মুক্তিযুদ্ধ- জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ by আমিনুর রহমান সুলতান

র্জিদের কথা ভুলতে বসেছি অনেকেই। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, কী এমন কথা যে, তাদের মনে করতেই হবে বা রাখতেই হবে? দর্জি তো দর্জিই। দর্জিরা বড়জোর বাংলাদেশের কোথাও কোথাও খলিফা নামে পরিচিত। কে না জানে যে, সূচিকর্মজীবদের দর্জি বা খলিফা বলা হয়। পোশাক তৈরি ও কাপড় সেলাই করা যার পেশা'। সামাজিক মর্যাদা যে তাঁদের নেই এমনও বলা যাবে না। তাহলে আক্ষেপ কেনো তাদের কথা নিয়ে!
আক্ষেপ শব্দটির আভিধানিক অর্থ- ক্ষোভ, দুঃখ, মনস্তাপ, বিলাপ প্রভৃতি। ঠিক ক্ষোভও নয়, দুঃখও নয়, নয় মনস্তাপও আমার। শুধু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এ লেখা। আমরা তো জানি বাঙালি বড় বিস্মৃত প্রবন জাতি। প্রশ্ন আরেকটা প্রাসাঙ্গিক যে, কাকে মনে করিয়ে দেওয়া! আমি মনে করি, যারা মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রচয়িতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে ভাবেন তাদেরকেই মনে করিয়ে দেওয়াই এ লেখার প্রেরণা।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, অমিত তেজ, শৌর্য, আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী দেশবাসী চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করবে। মনে রাখবে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে যিনি বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তি স্বাদ এনে দেন; হয়ে ওঠেন জারিত জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মনে রাখবে গণহত্যায় শহীদ যারা। ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা যারা।
বাংলাদেশের এমন কোনো এলাকা ছিল না, যেখানে দর্জিগণ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করেনি। বাংলাদেশের দর্জিগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী হিসেবে ইতিহাস হয়ে থাকবেন। চেতনা ধারন করে কোন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা? সম্মুখ যুদ্ধে তো সব পেশার সকল শ্রেণীর মানুষেরই অংশ গ্রহণ রয়েছে। বিশেষ কোন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত তা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে। একটি পতাকার জন্য যে যুদ্ধ সে পতাকাটি তৈরি করার মধ্যেও এক ধরনের যুদ্ধ ছিল। প্রথমত মনের যুদ্ধ। দ্বিতীয়ত পাকসেনাসহ আল বদর আল শামস। রাজাকারদের ভয় কাটিয়ে ওঠার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একজন দর্জিকে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত বহু পতাকা তৈরি করতে হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে, গেরিলা কায়দায় পতাকাগুলো তৈরি করতে হতো তাদের। ধরা পড়লে নির্ঘাত প্রতিপক্ষদের হাতে মৃতু্য। একজন দর্জি ভিতর থেকে মুক্তিযোদ্ধা না হলে এমন কাজ সাহসের সাথে করতে পারতেন না। পতাকা তৈরির ভূমিকাকে বিপস্নবাত্মক হিসেবেও আখ্যা দিতে পারি আমরা। এটি মুক্তিসংগ্রামী বেসামরিক ইতিহাসের অনন্য ঘটনা। এই যে পতাকা তৈরি যুদ্ধ এই যুদ্ধের পেছনে দর্জিদের চবি্বশ বছরের একটা প্রস্তুতিও ছিল। উনিশশ' সাত চলিস্নশের পর থেকে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক-ভাবে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান সবগুলো আন্দোলনের সাথে কোনো না কোনো ভাবে দর্জিগণ যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজনৈতিক আড্ডা স্টলে কিংবা দলীয় কার্যালয় ছাড়াও আরও যেসব জায়গায় হতো সেসময়ের মধ্যে অন্যতম স্থান হচ্ছে কাপড়ের দোকানের এক কোণায় দর্জির জন্য রাখা নির্দিষ্ট জায়গাটি। জায়গাটির পরিসর খুব বড়ও নয়। একটি সেলাই মেশিন রাখার মতো জায়গা ছাড়া কাপড় কাটার মতো অল্প পরিমাণ জায়গা। ওই জায়গাটুকুতেই রাজনৈতিক আলোচনা হতো। কাপড়ের দোকানের মালিকের চাইতে দর্জিরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হতেন। সামাজিকভাবে অনেক দর্জি মর্যাদায় হয়ে উঠতেন আজকাল মফস্বল শহরে যা আশাই করা যায় না। আমাদের ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের আগে যেসব স্থানীয় আওযামী লীগের নেতৃবৃন্দ ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আমির আলী মন্ডল, হাসেম উদ্দিন আহমদ, মুসলেম উদ্দিন খাঁ, তরুণ ঘোষ, আবদুল জব্বার ভূঞা প্রমুখ। তাদের নামের পাশাপাশি ওই সময় যে-কজন দর্জির নাম উলেস্নখ হতো রাজনৈতিকভাবে তাড়া হলেন দত্তপাড়ার জলিল খলিফা, আজিজ খলিফা, চরনিখলার আবু খলিফা, কমল খলিফা। আরও কিছু নাম আছে এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। তখনও আমাদের ঈশ্বরগঞ্জে ভাম রাজনৈতিক ধারার কযেকজন কর্মী সক্রিয় ছিলেন তবে আওয়ামী ধারাটিই বেগবান ছিল। ফলে দর্জিরা সবাই আওয়ামী লীগেরই সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অথচ ভাবতে অবাক লাগে ওইসব দর্জিরা লেখাপড়ায় বড়জোর ফাইভ পাস বা এন্ট্রান্স ফেলের যোগ্যতাসম্পন্ন। রাজনৈতিক সচেতন হওয়ার সঙ্গে লেখাপড়ার বিষয়টিও যে জড়িয়ে আছে তা অস্বীকার করা যাবে না। তারপরও রাজনৈতিক দৃষ্টিচেতনায় অনেক অগ্রসর ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস অনেক লেখা হয়েছে। দর্জিদের কেন্দ্রিয় চরিত্র করেও একটি বড় মাপের উপন্যাস রচিত হতে পারে। আমরা অপেক্ষায় রইলাম ওই ধরনের বড় মাপের একটি কাজ পাব কথাশিল্পীদের কাছ থেকে। আমরা আশা করবো, মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস যারা রচনা করবেন তাদের লেখাতেও গুরুত্ব পাবেন দর্জিরা। দর্জির মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবাম্বিত করেছে।
=========================
তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ আমিনুর রহমান সুলতান


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.