গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ

রূপকথার গল্পে পরীর অলৌকিক মায়াবী সৌন্দর্যের বর্ণনা পড়ে কত যে মুগ্ধ হয়েছে অনিক, বড় হয়ে সে সব ভেবে ওর খুব হাসি পেত। এমন সৌন্দর্য কি কোন নারীর হয়! এ স্রেফ রূপকথার বানোয়াট গল্প।

লোকের মুখে মুখে চালু হয়ে গেছে বলেই হাজার বছর ধরে নদীর মতো বহমান এ গল্প। শুনেছে কাউকে কাউকে নাকি পরীরা এসে নিয়েও যায়। সেও লোকমুখেই শোনা। আরিফ চাচা দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন তার যৌবনে। মা বলতেন, জানিস তোর আরিফ চাচাকে মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না রাতে এক পরী এসে নিয়ে যেত। গভীর রাতে দেখা যেত বিছানায় নেই, কোথাও নেই। তোর দাদীর সে কি কান্না! সারা বাড়িতে খোঁজাখুঁজি পড়ে যেত। তারপর দিনের বেলা হয়ত কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত।
কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করলে কাউকে কিছুই বলত না। শুধু বলতো বলা যাবে না। নিষেধ আছে। কেমন আনমনা হয়ে থাকত। এরকম বহুবার ঘটেছে। কিন্তু একবার দু'দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন পাওয়া গেল তখন তোর চাচার মুখে কোন 'রা' নেই। পরে তোর দাদার অনেক চাপে সব কথা বলল।
পরীদের আদর-যত্ন, নাচ, ফল, মিষ্টিসহ কত কী খাবার খেয়েছে তারও বিবরণ। তারপর থেকে আর কোনদিন তাকে পরী এসে নিয়ে যায়নি। তোর আরিফ চাচা কেমন উদভ্রান্তের মতো জীবন-যাপন করতো। আই এ পরীক্ষার পরের ঘটনা এসব। এরপর না হলো লেখাপড়া, না করলো কোন কাজকর্ম। আধপাগলার মতো নির্বাক মানুষটা দিনরাত ঝিম মেরে বসে থাকতো এখানে-ওখানে। শেষ পর্যন্ত এলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাড়ির ছেলেবুড়োরা ঘরছাড়া হলো। তোর বাবাসহ কেউ মুক্তিযুদ্ধে গেল, কেউবা এখানে-ওখানে পালিয়ে ন'মাস পার করল। শুধু তোর চাচা ঝিম মেরে বাড়িতেই। একদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা যাচ্ছিল ঐ রাস্তা দিয়ে। তখন বৈঠকখানার এক কোণে টুলে বসেছিল তোর চাচা। রাজাকারদের সঙ্গে কী কথা বললো পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারপর ধরে নিয়ে গেল। আর কোনদিন ফিরে এলো না। ঘটনাটা সবাই জানলো পাশের বাড়ির জুলেখার মার কাছ থেকে। সেই দেখেছে। অথচ জানিস দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই বললো পরী নিয়ে গেছে আরিফকে। এমনকি তোর বাবার মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষটাও। শুধু বিশ্বাস করেনি তোর দাদা। কাঁদতে কাঁদতে কেমন হয়ে গেলেন বুড়ো মানুষটা। ছেলের শোকে বছর দেড়েকের মধ্যেই মরে গেলেন।
আরিফ চাচাকে দেখেনি অনিক। পরীও দেখেনি কোনদিন। সমস্ত বিষয়টাই ওর কাছে কল্পনার। ওর কিশোর মনে পরী আর আরিফ চাচা এমন স্থায়ী একটা প্রভাব ফেলে গেছে যে, এই বয়সে এসেও ভুলতে পারেনি। পরী নামের অলৌকিক এই নারী চরিত্র নিয়ে অনেক ভেবেছে সে। যেখানেই সুন্দরী মেয়ে দেখেছে সেখানেই মিল খুঁজতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু বারবার হতাশ হয়েছে অনিক। মা'র মুখে শোনা রূপকথার গল্পের কিংবা লোককাহিনীতে পড়া পরীর অপরূপ সৌন্দর্যের যে ধারণা ওর মনে, তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই এসব সুন্দরীর। লালনের সেই গানের 'খাঁচার ভেতর অচিন পাখি'র আসা-যাওয়ার মতই অনিকের মনে রূপকথার পরী আসে-যায় বহু বছর ধরে। কিন্তু ধরতেও পারেনি কখনো আর মনোবেড়িতেও বাঁধা হয়নি।
