আন্তর্জাতিক- ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে by খ ম মাহফুজুল হক

ম্প্রতি পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রাশিয়া ও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টসহ ন্যাটো জোটের ২৮টি সদস্য দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক। ওই বৈঠকে আগামী দশ বছরের জন্য ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজি এবং আফগানিস্তানে মোতায়েন ন্যাটো সেনাদের রণকৌশল অনুমোদন করা হয়। এছাড়া, ইরানের সম্ভাব্য হামলা থেকে ইউরোপকে রক্ষার জন্য বহুল আলোচিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়ে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা হয় লিসবন বৈঠকে।
মূলতঃ এই তৃতীয় কারণটির জন্যই লিসবন বৈঠক বিশেস্নষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে বহুদিনের বিতর্কিত "ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা" মোতায়েনের বিষয়ে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যকার সমঝোতা টেকসই হবে কি না? তাছাড়া এই সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে? এমন প্রশ্নও স্বাভাবিক কারণেই এখন সামনে চলে এসেছে। আজকের এই লেখায় আমি এ দুটো বিষয় নিয়েই আলোচনা করব।
২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরান আতঙ্ককে অজুহাত করে চেক প্রজাতন্ত্র এবং পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়টি উত্থাপন করে তখন রাশিয়া এর ঘোর বিরোধিতা করে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এজন্য পূর্ব ইউরোপের যে দু'টি দেশকে বেছে নিয়েছিল সে দুটি দেশই রাশিয়ার পশ্চিম প্রান্তের অত্যন্ত কাছাকাছি । আর রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলেই রয়েছে দেশটির সংবেদনশীল বেশ ক'টি সামরিক ও পারমাণবিক ঘাঁটি, এ জন্যে তখন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতায় লিপ্ত হয় রাশিয়া। এরইমধ্যে হোয়াইট হাউজে ক্ষমতার পালাবদল হয়। পরিবর্তনের শেস্নাগান দিয়ে ক্ষমতায় আসেন বারাক ওবামা। ২০০৯ সালেই প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়ে ওয়াশিংটনের নীতিতে পরিবর্তন আনেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা এই বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার সাথে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা বাতিল করছে না ; তবে তা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হোয়াইট হাউজের এই সিদ্ধান্তকে ক্রেমলিন স্বাগত জানায়, ফলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। শীতল যুদ্ধ অবসানের পর বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য রাশিয়া তার আকাশ ব্যবহার করতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুমতি দেয়। কিন্তু রাশিয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ওবামার উদার মনোভাব দু'দেশের সম্পর্ককে এতটা গভীরে নিয়ে যায় যে, মস্কো তার আকাশ মার্কিন সেনা এবং সামরিক সম্ভার পরিবহনের জন্য খুলে দেয়। মস্কোর এই পদক্ষেপ দুই দেশকে অনেক কাছাকাছি নিয়ে আসে।
শীতল যুদ্ধ অবসানের পর দু'দেশ যখন এতটাই কাছাকাছি, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সম্ভাব্য হামলা থেকে ইউরোপকে রক্ষার অজুহাত তুলে তুরস্কের মাটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনায় বিপাকে পড়ে যায় তুরস্ক। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম না হওয়া এবং দেশটিতে ইসলামভাবাপন্ন দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে আংকারার পররাষ্ট্রনীতিতে পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্য বেশি প্রধান্য পাচ্ছে। এরই প্রেক্ষাপটে দেশটি ইরানসহ মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে। ফলে, ইরানের সম্ভাব্য হামলা থেকে ইউরোপকে রক্ষার অজুহাতে তুরস্কের মাটিতে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা স্থাপনে সম্মত হলে তাতে প্রভাবশালী ইরানের যে বিরাগভাজন হতে হবে তা তুর্কি নেতাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় নি। তাই তারা প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সায় দেয়নি। কিন্তু মার্কিন সরকারের চাপ উপেক্ষা করে যাওয়া তুর্কি সরকারের পক্ষে বেশিদিন সম্ভব হয়নি, শেষমেষ আংকারা শর্তসাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা মেনে নেয় । তুরস্কের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়, ইরানের সম্ভাব্য হামলার কথাটি যদি পরিহার করা হয় তাহলে তুরস্কের মাটিতে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করতে আংকারার আপত্তি