রাজনৈতিক আলোচনা- শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে? by আবদুল গাফফার চৌধুরী

ঢাকা থেকে অন্তত:পাঁচটি টেলিফোন কল এবং দু'টি ফ্যাক্স মেসেজ না পেলে হয়তো এই কলামটি লিখতাম না। যারা টেলিফোন করেছেন এবং ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন তারা কেউ যদু-মধু নন। সকলেই_ কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ প্রবীণ রাজনীতিক, প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং নিজেই একজন কলামিস্ট। অনুমতি না নিয়ে তাদের নাম প্রকাশ করলে তারা অসন্তুষ্ট হতে পারেন এই ভেবে নাম প্রকাশে বিরত রইলাম।
তাদের প্রত্যেকেরই ক্ষোভ হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন নিজে ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের যে প্রাসাদোপম বাড়িতে বেগম খালেদা জিয়া বাস করতেন, সেই বাড়ির ভেতরের রাজকীয় অবস্থা এবং বেগম জিয়ার মালামালের বিবরণ দিতে গেলেন? এটা কোনো মন্ত্রী বা দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দিয়ে বলালেই হতো। প্রধানমন্ত্রী নিজে কথাটা বলায় নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন এবং রাজনৈতিক শালীনতা বজায় রাখতে পারেননি।
আমি তাদের বলেছি, কথাটা প্রধানমন্ত্রীকে না বলে আমাকে জানাচ্ছেন কেন? তারা কেউ কেউ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের 'একসেস নেই'। কেউ কেউ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনেও তাদের কথা বলার 'স্কোপ নেই'। সুতরাং তারা আমাকে জানাচ্ছেন। তাদের ধারণা, আমি কিছু বললে বা লিখলে প্রধানমন্ত্রী তা শোনেন।
আমি তাদের ভুল ধারণাটা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য বলেছি, আপনারা যা ভাবছেন তা ঠিক নয়। আমি প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে কোনো পরামর্শ দেই না। যা দেই আমার কলামেই লিখে তা দেই। এসব পরামর্শ তার কাছে পেঁৗছায় কিনা তাও জানি না। পেঁৗছালে এবং আমার পরামর্শ শুনলে এতোদিনে মন্ত্রিসভায় একটা রদবল হতো এবং তার সচিবদের কাউকে না কাউকে গণভবন ছাড়তে হতো।
একজন বুদ্ধিজীবী রেগে বলেছেন, তাহলে আপনি প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে অনবরত কলাম লেখেন কেন?
বলেছি, দেশের একজন বষর্ীয়ান সাংবাদিক হিসেবে এটা আমার কাজ এবং দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী আমার পরামর্শ শুনবেন কিনা সেটা তার বিবেচনার বিষয়। আমার তাতে কিছু যায়-আসে না। বঙ্গবন্ধুর আমলে আমি একজন যুবাবয়সী সাংবাদিক ছিলাম। কিন্তু তখনো আমি আমার এই দায়িত্বটা পালন করেছি। তাতে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝিরও শিকার হয়েছি।
টেলিফোনকারী একজন বুদ্ধিজীবী। আমার কথা শুনে ক্ষুণ্ন হয়েছেন। বলেছেন, তাহলে আপনার কলামেই আমাদের ক্ষোভের কথাটা প্রকাশ করুন। কথাটা প্রধানমন্ত্রীর কানে গেলে তিনি হয়তো সতর্ক হবেন।
আমি শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবীকে জানিয়েছি, তাদের কথাগুলো আমার কলামে লিখবো। কিন্তু খালেদা জিয়ার এতোদিনের বাড়ি ও মালামাল সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নিজে কথা বলায় কোনো অন্যায় বা অশালীনতা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তাদের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি না। শেখ হাসিনার কোনো কোনো কাজ ও বক্তব্য আমি পছন্দ করিনি এবং তার সমালোচনাও করেছি। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ও মালামাল সম্পর্কে তার নিজে বক্তব্য দেয়ায় কোনো অন্যায় হয়েছে বলে মনে করি না। এই টেলিফোন আলাপের পরই সিদ্ধান্ত নেই বিষয়টি নিয়ে একটু বিশদভাবে লিখবো।
