্পে যদি দেখি গরু গাছে উঠেছে, অবাক হব না। কারণ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অনেক গল্পেই এ রকম বা এর চেয়ে বেশি উদ্ভট ঘটনা ঘটে। বাস্তব জীবনে যেমন ঘটে না, তাঁর গল্পে তেমন অবাস্তব ঘটনা কেন ঘটে আমরা জানি না। লেখক, মানে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং গল্প লেখেন, তিনিও সম্ভবত জানেন না তাঁর গল্পে এসব উদ্ভট ঘটনা কেন ঘটে।
তার মানে আবার এই নয় যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম উদ্ভটতার শিল্পী। মোটেও তা নয়, নিরেট বাস্তবের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় ঘটে না এমন ঘটনার গল্পও তিনি অনেক লিখেছেন। কিন্তু তাঁর ওই অতিবাস্তব বা উদ্ভটের বিবরণগুলো তাঁকে বাংলাদেশের আর দশজন গল্পলেখকের থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।
গত পাঁচ বছরে লেখা তাঁর কুড়িটি গল্প নিয়ে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত সুখ-দুঃখের গল্প পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল তাঁর এই বিশিষ্টতার কথা। অবশ্য শুধু পরাবাস্তবের প্রতি আগ্রহের কারণেই যে তিনি বিশিষ্ট তাও নয়। তাঁর আরও একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি লেখক, গল্প লিখছেন, মানে বানাচ্ছেন বা অন্যের কাছে যা শুনেছেন তাই লিখছেন—এটা তিনি পাঠককে বারবার জানিয়ে দেন। ঈশ্বরের মতো সর্বজ্ঞ, সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানের ভান তাঁর নেই। তিনি পাঠককে ভোলানোর চেষ্টা করেন না, বরং কখনো কখনো তাকে আমন্ত্রণ জানান তাঁর কথনের বা ডিসকোর্সের অংশীদার হতে। আবার, মানুষ হিসেবে তাঁর ভালো-মন্দের বোধ, তাঁর নৈতিকতা এমন প্রকটভাবে ফুটে ওঠে না, যা তাঁকে তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর ব্যাপারে পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট করে। তাঁর গল্পে ভালো মানুষ ও খারাপ মানুষ একসঙ্গেই থাকে। কেউ কাউকে দুঃখ দেয়, ঠকায়, পীড়ন করে; কেউ সব সয়ে যায়। কিন্তু ভালো লোকটিকে লেখক পছন্দ করেন, খারাপ লোকটিকে ঘৃণা করেন—এ রকম দেখা যায় না। তাঁর গল্পে নায়কও নেই, ভিলেনও নেই।
তিনি রসিকও বটেন। এমন রসিক যে দুঃখের গল্পও বলতে পারেন রসিকতার ছলে। কিন্তু এই রসিকতা কখনো লেখকের নিষ্ঠুরতা বলে মনে হয় না; চরিত্রদের নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও করেন না। তাঁর চরিত্রগুলোর স্বভাব-চরিত্র আমরা জানতে পারি তাদের পারস্পরিক কথাবার্তা, একের প্রতি অন্যের আচরণের বর্ণনা থেকে। একই কারণে তাঁর গল্পের উদ্ভট অংশগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়। যেমন, ‘কাঁঠালকন্যা’ গল্পের প্রধান পুরুষচরিত্র আবসার, যে কিনা বিরাট এক কাঁঠালের ভেতর থেকে একটি মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে বলে লেখককে জানায়, তার কাছে ও রকম উদ্ভট ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়। কারণ, আমরা দেখেছি, সে বিশ্বাস করে তার প্রথম বউ ছিল ডাইনি। আবসারের কথাবার্তায় আমরা তার এই অন্ধবিশ্বাসের শক্তি টের পাই, এবং আমাদের মনে হয় লেখককে সে যে বিবরণ শোনায়, তা আমাদের কাছে যতই উদ্ভট আর অসম্ভব ঠেকুক, তার কাছে তা সত্য।
আখ্যানশৈলীর বিচারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যে বহুস্বর-ভিত্তিক পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেন, এবং এই পদ্ধতিতে বহু বছর ধরে তিনি যেভাবে গল্প লিখে চলেছেন, তাতে মনে হয়, তাঁর এই একান্ত নিজস্ব কথনভঙ্গিটি তাঁকে পুনরাবৃত্তির বৃত্তে আটকে রেখেছে। তাঁর লেখা কুড়ি বছর আগের গল্প ও গত বছরের গল্পের মধ্যে ভাষায়, বর্ণনাশৈলীতে, সুরে ও মেজাজে খুব বেশি পার্থক্য ধরা পড়ে না। কিন্তু জীবন ও জগৎ সম্পর্কে গভীর শিল্পীসুলভ অন্তর্দৃষ্টি ও আখ্যান রচনায় তাঁর যে দক্ষতা রয়েছে, তাতে তিনি অবশ্যই অনেক নতুন গল্প আমাদের উপহার দিতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.