নেই। প্রসঙ্গক্রমেই চলে আসে রাশিয়ার কথা। চেক প্রজাতন্ত্র এবং পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের মার্কিন পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেছিল রাশিয়া, কিন্তু এখন তুরস্কে তা মোতায়েনের ব্যাপারে রাশিয়া কোন আপত্তি তুলছে না, বরং এ বিষয়ে ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার খানিকটা বোঝাপড়াও হয়ে গেছে । এর কারণ হচ্ছে তুরস্কের যে স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের কথা হচ্ছে তা রাশিয়ার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এর ফলে রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে দেশটির স্পর্শকাতর সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো হুমকির মুখে পড়বে না। এছাড়া ওবামা প্রশাসন রাশিয়াকে এই পরিকল্পনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করতে চাচ্ছে। কাজেই রাশিয়াও চায় না ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা পরিকল্পনার সাথে জড়িত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে। রুশ প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ মনে করেন। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেয়া হলে রাশিয়ায় মার্কিন পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পথ তৈরি হবে। আর রাশিয়ার অচল হয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা করতে মার্কিন পুঁজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই রাশিয়াকে বিশ্বাস করবে ? রাশিয়ার অর্থনীতি সচল করতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাহায্য দেবে কিংবা রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে ?
আন্তর্জাতিক বিশেস্নষকদের বেশির ভাগই এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নেতিবাচক। এর কারণ সুস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র এখনও রাশিয়াকে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভাবতে পারে না। ক্রেমলিনে ক্ষমতার পালাবদলের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা তৈরি হয় নি। ক্রেমলিনের মসনদে মেদভেদেভের পর কে আসীন হবে তাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট নয়। মেদভেদেভের পর যদি পুতিনের মতো কোন কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতা পুনরায় ক্রেমলিনের ক্ষমতা গ্রহণ করেন তাহলে মস্কো-ওয়াশিংটন সম্পর্কের হিসেব আবারও পাল্টে যেতে পারে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মেদভেদেভের বেশী ঘনিষ্ঠতা রুশ পার্লামেন্টের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কম্যুনিস্ট পার্টি এবং দেশটির বেশ কিছু প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী নেতা ভালোভাবে নিচ্ছে না। ফলে রাশিয়ার ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতিকে সচল করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মস্কোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে আর রাশিয়াও অবলীলায় ন্যাটোকে রক্ষার নামে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনকে মেনে নেবে এমনটি মনে করার কোন উপায় নেই। তারপরও যদি ধরে নেয়া হয় রাশিয়া ও ন্যাটো সমঝোতার ভিত্তিতে তুরস্কের মাটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করলো তাহলে এতে উদীয়মান শক্তি ইরানের ওপর কি প্রভাব পড়বে ? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- এতে ইরান মোটেও বিচলিত হবে না। কারণ ইরানের সামরিক প্রযুক্তি রাশিয়া বা পাশ্চাত্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। ইরান সম্প্রতি রাশিয়ার তৈরি ং-৩০০-এর চেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নির্মাণ করে এটাই প্রমাণ করেছে যে, কারো সাহায্য ছাড়াই ইরান উন্নত সামরিক সরঞ্জাম তৈরী করতে সক্ষম। এছাড়া পাশ্চাত্য জগতের সাথে ইরানের বৈরিতা ও সংঘাত নতুন কিছু নয়। এক্ষেত্রে গত ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে ইরানের সামনে। কাজেই ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার সমঝোতার ফলে ক্ষতি হওয়ার থাকলে তাতে মস্কোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ওই সমঝোতার ফলে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হলে মস্কো পাশ্চাত্যের কাছে তেহরানকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ চিরতরে হারাতে পারে ।
========================
জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ খ ম মাহফুজুল হক
পরিচালক, বাংলা বিভাগ, রেডিও তেহরান


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.