রাজনৈতিক আলোচনা- পারিষদদলে বলেঃ by সাযযাদ কাদির

মাদের দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে তর্জন-গর্জনের অভাব নেই কোনও কালে। প্রতি দশকেই দেখি কোনও- না কোনও বিষয় ধারণ করেছে তীব্র তর্জন ও প্রবল গর্জনের মূর্তি। সত্তুর দশকে সমাজতন্ত্র ছাড়া কোনও কথা, বলতে গেলে, বলারই উপায় ছিল না। সে তর্জন-গর্জন তখন এত গগনবিদারী হয়ে উঠেছিল যে, মওলানা ভাসানী পর্যন্ত ইসলামি সমাজতন্ত্রের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আশির দশকে গণতন্ত্র ছিল সবচেয়ে সরব ও সোচ্চার বিষয়।
এরপর আমরা নব্বুই দশকে দলতন্ত্র এবং এই শূন্য দশকে ব্যক্তিতন্ত্র দেখছি, শুনছি, সমানে চেঁচাচ্ছিও। তবে সব দশকেই তর্জন-গর্জনের পাশাপাশি চলেছে বর্জন-অর্জন। আশির দশকে তর্জন-গর্জন যেমন ছিল বেশি, বর্জন-অর্জনও ছিল তেমন বেশি-বেশি। আমার মতো আহাম্মকেরা যখন বর্জনকে মনে করেছে মহান আত্মোৎসর্গ, তখন অনেক আকলমন্দ সার জেনেছেন অর্জনকেই। প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা, বিটিভি'র প্রোগ্রাম, মিরপুরের পস্নট, এশীয় কবিতা উৎসব ( আরও কত কি-বর্জন করি। ওদিকে আড়ালে-আবডালে অনেক কিছু অর্জন করে নেয় অনেকে। আমার অজান্তে আমার পাশের জনও কিভাবে কি করে যেন বাগিয়ে নেয় এটা-সেটা। কয়েকজন হাতিয়ে নেয় নানা কিছু। রীতিমতো দাঁও মেরে বসে আরও কয়েকজন।
জানতে না পারায় প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা, চিনতেও পারিনি তাদের। তারা আপনজন, সেভাবেই থাকি। কিন্তু হঠাৎ করে যখন তাদের আঙুল ফুলে ওঠে তখন তাদের চেহারায় শুধু নয় হাবভাবেও দেখি নানা রকম পরিবর্তন। আমি যত খুশি হয়ে, যত আপনজন ভেবে মিশতে যাই, তারা যেন তত দূর-দূর থাকতে চায়। সেটা আবার আমাকে ঠিকমতো বোঝাতেও চায় না। ভাবি, এখন কেউকেটা হয়ে গেছে। তাই জনসমক্ষে তুই-তুমি সম্বোধন শুনতে অস্বস্তি বোধ করে। আমার বাল্যবন্ধু বজ্র তো এমন নয়। সে তো আজ বিশ্বখ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম কিন্তু সেই বাল্যকালের সম্বোধন বদলে দিতে তো রাজি হয়নি। এখনও তো আমরা একে-অন্যের ছোটবেলার সেই প্রিয় তুই-তুই। তার অনেক বন্ধু, অনেক শিক্ষক 'স্যার' বলে সম্বোধন করে তাকে। আমি জানি, এ সম্বোধন পীড়িত করে তাকে।
আঙুল ফুলে ওঠা আপনজনদের দূরজন হয়ে ওঠার রহস্য কিছুটা ভাঙে 'সরগম' সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। আমাদের দু'জনেরই অতিঘনিষ্ঠ একজন ফুলে গিয়ে এমন কাজ শুরু করলেনঃ সে কাজে তার বিশেষভাবে শরণাপন্ন হওয়ার কথা এই আমাদের কাছেই । কিন্তু দেখা গেল আমার দূরজন বানিয়ে তিনি মহাউৎসাহে মেতে উঠেছেন যাবতীয় দুর্জনদের সঙ্গে। বিষয়টি বিমূঢ় করে আমাদের দু'জনকেই। বলি, এতদিন ধরে সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থাকলামঃ এখন একেবারে চিনতেই চায় না! এটা কি ধরনের অসৌজন্য! রওনাক এ বিষয় সে বিষয় ব্যাখ্যা করে শেষে বলে (তার ভাষা হুবহু উদ্ধারের চেষ্টা করছি), আজ যারা কুতুব তাদের অনেকেই এক সময় কুতুব ছিল না। সেই সময় আপনি-আমি ছিলাম তাদের নিত্যদিনের চেনা-জানা- শোনা সাথি। সেসব দিনের কথা তাদের মনে পড়ে যায় আমাদের দেখলে। তারা আজ সেসব দিনের কথা মনে করতে চায় না, আমাদেরও দেখতে চায় না।
জিগ্যেস করি, শুধু কি এই? রওনাক বলে, হঁ্যাঃ আরও একটা ব্যাপার আছে। নতুন কুতুবদের নতুন আপনজন জুটে যায় খুব তাড়াতাড়ি। তারা কুতুবদের চারপাশে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে, যাতে আর কেউ ঢুকে পড়ে তাদের হালুয়া-রুটিতে ভাগ না বসায়। বলি, কিন্তু আমাদের তো ভাগ বসাবার কোনও ব্যাপার নেইঃ? রওনাক বলে, পারিষদদের স্বভাব কুকুরদের মতো। তারা কাউকে দেখলেই ঘেউ-ঘেউ করে!
মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের "দুই বিঘা জমি" কাহিনী-কবিতার সেই প্রবাদ-প্রবচনে পরিণত হওয়া পঙ্ক্তি ( 'বাবু যত বলে পারিষদদলে বলে তার শত গুণঃ'! ভাবি, এ পঙ্ক্তি পড়েননি এমন বাঙালি ক'জন আছেন? তারপরও কি আমাদের দেশে পারিষদদলের শত গুণ কথার আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া শেষ হয়েছে? অনেক নেতা-নেত্রীর, ব্যক্তিত্বের পারিষদ-চর্চার কথা শুনি, কিছু কিছু জানিও। কানকথা শুনে-শুনে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া নেতাদের দেখেছি, তাঁদের সম্ভাবনাময় জীবনে নানা বিপর্যয়ও দেখেছি। মুনতাসীর মামুন-এর "প্রশাসনের অন্দর মহল: বাংলাদেশ" (জয়ন্ত কুমার রায়ের সঙ্গে, কলকাতা, ১৯৮৭) গ্রন্থে কিছু বিবরণ রয়েছে পারিষদবৃত্তির। এ বৃত্তির নানা বিবরণ লোকের মুখে-মুখেই ছড়িয়ে থাকে সব সময়, আমি সে সবকে আর স্থান দিতে চাই না কাগজের বুকে। "কিচেন কেবিনেট", "ইনার সার্কল" ইত্যাদি নানা নামে পারিষদ-চর্চার নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে এ দেশে কারও সন্দেহ নেই কোনও। তবে এই পারিষদদল আসলে কি এবং তারা কি করতে পারে তার একটি উদাহরণ দিতে চাই এখানে।
উদাহরণটি ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৪) এবং তাঁর পরামর্শে প্রেসিডেন্ট ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ (১৯০৫-১৯৭৭) কতর্ৃক ঘোষিত ২১ মাস দীর্ঘ 'জরুরি অবস্থা' (২৫শে জুন ১৯৭৫-২১শে মার্চ ১৯৭৭) সংশিস্নষ্ট বিষয়ে। এ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ভারতের সংবিধানের ৩৫২ ধারার অধীনে। এতে স্থগিত হয়ে যায় যাবতীয় নির্বাচন এবং সব ধরনের নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা। ইন্দিরা গান্ধী পান ডিক্রি জারির মাধ্যমে শাসনের ক্ষমতা।
ওই সময়ে তুলনাহীন ক্ষমতা ও প্রভাবের অধিকারী ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী রাজিন্দর কুমার ধাওয়ান ( যিনি আর কে ধাওয়ান নামেই বেশি পরিচিত)। পরে হয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব। ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডেরও প্রত্যক্ষদশর্ী তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে কারও দেখা-সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ, তাঁকে কোনও বিষয়ে অবগত বা অবহিত করা এবং পদস্থ আমলাদের নিয়োগ-বদলিতে আর কে'র নিয়ন্ত্রণ ছিল সর্বাধিক। রবিনসন ক্রুসো'র যেমন ম্যান ফ্রাইডে তেমনই ইন্দিরা গান্ধীরও ছিলেন আর কে ধাওয়ান। ছায়ার মতো প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর। তাঁর জীবনের উত্থান ও পতন সবই তিনি দেখেছেন অত্যন্ত কাছে থেকে।
আর কে ধাওয়ান বর্তমানে বিহারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন বষর্ীয়ান নেতা এবং রাজ্যসভার সদস্য। গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে 'জরুরি অবস্থা' জারির ৩৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিশিষ্ট সাংবাদিক শৈসুরেশ শিবস্বামী-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই সময়ের পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করেছেন। সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর পারিষদদল সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা এখানে উলেস্নখ প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
