মুক্তিযুদ্ধ- স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস by মেরীনা চৌধুরী

৯৭১ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অগি্নগর্ভ বছর। এই বছরের প্রতিটি দিন এক একটি সম্ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তির সংগ্রামকে ধাপে ধাপে এগিয়ে স্থিতি দেয় স্বাধীনতায়। স্বাধীনতার উনচলিস্নশ বছর চলে যাচ্ছে কিন্তু সেদিনের সেই ২৫ মার্চের রাত আর ১৪ই ডিসেম্বরের সোনারং সকালের সুন্দর মুহূর্ত যেন আমার বুকে ঠিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।
এক বিন্দুও মলিন হয়নি। ১৯৭১ সালে আমরা ছিলাম মির্জাপুরের ক্ষণজন্মা পুরুষ দানবীর রনদাপ্রসাদ সাহা (আর পি সাহা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী হাসপাতাল চত্বরের ডাক্তারদের আবাসিক এলাকায়। আমার স্বামী ডাঃ এম এ হালিম চৌধুরী সে সময় ডিপুটি সুপার ও রেডিওলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মির্জাপুর গ্রামটি ছিল মূলত বনিক সম্প্রদায়ের ব্যবসার ক্ষেত্র। অধিবাসীর অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। ফিতার মত রূপালী লৌহজং নদীটি গ্রামটিকে দু ভাগ করেছে, ওপারে যারা বাস করত তারা সবাই ছিল হিন্দু। আর পি সাহার বাড়িও ছিল নদীর ওপারে। এপারে অন্যদের সাথে বাস করত মুসলমান সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব ছিল না। তাদের জীবন আবর্তিত হতো আর পি সাহা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হোমসকে ঘিরেই। ২৫ মার্চের পর পাক হানাদার বাহিনী সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মির্জাপুর গ্রামে এসে থানার মাঠে ক্যাম্প করে। সেদিনেই তারা হাসপাতাল পরিদর্শনে আসে। তখন হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার ছিলেন ডাঃ হাফিজুর রহমান। তিনি খুব সাহসী ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম দিন এসেই ক্যাপ্টেন আয়ূব তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন হিন্দুদের অবস্থান। ডাঃ হাফিজুর রহমান বলেন- এখানে কোনও হিন্দু, মুসলমান নেই আছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী আর তাদের চিকিৎসা ও সেবার দায়িত্বে আছে ডাক্তার ও নার্স। তাঁর জবাব শুনে ক্যাপ্টেন আয়ূব দারুণ রেগে গিয়ে বলেন, ঠিক আছে কেউ যেন হাসপাতাল কম্পাউন্ড ছেড়ে না যায়। সেদিন কেউ অতটা গুরুত্ব দেয়নি কিন্তু সন্ধ্যার সময় গ্রামের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, ডাক্তার, মিসেস পতি (আর পি সাহার ছোট মেয়ে) একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, পাকবাহিনীর সঙ্গে কোন অসহযোগিতা করা হবে না। কারণ হাসপাতালের রোগী ও হোমসের মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য এটা প্রয়োজন। তবু মাঝে মাঝেই পাক আর্মি এসে ডাক্তারদের ডেকে ধমক দিত, সতর্ক করে দিত, তারা যেন দুষ্কৃতিকারীদের সাহায্য-সহযোগিতা না করে। একদিন এক অফিসার আমার স্বামীর সামনে তার রিভলভার নাচিয়ে বলে- দেখো ডাঃ, আমার রিভলভারটা কিন্তু এখনও গরম আছে। এটা দিয়ে দিনে বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতিকারীকে আমি খতম করি। সুতরাং সাবধান! তার কথা শুনে আমার স্বামী হতবাক হয়ে যান। তবুও কোন জবাব দেননি।