।। ২ ।।
বহু বছর পর যেদিন 'লি'র সঙ্গে অনিকের দেখা হয়, সেদিন হঠাৎ সেই ছেলেবেলার পরীর গল্পটা মনে পড়ে গেল ওর। অনিকের জীবনটা নানা ঝড়ঝঞ্চায় বিপর্যস্ত তখন। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আলিশান ফ্ল্যাট নিয়েও একা থাকতে হয়। 'লি' তার রূপকথার পরীর গল্পের প্রেক্ষাপটটা বুঝতে হলেও আমাদের অবশ্যই আগে যেতে হবে অনিকের নিজস্ব গল্পে। গল্প বললে বিদ্রূপ হয়ে যাবে। এ বড় নির্মম বাস্তবতা। অস্থির, ডানপিটে আর দুরন্ত রেমান্টিক ছেলে অনিক। চারুকলার দুর্ধর্ষ মেধাবী ছাত্র এই অনিকের সঙ্গে কেমন করে যে পারহানার মতো শান্তনিরীহ একটি ভালো মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, সে গল্প বলতে গেলে আর এক বিশাল শাখা গল্প বেরুবে। সে গল্প হয়ত অনুষঙ্গ মাত্র, মূল প্রসঙ্গ নয়। তুখোড় আড্ডাবাজ অনিক পাস করে একটা পত্রিকায় আর্টিসট হিসেবে কাজ করছে তখন। বেশকিছু ভালো বই আর নামি লেখকের বইয়ের কাভার এঁকে নামটামও করে ফেলেছে। এরকম একটা সময়ই ওর বাড়িতে আড্ডা-ফাড্ডা বেশ জমে উঠছে রোজ। নামি লেখক থেকে তখন কবি, নামি কণ্ঠশিল্পী থেকে সৌখিন গায়ক-কাম-স্থায়ী বেকার তরুণ বন্ধুদেরও বেশ ভিড়। কেউ কেউ গেস্টরুম ছাপিয়ে ড্রইংরুমেও স্থায়ী বিছানা পেতে ফেলেছে। এটা কোন মেয়েই হয়তো পছন্দ করবে না। ফারহানাও করেনি। এ নিয়ে কতদিন যে মনোমালিন্য হয়েছে ফারহানার সঙ্গে। কিন্তু একটা সুরাহা করতে পারেনি অনিক। ওর একটাই দোষ কারও মনে কষ্ট দিতে পারে না। কাউকে কোন কিছুর জন্য 'না' বলতে পারে না। অথচ ঘরের বউ যে কষ্ট পাচ্ছে, দিন দিন বন্ধনটা শিথিল হচ্ছে, সে কথাটা ভাবার সময় হয়নি ওর। আমি যতদিন ধরে ওকে জানি তাতে এটাই বুঝতে পেরেছি। অনিকের মধ্যে একটা স্ববিরোধ আছে। একদিকে মন চায় গৃহী হতে; কিন্তু স্বভাব তাকে ঠেলে নেয় ফাউল পথে। অনেক দিনের সংসার। টানা একটা দশক। তারপরও ঠিক মেলাতে পারল না অনিক। একদিন ফারহানা ভাবী বাক্সপেটরা বেঁধে চলে যায় বাপের বাড়ি, ময়মনসিংহ। অনিক ঠেকাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। ফারহানা ভাবীর ওই এক কথা। তেল আর জল মেশে না। সম্ভবও না। তুমি পারবে না অনিক, আমি জানি তুমি পারবে না। সন্তানের কচি মুখও যখন তোমাকে উড়নচন্ডী স্বভাব থেকে ফেরাতে পারল না, তখন কী লাভ এই সংসার নামের নাটক করে? অনিক কষ্ট পেয়েছে। খুব কষ্ট। প্রথমত, একটা পাখিও দশ বছর পুষলে বড় মায়া হয়ে যায়। তা ছাড়া তার সন্তান, চার বছরের ছেলে লিপন। কিন্তু এতবড় বন্ধনের মধ্যেও কোথায় যেন একটা ফস্কাগেরো ছিল সম্পর্কে। যেন শিক্ষিত মাধ্যবিত্ত পরিবার। বন্ধন ছিঁড়ে গেলে কেমন দেখায়। লোকে কী বলবে? এভাবেই কেটে যায় দিন-মাস-বছর। দু'টি পরিবার তো দূরের কথা, জগতের একটা প্রাণীও এই ফাঁপা শূন্যতার কথা জানতো না কোনদিন। যে প্রথম জেনেছিল, তার নাম লি, অনিকের জীবনের সবটুকু জুড়ে আছে যে। আচ্ছা অনিক, তোমার ইয়ের এটা কেমন নাম অনিক? লি কোন নাম হলো? এটা তো চীনাদের নাম। শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তারপর ব্যাখ্যা দিয়েছিল অনিক। আরে বোকা! ওর আসল নাম বললে সংসার করতে পারবে? ওর হাজব্যান্ড মেরে ফেলবে না? 