সত্যি কথা বলতে কি, ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটিকে রাশিয়ার এককালের জারিনাদের (জারের স্ত্রী) মতো করে সাজানো এবং সেই বাড়িতে আসবাবপত্র, এসি, টেলিভিশন, কার্পেট ইত্যাদির সংখ্যা ও বিবরণ পাঠ করে হতবাক হয়েছি। ফিলিপিন্সের স্বৈরাচারী শাসক মার্কোসের পতনের পর তার স্ত্রী ইমেলদা মার্কোসের ব্যক্তিগত সম্পত্তির যে হিসাব বেরিয়েছিলো তা পাঠ করেই জীবনে আরেকবার বিস্মিত হয়েছিলাম। ইমেলদা ছিলেন একজন সাধারণ (তবে রূপসী) নর্তকী। মার্কোস তাকে পাটরানী করার পর অল্পকালের মধ্যে তিনি যে বিত্ত বৈভবের অধিকারী হয়েছিলেন তা প্রকাশ পাওয়ার পর মনে হয়েছিলো এটা রূপকথার অবিশ্বাস্য কাহিনী।
বাংলাদেশে আজ খালেদা জিয়ার বিত্ত বৈভবের কথা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নিজে প্রকাশ করায় আমাদের একশ্রেণীর উন্নাসিক বুদ্ধিজীবী ও ভদ্রলোক নাক কুঁচকাচ্ছেন। কিন্তু ফিলিপিন্সে মার্কোসপন্থী ইমেলদার বিত্ত বৈভবের কথা যখন গণঅভু্যত্থানে মার্কোস-ইমেলদার পতন ও দেশ ছেড়ে পলায়নের পর নতুন প্রেসিডেন্ট কোরাজিনো আকিনো নিজে সর্বজনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন তখন সে দেশের বুদ্ধিজীবী ও ভদ্রলোকেরা নাক কোঁচকাননি।
ইমেলদার অপরিমেয় বিত্ত ও ঐশ্বর্যের মধ্যে ছিলো ৭০ হাজার জুতো। মার্কোসের সঙ্গে ইমেলদা দেশ ত্যাগের সময় এই ৭০ হাজার জুতো সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিন কর্তৃপক্ষকে একটি আলাদা জেট বিমান (কার্গো) নাকি দিতে হয়েছিলো। কোরাজিনো আকিনো সেকথাও প্রকাশ করেছিলেন। তাতে ফিলিপিন্সের বুদ্ধিজীবীরা ইমেলদাকে দেশে ফিরিয়ে এনে "জনগণের অর্থ লুণ্ঠনকারী" হিসেবে বিচারের দাবি জানিয়েছেন; কিন্তু কোরাজিনো আকিনো এসব কথা নিজের মুখে ব্যক্ত করায় তার মধ্যে শিষ্টতা ও শালীনতার অভাব খুঁজে পাননি। কেউ কেউ বাংলাদেশের একশ্রেণীর নতুন ভদ্রলোক ও বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে বলেন, নতুন ভদ্রলোক হওয়াতেই তাদের স্পর্শকাতরতা একটু বেশি।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের নতুন ভদ্রলোকদের স্পর্শকাতরতার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এরা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতার কথাবার্তা ও আচরণের মধ্যে অশোভনতা ও অশালীনতা খুঁজে পান। শেখ হাসিনাকে সংযতবাক হওয়ার জন্য উপদেশ দেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার বা তার দলের অনেক শীর্ষ নেতার অভব্য ও অশালীন কথাবার্তা ও আচরণের মধ্যে কোনো অশিষ্টতা খুঁজে পান না। বেগম জিয়াকে উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী তার অনৈতিক দখলে থাকা ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে অপসারণ করা হলে তা 'অশিষ্টতা' ও 'বাড়াবাড়ি' বলে সমালোচনা করা হয়।
