রূপমাধুরীর অভীষ্ট অনুরাগ by সিলভিয়া নাজনীন

জীবনোপলব্ধির বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতায় চিত্রকলা যেন সঞ্জীবনী সুধা। একে রসোত্তীর্ণ ধারায় বহমান রাখে অনুভূতিপ্রবণ শিল্পীদের অবিশ্রান্ত সৃজনপিপাসা। মানব অস্তিত্বের অনেক ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি অবলীলায় উৎকীর্ণ হয় শিল্পীর ক্যানভাসে। অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর রেখা, গড়ন, রূপ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার শৈল্পিক কৌশলে তৈরি হয় শিল্পভাষা। শিল্পী জামাল আহমেদ, অভিজ্ঞতার নিঃসংকোচ প্রকাশে যাঁর ক্যানভাস হয়ে ওঠে সমকালীন দিনলিপি। এ সময়ের অন্যতম খ্যাতনামা শিল্পী জামাল আহমেদ। আশির দশকের ফিগারেটিভ ছবিতে নতুন অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ হয় তাঁর শিল্পসত্তার সামগ্রিক আয়োজনে। আলো-ছায়ার লুকোচুরি, নিটোল প্রকৃতি, নৈসর্গিক উচ্ছ্বাস, শ্যামল বাংলা, ক্ষয়িষ্ণু মানুষ, অবয়বে বিবিধ রূপ—বহুভঙ্গিম উজ্জ্বল রঙে প্রাণোচ্ছল মনোদর্পণে শিল্পী জামাল প্রতিবিম্বিত করেন মাটির গন্ধমাখা ছবি।

শিল্পীর স্টুডিও অস্থির সময়ের স্মারক; স্টুডিওর নিবিড় পাঠ তাঁর ক্যানভাসে স্পষ্টতর। নানা আকৃতির ক্যানভাস, রঙের কৌটা, অস্থির ব্রাশ-প্যালেট থেকে গড়িয়ে পড়া রং, চারকোল, গুঁড়ো রং, বালতির পানি, রং মোছার টুকরো কাপড়, ইজেল, বসার জন্য তাকিয়া, একদিকে উপবিষ্ট মডেল—এ সবই সৃজন প্রণোদনায় নিজেদের শৈল্পিক উপস্থিতি ঘোষণা করছে স্টুডিওতে। রং-রেখায় পরিচিত প্রান্তিক মানুষ, তাদের ভাষা-দৃষ্টি, পোশাক-পরিচ্ছদ শিল্পীর ধ্যানে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তাঁর ক্যানভাসে ঘুরেফিরে আসে আমাদের চেনাজানা মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণ। ঢাকার পরীবাগে নিরিবিলি পরিবেশে শিল্পী জামাল আহমেদের স্টুডিও। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দরজা দিয়ে ঘরে যাওয়ার আগেই অপেক্ষমাণ বিভিন্ন আকারের ক্যানভাসের স্তূপ পেইন্টিংয়ে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় বারান্দাজুড়ে। তারপর বসার ঘর, করিডর পেরিয়ে শিল্পীর কর্মযজ্ঞের রঙিন ভুবন। দেয়ালে বিভিন্ন সময়ে আঁকা শিল্পীর পছন্দের সব পেইন্টিং স্টুডিওর পরিবেশকে ভিন্ন করে তোলে।
চারুকলায় পড়ার প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই ছিল। এসএসসি পাশ করে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। ভালো লাগে আঁকতে এমন যা কিছু তার সবই তিনি ক্যানভাসে উপস্থাপন করেন। স্টিল লাইফ থেকে ল্যান্ডস্কেপ, পোর্ট্রেট বা ফিগার—পাখি-নদী-মেঘমালা। তিনি বাস্তববাদের নিরীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন ক্রমাগত। আঁধার পটভূমিতে হঠাৎ কোনো অবয়ব—বুনো অভিব্যক্তি, দেহের আকুতি, আবেগের গতিপথ, নারীরূপের তীব্র আকর্ষণ, শিল্পী জামালের চেতনার অবিকল অথচ বিস্মৃত উপস্থাপন, সৌন্দর্যের উপাসনাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। শিল্পী জামালের ব্রাশিং, টেক্সচার, স্ট্রোক ভীষণ স্বকীয় এবং স্পষ্ট। বিষয়, মাধ্যম ও রং নির্বাচনে স্বদেশের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ স্পর্শ করে যায় সপ্রাণ দর্শকের হূদয়।
একজন প্রকৃত শিল্পীর কী কী গুণ থাকা উচিত—এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিল্পীর আরাধ্য হতে হবে তাঁর শিল্পকর্ম। এ জন্য সৎ, নিষ্ঠাবান ও নির্ভেজাল মানুষ হওয়ার বিকল্প নেই। আত্মিক শুদ্ধিই রঙে-ক্যানভাসে পরিশুদ্ধির একমাত্র পথ। বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা ভুলে আত্মিক ভাবনা, অভিব্যক্তি ও অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলতে হবে শিল্পকর্মে।
শিল্পী জামাল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে পোল্যান্ডের একাডেমি অব ফাইন আর্টস ও জাপানের সুকুবা ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙের ওপর দীক্ষা নিয়েছেন এবং মাস্টার্স করেছেন। তিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.