'লি' কেন? ও, এই ব্যাখ্যা। ও নিজেই একদিন বলেছিল, চিরদিনের ভালোবাসা অর্থ হয় এমন একটা নামে ওকে ডাকতে। 'লাভ ফর এভার' চিন্তা থেকেই লাভ (খড়াব)-এর এল আর এভার (ঊাবৎ)-এর ই। তার মানে 'লি', ও নামটার ব্যাখ্যা শুনে হেসেছে। ওর নিলুফার চৌধুরী লিনা নামটাকে চিরতরে মুছে দিয়ে অনিক এক অদ্ভুত নাম বানিয়েছে। যে কেউ শুনলে ভাববে কোন চীনা মেয়ে বোধহয়। একবার 'লি' বলেছিল, আচ্ছা তুমি যে আমার এ নামটা দিয়েছ, এটা কি নকল হয়ে গেল না? শুনে অনিক অবাক হয়েছে। নিলুফার চৌধুরী ওরফে 'লি' স্মরণ করিয়ে দিয়েছে নাসরীন জাহানের উপন্যাসের নাম। মুহূর্তে চমকে উঠেছে অনিক। ও, হঁ্যা তাইতো। তারপর ওকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছে। 'লি' উপন্যাসের 'লি' আর এই লাভ ফর এভার-এর 'লি' এক নয়। এক হতেও পারে না কোনদিন।
।। তিন ।।
যা-ই হোক, 'লি' মানে নিলুর সঙ্গে প্রথম যেদিন দেখা, সেদিনই চমকে উঠেছিল অনিক। মুহূর্তে মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলেবেলায় পড়া আর মায়ের কাছে শোনা অপরূপ সুন্দরী পরীর গল্প। যেন সেই রূপকথার পরী ওর সামনে উপস্থিত। 'লি' অবশ্য অবাক হয়েছিল পরে অনিকের কাছ থেকে পরীর তুলনা শুনে। ঐ যে রবীন্দ নাথের কবিতায় আছে না 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ। চুনি উঠল রাঙা হয়ে'- অবিকল তেমনি। অনিক যে চোখ দিয়ে যে অনুভূতি নিয়ে ওকে প্রথম দর্শনেই উপলব্ধি করেছে, তাতে জীবনানন্দের কবিতার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজকন্যাদের সৌন্দর্য কিংবা একালের বনলতার লাবণ্যেও উদ্ভাবিত হতে পারে নিলুফার ওরফে 'লি'। লি হেসেছে। ওর সঙ্গে লির পরিচয় সূত্র একটি কাব্যগ্রন্থ। নিলু কবিতা লেখে। ওর পুর্বপরিচিত একজন এই পত্রিকায়ই চাকরি করে, সেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অনিকের সঙ্গে। লির চোখে সানগস্নাস। উজ্জ্বল-ফর্সা মেয়েটির অদ্ভুত সুন্দর হাতের আঙুল-নখ থেকে ঠোঁট-চিবুকসহ সুন্দর মুখশ্রীর প্রতিটি অংশ মুহূর্তে জরিপ করে নিয়েছিল অনিকের তৃষ্ণাত্নর চোখ। 'লি' তা যে বুঝতে পারেনি, তা নয়; তবু একটা না বোঝার ভান করে খুব গাম্ভীর্যের সঙ্গে কাজের কথাটা সংক্ষেপে শেষ করল। পাণ্ডুলিপিটা উল্টেপাল্টে দেখছে অনিক। দেখতে দেখতেই বললো_ চা, কফি? কোল্ড ড্রিংকস? নো, থ্যাঙ্কস। প্রায় নিরুত্তাপ স্বরেই বলেছিল নিলুফার চৌধুরী। ভেতরটা ধক করে উঠেছিল অনিকের। চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে স্বগতোক্তি করেছে মনে মনে_ তোমাকে মানাল না। নো, ম্যাম, ইটস আনফেয়ার। তোমার মতো এক অপরূপ, তার ওপর কবি, আমার মতো একজন শিল্পীর মুখের ওপর সামান্য ভদ্রতা না দেখিয়ে 'নো' থ্যাঙ্কস' বলতেই পারে না। কিন্তু তা-ই বলে ফেলেছে লি।
প্রায় এক বছরের নি:সঙ্গ, হতাশাদীর্ণ বিবাহিত ব্যাচেলর অনিক হোসেন কয়েক মিনিট আগে যে আশ্চর্য উদ্দীপনায় নিভু নিভু জীবনে দপ করে আনন্দে জ্বলে উঠেছিল এক শীতের ভর দুপুরে, তাতে যেন এই দু'টি মাত্র শব্দ মুহূর্তে বরফ ঢেলে দিল। গম্ভীর হয়ে যায় অনিক। মুহূর্তে নিজেকে সামনে নিয়ে বলে, আপনার কাভারটা কবে চাই?