আর কে জানিয়েছেন, ওই দলে ছিলেন দেবকান্ত বরুয়া, রজনী প্যাটেল, মোহসিনা কিদোয়াই, উমাশঙ্কর দীক্ষিত এবং আরও অনেকে, আর সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তো ছিলেনই। তাঁর প্রস্তাব ছিল, প্রথমে গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সকল শীর্ষ নেতার, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-এর নেতাদের তালিকা তৈরি করতে হবে, তারপর তাঁদের গ্রেপ্তার করতে হবে। এ প্রস্তাবে তিনি সম্মত করান দেবকান্ত বরুয়াকে। তারপর দু'জনে মিলে যান ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। তাঁকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উমাশঙ্কর দীক্ষিতকে নির্দেশ দিন যাদের গ্রেপ্তার করতে হবে তাদের তালিকা তৈরি করতে। ওই গ্রেপ্তারগুলো হলেই গোলমাল সব মিটে যাবে। তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, এ নির্দেশ আপনাকে অবশ্যই দিতে হবে।
এসব পরিকল্পনা হচ্ছিল ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তাঁর সকল প্রস্তাব দিয়েছিলেন লিখিত আকারে।
১৯৭৫ সালের জুনে আসে এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়। যে বিচারপতি ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন তিনি সেই রায় কার্যকর করা স্থগিত রাখেন, আর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার অনুমতি দেন তাঁর রায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিরোধী দল ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকায় ক্রমশ চরম আকার ধারণ করে পরিস্থিতি।
সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে সঙ্গে নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী দেখা করেন প্রেসিডেন্ট ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের সঙ্গে। দীর্ঘ আলোচনা করেন জরুরি অবস্থা জারি সম্পর্কে। ওদিকে কাদের 'সাইজ' করা হবে তাদের তালিকা তৈরি করতে থাকেন সঞ্জয় গান্ধীর বিশ্বস্ত বংশীলাল, নবীন চাওলা (বর্তমান চিফ ইলেকশন কমিশনার), পুলিশের ডিআইজি ও আরও অনেক 'রাজার চেয়ে বেশি রাজানুগত' পারিষদ। এরপর ঘোষিত হয় জরুরি অবস্থা। আর কে ধাওয়ান মনে করেন, এ ঘোষণা চান নি ইন্দিরা গান্ধী। এটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তাঁর ওপর। এ ব্যাপারে তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, রজনী প্যাটেল, আইনমন্ত্রী এইচ আর গোখলে।
'জরুরি অবস্থা'র জন্য পরে প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন ইন্দিরা গান্ধী।
কিন্তু পরে কি হয়েছে?
জরুরি অবস্থার ফল বিষময় হয়ে ওঠার পর দেখা যায়, জরুরি অবস্থা জারির জন্য যারা শুধু পরামর্শ দিয়ে ক্ষান্ত হন নি রীতিমতো পীড়াপীড়ি করেছেন তারাই সবার আগে মুখ খুলেছেন ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে। আর কে ধাওয়ান বলেন, সবার আগে বিরোধিতা করেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, দেবকান্ত বরুয়া, রজনী প্যাটেল। এইচ আর গোখলে তো সবার আগে শাহ কমিশনে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেন ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে।
এই হলো পারিষদদল।
ক্ষমতার সঙ্গে থাকে পারিষদ। থাকবেই। আর পারিষদের সঙ্গে থাকে বিশ্বাসঘাতকতা। থাকবেই?
==============================
চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ সাযযাদ কাদির
কবি ও সাংবাদিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.