কিন্তু শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালে একজন গুরুতর অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিকে সামরিক আদালতে দেখতে গেলে তাকে হাওয়া ভবনের নির্দেশে হাসপাতালের গেটে গতিরোধ করা হয়। সাধারণ সেনা কর্মকর্তা দিয়ে তাকে অপদস্ত করা হয় এবং অভব্যতার চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে বলা হয়, 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে শেখ হাসিনাকে সামরিক হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া যায় না।' এক কথায় দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকা দরকার। সে সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে এই অভব্য ও অশালীন ব্যবহার করার জন্য নতুন ভদ্রলোকদের প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। কিন্তু খালেদা জিয়া সম্পর্কে একটি আদালতের রায় কার্যকর করতে গেলেও এই নতুন ভদ্রলোকদের শিষ্টতাবোধ ও স্পর্শকাতরতায় আঘাত লাগে।
ঢাকার বিএনপি সমর্থক একজন বুদ্ধিজীবী আমার কাছে স্বীকার করেছেন, শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদার মধ্যে অসংযত কথাবার্তা ও অশালীন আচরণের জন্য যদি কাউকে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে তিনি হবেন বেগম জিয়া। বেগম জিয়ার মধ্যে একটা অবিনয়ী ঔদ্ধত্যের ভাবও আছে, যা শেখ হাসিনার মধ্যে নেই। তবু একশ্রেণীর মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী ও নতুন ভদ্রলোক শ্রেণীর মধ্যে শেখ হাসিনা অধিক সমালোচিত। ঢাকার একশ্রেণীর এলিটদের আসরে বসলেই এই সমালোচনা শোনা যাবে এবং শেখ হাসিনাকে বাক সংযমের জন্য উপদেশ দেয়া হবে, যে উপদেশটি সর্বাগ্রে দেয়া উচিত বিএনপি-নেত্রীকে।
বিএনপি'র শুধু নেত্রী নন, তার দলের শীর্ষ নেতারা- যেমন সা. কা. চৌধুরী, খোন্দকার দেলোয়ার, ফখরুজ্জামান প্রমুখ, এমনকি দেশনেত্রীর কোনো কোনো উপদেষ্টা, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা যে ভাষায় কথা বলেন, যে আচরণের পরিচয় দেন, তা সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অপরিচিত। খালেদা জিয়া সম্পর্কে যে অশিষ্ট কথা বলেন না স্বয়ং শেখ হাসিনা; হাসিনা সম্পর্কে সেই অশিষ্ট ও ধৃষ্টতামূলক কথা বলেন বেগম জিয়ার কোনো কোনো উপদেষ্টা পর্যন্ত। বেগম জিয়ার উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ এই সেদিন বলেছেন, শেখ হাসিনার হাত ভেঙ্গে দেয়া হবে। এই ধরনের ধৃষ্ট উক্তি শেখ হাসিনা দূরে থাক, তার দলের কোনো নেতা ও কমর্ীর মুখ থেকেও খালেদা জিয়া সম্পর্কে কোনোদিন বের হয়নি।
দেশের দু'বারের প্রধানমন্ত্রী (ফেব্রুয়ারী ৯৬-এর জালিয়াতির নির্বাচন ধরা হলে তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও বেগম জিয়া কথাবার্তাতে শুধু অশিষ্টতা নয়, অনেক সময় এমন সব কথা বলেছেন, যা পরে অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার আগে যখন বোমা হামলার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়, তখন এ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশের বদলে তিনি জনসভায় দাঁড়িয়ে ঠাট্টা করে বলেন, "ওনাকে (হাসিনাকে) আবার মারতে যাবে কে?" দেশের একজন শীর্ষ বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদকে যখন বিএনপি-জামায়াতের আশ্রিত ধমর্ীয় সন্ত্রাসীরা ছুরিকাঘাতে প্রায় মৃতু্যর দুয়ারে পাঠিয়ে দেয়, তখন হূদয়হীনতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যাত্রাবাড়ির প্রকাশ্য সভায় বেগম জিয়া বলেন, বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ইসু্য তৈরি করার জন্য এই হত্যা প্রচেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ।