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে।
না, এক-দু' সপ্তাহে হবে না যে! আমার হাতে অনেক কাজ। নিলুফার বুঝতে পারে, পাট নিচ্ছেন শিল্পী অনিক হোসেন। সানগস্নাসটা চোখ থেকে নামিয়ে সরাসরি তাকায় অনিকের দিকে। আবার চমকে ওঠে অনিক। কী উজ্জ্বল দু্যতি চোখ জুড়ে! এবার বেশ আদুরে গলায় বলে, পিস্নজ দেখুন না, বইমেলা এসে যাচ্ছে। আর মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি। পিস্নজ দেখুন না কিছু করা যায় কি না।
অনিক জানে ইচ্ছে করলে সাতদিনের মধ্যেও করে দিতে পারে। তবু বলে, ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব। আপনার পাণ্ডুলিপিটা রেখে যান, আমাকে ডিটেইলস স্টাডি করতে হবে থিমটা। এবার তাহলে এক পেয়ালা কফি হয়ে যাক। হেসে ফেলে লি। বলে, হোক, তাহলে আপনার ইচ্ছাই জয়ী হোক।' কলিং বেল টিপে কফির অর্ডার দেয় অনিক। এরই মধ্যে টুকটাক আলাপ হয়। ভালোলাগা নামের এক অদৃশ্য সাপের দংশনে ধীরে ধীরে নীল হয়ে যাচ্ছে শিল্পী অনিক হোসেন। অনেক আলাপ হলেও কেউ কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন করে না। অনিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে পাস করেছে; নিলু পড়ছে একটা নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভাষা-সাহিত্য নিয়ে। নিলুর বাসার ঠিকানা লেখা ওর পান্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠায়। ভেতরে ভেতরে আরও চমকায় অনিক। মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে দুজনের বাসা।
কী বিস্ময়কর ব্যাপার! তারপর সেই বইয়ের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে আর নিজের ভেতর দগ্ধ হতে থাকে। এই শহরে যার তুলনা নেই। এমন একটি মেয়ের বুকের মধ্যে এত চাপা কষ্ট! এত দীর্ঘশ্বাস! এ যে দেখি নজরুলের কবিতার সখ্য 'আমারে এত সহজে বোঝা তাইতো এত লীলার ছল। বাহিরে যার হাসির ছটা ভেতর তার অশ্রুজল।' এক অন্ধকারে অথবা এক জ্যোৎস্না রাতে দুই দুঃখী মানব-মানবীর গল্প এত কাছাকাছি হয়ে যায় যে, গল্পটি প্রতিদিনের তীব্র রোমান্টিকতায়, পরস্পরকে উজাড় করে দেয়ার অপূর্ব সুখ সেখানে শেষ হলেই ভালো হতো। কিন্তু নিয়তি যার দুর্জ্ঞেয় রহস্যের মতো অনন্ত দুঃখের হাতে রাখীবন্ধন পরিয়ে দিয়েছে, সেখানে কেমন করে শেষ হবে এই গল্প?
