সেই দিনে সেই সৌরভ

প্রায় দেড় দশকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের গুগলি, দুসরা নিতান্ত কম খেলেননি। ইদানীং নিজেই আবার একটি অনুষ্ঠানে লোকজনকে ডেকে এনে গুগলি করছেন! কাল ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই ‘গুগলি’র সামনে পড়ে গেলেন সেই সৌরভ গাঙ্গুলী, ‘বলুন তো, ঠিক ১০ বছর আগে আজকের দিনটায় কোথায় ছিলেন?’
একটু থমকে গেলেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক। উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। হঠাৎ পেয়ে গেলেন উত্তর। বোলারের মাথার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার মতো সপাট ভঙ্গিতে বলে দিলেন, ‘এই ঢাকাতে ছিলাম। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে আমি তখন ফিল্ডিং করছিলাম। আমার টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হলো।’ একটু থেমে স্বগোক্তি করলেন, ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার, সেই দিনটাতেই ঢাকায় ফিরে এলাম!’
ব্যাপারটাকে ক্রিকেট নিয়তির খেলা বলে ধরে নিতে পারেন। ঠিক ১০ বছর পর, আরেক ১০ নভেম্বর, দুপুরে ঢাকায় পা রাখলেন সেই সৌরভ গাঙ্গুলী; ১০ বছর আগে নাঈমুর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে টস করতে নেমেছিলেন যে সৌরভ।
এবার অবশ্য সঙ্গে তাঁর ব্যাট-প্যাড ভরা কফিন নেই, সতীর্থরা নেই। এবার উদ্দেশ্য বিশ্বকাপ—উপমহাদেশের বিশ্বকাপের ক্ষণগণনা উদ্বোধন। গতকাল ঠিক মাঝরাতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সৌরভের উপস্থিতিতে শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপের ‘কাউন্টডাউন।’
উপলক্ষ যা-ই হোক, সৌরভ যখন বাংলাদেশে এসেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কথা না বললে হয়! সাংবাদিকদের শুরু করতে হলো না। সোফায় এসে বসে নিজেই এটা-ওটা বলার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘জিম্বাবুয়ে কবে আসছে?’ উত্তরটা শুনে এমন একটা ভঙ্গি করলেন, যার অর্থ হতে পারে—জিম্বাবুয়ের কপালে খারাবি আছে!
বাংলাদেশের ক্রিকেট তাহলে নিয়মিত অনুসরণ করছেন? ‘করব না! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চারটে ম্যাচই দেখেছি। দারুণ খেলেছে ছেলেরা। খুব এনজয় করেছি’—সৌরভের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল, পরিচয়টা বুঝি তাঁর ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট-দূত’!
যে মিনিট পনেরো সাংবাদিকদের সঙ্গে কাটালেন, পুরোটা সময় এই ‘দূতিয়ালি’ চলল। বাংলাদেশ আদৌ উন্নতি করছে কি না—এ প্রশ্ন উঠলে যেন একটু রেগেই গেলেন, ‘অবশ্যই উন্নতি করছে। আমি যে সময় প্রথম দেখেছি, তখন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা খারাপ ছিল, এটা বলছি না। কিন্তু এখনকার এরা অনেক উঁচুমানের ক্রিকেট খেলছে। প্রমাণ তো সামনেই, নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ করে দিল বাংলাদেশ!’
কিন্তু এ তো ওয়ানডে ক্রিকেটের কথা গেল। টেস্টে ১০ বছরে কতটুকু এগিয়েছে? আদৌ কি এগোতে পেরেছে? সৌরভ ইতিবাচক কথা বলবেন, ঠিক করেই এসেছেন মনে হয়, ‘ওয়ানডের মতো এত না হলেও অল্প অল্প উন্নতি তো হচ্ছেই। ইংল্যান্ডে গিয়ে বাংলাদেশ ৩৫০-৪০০ রান করেছে। তামিম লর্ডসে সেঞ্চুরি করেছে। এটা তো অবশ্যই উন্নতির লক্ষণ। হ্যাঁ, আরও উন্নতির সুযোগ আছে। তবে সেটা তো রাতারাতি হবে না। সময় দিতে হবে।’
সময় দিতে হবে বলেও সৌরভ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, টেস্টই চূড়ান্ত কথা, ‘সব ফরম্যাটই ভালো। অর্থনৈতিক কারণে, দর্শকদের জন্য টি-টোয়েন্টি ভালো। কিন্তু মনে রাখতে হবে আসল ক্রিকেট হলো টেস্ট। টেস্টে ভালো করলে সব ফরম্যাটেই ভালো ফল আসবে।’
আশাবাদের পসরা সাজিয়ে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসা সৌরভ এবার বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের দারুণ ফলাফল দেখতে পাচ্ছেন। গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে ভারতের পরাজয়ের সাক্ষী এই বাঁহাতি বললেন, ‘আমরা সেবার খুব ধাক্কা খেয়েছিলাম। ইন্ডিয়ায় খুব প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এবারও বাংলাদেশ ভালো করবে। এই দলে তামিম-সাকিবের মতো খেলোয়াড় আছে, অনেকগুলো ভালো স্পিনার আছে, কয়েকটা ছেলে বেশ জোরে বল করতে পারে—সব মিলিয়ে দারুণ প্রতিভাবান বেশ কিছু খেলোয়াড় আছে। উপমহাদেশীয় কন্ডিশনে এরা ভালো করবেই। প্রমাণ তো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজটাই।’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিবদের পারফরম্যান্স তাহলে শুধু আমাদের বুঁদ করে ফেলেনি, সৌরভও মজেছেন। এমনই মজেছেন যে, এখন এই বাংলাদেশ দলটার অংশও হওয়ার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। উপদেষ্টা বা কোচ বা অন্য কোনো ভূমিকায় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযানে সঙ্গী হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাঁর।
নিজেই বললেন, ‘পাকা কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশ দল ভালো করছে। এই দলের সঙ্গী হওয়াটা অবশ্যই উপভোগ্য। আর আমি সব সময়ই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্যাপারে আগ্রহী।’
কতটা আগ্রহী সেটা বোঝা গেছে সৌরভ আসার আগেই এক বিসিবি কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘ও কিন্তু এই অনুষ্ঠানে আসতে একটা টাকাও নেয়নি।’ সৌরভের সামনে প্রসঙ্গটা তুলতেই লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে কি আমার টাকা-পয়সার সম্পর্ক?’
অবশ্যই না। সম্পর্কটার মধ্যে একটা আত্মার টান তো আছেই।

No comments

Powered by Blogger.