কবি শামসুর রাহমান ছিলেন সকল দলমতের মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন দেশের প্রধান কবি। তার উপরেও যখন বিএনপি-জামায়াত সরকারের পালিত ধমর্ীয় জঙ্গিরা বাড়িতে ঢুকে তার জীবননাশের চেষ্টা চালায়, তখন সরকার প্রধান থাকা সত্ত্বেও বেগম জিয়া কবির জন্য কোনো সমবেদনা প্রকাশ করেননি বা তার নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং কবির সম্পর্কে বিদ্রূপবাক্য উচ্চারণ করে বলেছেন, "এটা তাদেরই সাজানো নাটক"। দেশের নতুন ভদ্রলোকদের জিজ্ঞাসা করি, শেখ হাসিনার কোনো কোনো উক্তি অসময়োচিত ও বেশী স্পষ্টোক্তি হতে পারে, কিন্তু উপরে বর্ণিত হূদয়হীন, অশিষ্ট ও অসংযত বল্গাহীন কথাবার্তায় একটা নজিরও তার বক্তব্যে কেউ দেখাতে পারবেন কি?
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, বষবপঃরড়হ ঢ়ৎড়সরংব বা নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি। সব দেশে_ এমনকি উন্নত গণতন্ত্রের দেশ ইংল্যান্ডেও রাজনৈতিক নেতারা অনেক নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দেন, যা ভোটদাতারা জানেন যে সকল সময় সত্য হয় না। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনারও কোনো কোনো নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে তা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য বিনা দ্বিধায় অসত্য কথা বলেন বা বলেছেন তার কোনো প্রমাণ নেই।
অথচ বেগম জিয়া অতীতে এমনসব কথা বলেছেন এবং এখনো বলছেন যা তিনি নিজেও জানতেন সত্য নয় এবং এখনো জানেন এসব কথা অসত্যের পর্যায়ভুক্ত। তিনি '৯৬ সালের নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, "আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে।" তিনি জানতেন এটা একটা অসত্য সাম্প্রদায়িক প্রচারণা। কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন জেতার জন্যও এ ধরনের ডাহা অসত্য প্রচারণা চালানো হয় না। কিন্তু তিনি চালিয়েছেন। পরের সাধারণ নির্বাচনের আগে আবারো অসত্যের আশ্রয় নিয়েছেন। বলেছেন, "পার্বত্য শান্তি চুক্তির দ্বারা আওয়ামী লীগ দেশের এক-দশমাংশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।" আরো বলেছেন, ভারতের সঙ্গে হাসিনা সরকারের সম্পাদিত ত্রিশ বছর মেয়াদি পানি চুক্তির দ্বারা গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। একথাও সম্পূর্ণ অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে, ২০০১ সালে বেগম জিয়া আবার ক্ষমতায় আসার পরে ভারত যাতে হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত ত্রিশ বছর মেয়াদি পানি চুক্তি মেনে চলে সেজন্যে দিলিস্নর দরবারে ধরনা দিচ্ছেন তারা।
চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, কিবরিয়া ও আহসানউলস্না মাস্টার হত্যা থেকে শুরু করে হাসিনার সভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা পর্যন্ত বড় বড় প্রত্যেকটি হত্যা ও সন্ত্রাসের মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ, বেগম জিয়ার একাধিক ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, এমনকি তার ছেলে তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। কিবরিয়া হত্যার ঘটনাতো আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই পর্যন্ত ঢাকায় এসেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সচিব অথবা উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যায় তো জিয়াউর রহমানের সংশিস্নষ্টতার অভিযোগও অনেক আগেই উঠেছে।