৭ মে নারায়ণগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী আর পি সাহা ও তাঁর একমাত্র ছেলে রবিকে ধরে নিয়ে যায় আর এদিকে মির্জাপুরে চালায় তান্ডব। এদিকে এই ঘটনা ওদিকে আর পি সাহাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় এখানের সবাই নিজেদের অসহায় ও নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে। এরপর হাসপাতালের কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক সবাই পরিবার নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে যে-যেদিকে নিরাপদ মনে করলেন চলে গেলেন। শুধু মুষ্টিমেয় ক'জন রয়ে গেলাম। ডাঃ হাফিজুর রহমান, ডাঃ অখিল সাহা, কে সি সাহা, শিক্ষকদের মধ্যে মিস মুৎসুদ্দি, হেনা সাহা এবং আরও কয়েকজন। আমরা যারা রয়ে গেলাম আমরা আর পি সাহার পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সংশিস্নষ্ট হয়ে সার্বক্ষণিকভাবে সমপর্যায়ে সহযোগিতা করেছি। তাঁদের পরিবারে ছিল-মিসেস আর পি সাহা, শ্রীমতি সাহা ও তার চার বছরের ছেলে রাজীব সাহা, বিজয়াদি ও তার মেয়ে পুতুল, ডাঃ পতি ও মিসেস পতি ও তাদের দুই ছেলে-মেয়ে চন্দন ও ঝুমুর যে হাসপাতাল ক্যাম্পাস মানুষের (সুস্থ-অসুস্থ) আনাগোনায় সর্বক্ষণ মুখরিত থাকত, সেখানে নেমে এল মৃতু্যর স্তব্ধতা। হাসপাতাল ছাড়াও নিজস্ব পারিবারিক সমস্যাও আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। চারদিকে চাপা উত্তেজনা আর গুজব, ঘর থেকে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর্মি ক্যাম্পে। এরপর তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। ঘরে আমার দুই কিশোর পুত্র ও তরুণী মেয়ে ও ননদ।
আমার স্বামী হাসপাতালে যাওয়ার সময় বাইরের গেটে তালা দিয়ে যেতেন। যাতে পাক হানাদার মনে করে বাসায় কেউ নেই। তবুও হাসপাতাল চত্বরের ভেতর থেকে যখন গুম গুম গুলির আওয়াজ আর দূরাগত মর্টারের শেলের শব্দ শুনে খাওয়া-দাওয়া-ঘুম, আরাম-আয়েশ ভুলে আতংকের মধ্যে দিন-রাত কাটাতাম। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভয়, জোরে কথা বলা, ঘরে লাইট জ্বালানো নিষেধ, ঘরের সামনে একটা পাতা-ঝরার আওয়াজেও চমকে উঠতাম।
মনে হত বুঝি পাক আর্মির বুটের শব্দ, বন্ধ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে মৃতু্যর বিভীষিকা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে মৃতু্যর প্রতীক্ষা, মৃতু্যর ছায়ার নীচে বসবাস। এভাবে কি মানুষ বাঁচে? আমরা কিন্তু বেঁচে ছিলাম। অদ্ভুত এক সময় পার করেছি আমরা যা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষেই তা অনুভব করা সম্ভব নয়। সময় থেমে থাকে না, আপনগতিতে চলে। অতিপ্রিয় স্বজনদের, প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধবদের অসহায় মৃতু্যর রক্ত রেখা ও রুদ্ধশ্বাস প্রহরকে সঙ্গী করে আমাদেরও দিন কেটে যাচ্ছিল। এরমধ্যে এক ঝলক দক্ষিণা বাতাস মত কানে এল, ওরা এসেছে। আমাদের জীয়নকাঠি মুক্তিযোদ্ধার দল। অত:পর অজানা কুয়াশার মধ্যে একটি শব্দের জন্য প্রতীক্ষা্ব স্বাধীনতা, স্বাধীনতাঃ স্বাধীনতা। ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ প্রায় সকাল দশটার সময় মির্জাপুর বাজারের ওদিকে অগণিত মানুষের কল-কোলাহল ফেটে পড়ে। ব্যাপারে কী জানার জন্য ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে পাই টাঙ্গাইল-ঢাকা মহাসড়কে এবং পাশর্্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষের ঢল, ছত্রীসেনা ও মুক্তিসেনারা জয়বাংলা শেস্নাগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে হাসপাতালের দিকে। আমার দুই ছেলে রানা ও সেনা জয় বাংলা বলে দৌড় দিল ওই জনতার দিকে। বাধা দেওয়ার সুযোগই পেলাম না। ওর বাবাও তাড়াতাড়ি নেমে গেল হাসপাতালে। কিছুক্ষণ পর দুই ভাই ঊধর্্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে আসে আর চিৎকার করে বলতে থাকে-আম্মা- আমাদের বিজয় হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা স্বাধীন, স্বাধীনঃস্বাধীন।
======================
বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ মেরীনা চৌধুরী
গবেষক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.