অথচ আওয়ামী লীগের দ্বারা বিএনপি'র কোনো শীর্ষ নেতা-নেত্রীর গায়ে ফুলের টোকাটিও পড়েছে তার কোনো উদাহরণ নেই। বেগম জিয়াতো রাজনীতি করছেন দীর্ঘকাল ধরে। তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। তার গায়ে একটি ইটও কেউ ছুঁড়ে মেরেছে কি? অথচ শেখ হাসিনাকে হত্যার ছোট-বড় চেষ্টা হয়েছে নয়বার এবং বোমা-গ্রেনেড সবই ব্যবহার করা হয়েছে এবং বড় হামলাগুলোতে বিএনপি'র কোন কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সংশিস্নষ্টতারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া হাসিনা ও খালেদার মধ্যে কথায় কথায় ইকুয়েশন টানেন এবং দু'জনকে সমদোষে দোষী বলে প্রচার চালান।
উদাহরণ লম্বা করবো না, কেবল আরেকটি কথা বলবো। বাংলাদেশের ফাউন্ডিং ফাদার হিসাবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও নন্দিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে শোকাবহ ও নির্মম হত্যা দিবসটিকে নিজের জন্মদিন ঘোষণা করে সেদিন বিশাল কেক কেটে আনন্দ উৎসব করাকে আমি শুধু অশালীনতা বলি না, বলি ভালগারিটি বা অশস্নীলতা। এটা কারো প্রকৃত জন্মদিন হলেও তিনি এই অশস্নীলতার আশ্রয় নিতেন না। এটাতো শুধু একজন সাধারণ রাজনৈতিক নেতার হত্যা দিবস নয়, যাকে হত্যা করা হয়েছে তাকে ইতিপূর্বে পাকিস্তানি হানাদারেরাও বন্দি করে হত্যা করার সাহস করেনি। যাকে হত্যা না করার জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন জঙ্গি ও জংলি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের অধিকাংশ প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে এই মহানায়ককেই সপরিবারে হত্যা করেছে বাংলাদেশেরই সামরিক ও অসামরিক একদল দেশদ্রোহী বর্বর ঘাতক। কেবল বঙ্গবন্ধুকে তারা হত্যা করেনি, করেছে তার পরিবারের নিরপরাধ নারী এবং শিশুদেরও। দশ বছরের বালক, নয় বছরের বালিকা (রাসেল ও সেরনিয়াবত কন্যা), কয়েক মাসের সন্তানসম্ভবা নারী (শেখ মনির স্ত্রী) এবং মাসখানেকের নববিবাহিতা বধূ, যাদের হাতের মেহেদির রঙ পর্যন্ত তখনো মোছেনি, নরপশুরা চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করেছে। এদিনটি শিশু ও নারীর রক্তে রঞ্জিত একটি দশই মহররমের মতো দিন।
এই দিনটিকে নিজের জন্মদিন বানিয়ে উৎসব করা কোনো পাষাণ হূদয় মানুষের পক্ষে কি সম্ভব? বিএনপি নেত্রীতো নিজেও একজন মা। তার স্বামীকে শুধু হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে যদি তার ছেলে, ছেলের বউ, ভাই-বোনকেও হত্যা করা হতো এবং তিনি শুধু বেঁচে থাকতেন, পারতেন এই দুঃসহ শোক সম্বরণ করতে? তার উপর কেউ যদি এই দিনটিকে আনন্দ-ফুর্তি করার উৎসবের দিন বলে ধার্য করতো তাহলে তিনি কি করতেন? শেখ হাসিনার মহানুভবতার কাছে গোটা জিয়া পরিবারের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবতর্ী হয়ে জিয়া-হত্যার দিনটিকে তিনি নাজাত দিবস নাম দিয়ে উৎসবের দিন হিসেবে ধার্য করেননি।
আজ একটি বাড়ি হারিয়ে বেগম জিয়া জনসমক্ষে প্রকাশ্যে কাঁদলেন। আর এক রাতে গোটা পরিবার হারিয়ে বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ অসহায় দুই বোনের (হাসিনা ও রেহানা) তাহলে কি করা উচিত ছিলো? ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়াও ঢাকায় সরকারি অনুদানের আরেকটি প্রাসাদোপম বাড়ি এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে মিন্টো রোডে বরাদ্দ বাড়ি থাকা সত্ত্বেও বেগম জিয়া সকলের কাছে একথা বলতে দ্বিধা করেননি যে, তিনি একজন বাস্তুহারা। অন্যদিকে শেখ হাসিনা তার ছোট বোনসহ বেগম জিয়ার স্বামী জেনারেল জিয়ার শাসনামলে দীর্ঘ ছয় বছর দেশে ফিরতে পারেননি এবং দেশে ফেরার পরও তাকে ৩২ নম্বরের পিতৃগৃহে এক বছরের বেশি সময় ঢুকতে দেয়া হয়নি। তথাপি শেখ হাসিনা আঁচলে চোখ মুছে সর্বজনসমক্ষে একথা বলেননি যে, আমি একজন বাস্তুহারা। তার আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্ভ্রমবোধকে এজন্যেই আমি সম্মান করি।
ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি দীর্ঘ ৩৫ বছর অনৈতিকভাবে বেগম জিয়া দখলে রেখেছিলেন। তিনি বিবেকের তাগিদ বা জনগণের দাবিতে বাড়িটি ছাড়েননি। উচ্চ আদালতের রায়ে ছাড়তে হয়েছে। বাংলাদেশের নতুন ভদ্রলোকেরা এই ঘটনার সঙ্গে ২০০১ সালে শেখ হাসিনার নামে গণভবন বরাদ্দ হওয়ার ঘটনার তুলনা টানেন। কিন্তু শেখ হাসিনা এই সরকারি ভবনটি তার নামে বরাদ্দ হতেই দেশে আপত্তি ওঠাতে সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন। একথা ভদ্রলোকেরা উলেস্নখ করেন না। আদালতে মামলা করে, পুলিশ ও র্যাব পাঠিয়ে তাকে বাড়িটি ছাড়তে বাধ্য করতে হয়নি।
আর বিএনপি যেমন ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটিকে একটি রাজনৈতিক ইসু্য করার চেষ্টা চালিয়ে হরতাল, ভাংচুর, অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে; গণভবনকে কেন্দ্র করে কিংবা রেহানার জন্য বরাদ্দকৃত একটি বাড়ি বেগম জিয়া ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুব লীগ, মহিলা লীগ কেউ তেমন আন্দোলনের নামে ভাংচুরের কান্ডকারখানায় মাঠে নামেনি। সরকারি দু'টি বাড়িকে কেন্দ্র করেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দু'টি দলের রাজনৈতিক চরিত্রের বিরাট পার্থক্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। দুই দল এবং তাদের নেতানেত্রীদের চরিত্রে এতো বিরাট পার্থক্য সত্ত্বেও যারা এই দুই দল ও দুই নেত্রীকে একই ব্রাকেটভুক্ত করে একই চরিত্রের দল ও নেত্রী হিসেবে দেখাতে চান এবং শেখ হাসিনাকে বাক সংযম ও শালীনতা শেখাতে চান, তাদের কেউ কেউ অজ্ঞানপাপী হতে পারেন, কিন্তু অধিকাংশই যে জ্ঞানপাপী তাতে সন্দেহ নেই।
একটি গণতান্ত্রিক ও গণআন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা দলের অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে এবং অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই দলের সঙ্গে সেনা ছাউনিতে একজন জেনারেলের ক্ষমতা দখল ও তার ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে গড়ে ওঠা দলের মধ্যে যারা সমান তুলনা টানেন এবং রাজপথের আন্দোলনের নির্যাতিত নেত্রীর সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টবাসিনী এক সৌখিন নেত্রীকে একাসনে বসাতে চান, তারা কিছুকাল সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবেন, কিন্তু দীর্ঘকাল নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতের মুসলিম লীগের মতো বিএপির জন্যও পতনের একটি সুড়ঙ্গ-পথ তৈরি হয়ে গেছে।
============================
একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবদুল গাফফার চৌধুরী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.