।। চার ।।
গল্পটি শেষ না হয়ে গজায় তার আশ্চর্য সবুজ শ্যামলিমায় অসংখ্য পাতা আর ডালপালা। একটা নিবিড় ছায়ার মধ্যে সরলতা আর কৌতূহল এক সর্বনাশা খেলায় মেতে ওঠে। নিলুফার চৌধুরী হয়ে যান 'লি'। ছন্নছাড়া বাউলস্বভাবী অনিক হোসেন গুছিয়ে নিতে চান নিজেকে নতুন করে। সব দুঃখ-গস্নানি ভুলে জীবনটা নতুন করে সাজাতে চান। কিন্তু নিয়তি কোথাও চোখের আড়ালে হাসে বিদ্রুপের হাসি। আর তাই বছরের পর বছর রূপকথার চেয়ে আশ্চর্য সুন্দর সেই পরীর স্মৃতি নিয়ে আজো স্বপ্্েনর ডানায় উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয় সে।
কবিতার পাণ্ডুলিপিটা পড়ার পরে অভিভূত হয় অনিক। হূদয়ের সব রং ঢেলে দিয়ে গভীর আবেগে আঁকে একটি মনকাড়া প্রচ্ছদ। নিলুফার সেই প্রচ্ছদ দেখে মুগ্ধ হয়। সেবার বইমেলার প্রচ্ছদ শাখায় সেরা প্রচ্ছদ শিল্পীর পুরস্কার পায় অনিক। টেলিফোনে টুকটাক আলাপের মধ্য দিয়ে শিল্পী আর কবির সম্পর্কটা একটা নিবিড় বন্ধুত্বে গড়ায়। নিলুফার নামটি একদিন লি হয়ে যায়। অনিক টেলিফোনে গান শোনায় সারা সকাল। শুধু শর্ত বিকেল বিকেল ৫টা থেকে পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত ফোন করা যাবে না লি'র বাসায়। এই সময়সীমার রহস্যটা অনেকদিন রহস্যই থেকে যায়। একদিন লি ফোনে অনিককে ওর বাসায় ডাকে।
ঠিক এগারটায় ঠিকানা মতো গিয়ে চারতলার কলিংবেল বাজায় অনিক। দরজা খুলে দেয় লি। অভিভূতের মতো তাকিয়ে থাকে অনিক। যেন রূপকথার রাজ্য থেকে মেঘের দেশ থেকে নেমে এসেছে এক নীলপরী। অাঁটোসাঁটো টিশার্ট আর জিন্সের প্যান্টে লিকে অপূর্ব লাগছে। ঘরোয়া পোশাকে এই প্রথম দেখা। চোখ সরে না ওর। দু'জনই যেন অভিভূত।
হঠাৎ ঘোরটা কেটে যায় লি'র কথায়_ কী ব্যাপার এভাবে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকবেন? আসুন।
অনিক ঢুকতেই দ্রুত দরজাটা বন্ধ করে দেয় লি। বাসায় কেউ নেই। আমি একা। সো, কথা বলতে হবে খুব আস্তে। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন বারান্দা দিয়ে যাওয়া-আসা করে। ভেতরে এ সময় কেউ থাকে না। আমিও ক্লাসের চলে যাই। দেখেন না এক দরজায় তালা লাগানো।
অনিক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে_ মানে! বাসায় আপনার বাবা-মা, ভাইবোনঃ
না। কেউ নেই। আমি আর আমার হাজব্যান্ড থাকি। দেখেন না কত ছোট্ট ফ্ল্যাট। সত্যিই তো। 'লি' ঘুরে ঘুরে দেখায়। ওটা আমাদের বেডরুম। আর এটা ড্রইংরুম। আসুন।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনিক ওকে অনুসরণ করে। এটা আমার পড়ার ঘর। ওই দুটো ছোট্ট বারান্দা। যাওয়া যাবে না। বাইরে থেকে কেউ দেখলে বিপদ হবে। বাথরুমের দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁকা। ঝকঝকে বাথটাব। বেডরুমে এটি চলছে। অনিক যেন হঠাৎ বোবা হয়ে যায়। ওর মুখে কোন কথা সরে না। একটা শব্দই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়_ 'আমি আর আমার হাজব্যান্ড থাকি।' কল্পনাও করতে পারেনি অনিক লি বিবাহিত। এরপর নেশা হয়ে যায় যেন ওদের। সুযোগ পেলেই সকালে অফিসে যাওয়ার আগে অনিক ৬/৩ নম্বর বাড়িটি হয়ে যায়। ধীরে ধীরে জানা হয়ে যায় পরস্পরের জীবনের যত অনুচ্চারিত গল্প। বিস্ময়ে-দুঃখে স্তব্ধ হয়ে যায় লি। আপনার জীবনটা এমন হলো কেন বলুনতো?
অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কোন জবাব দেয় না। সেই আপনির সম্পর্ক কখন যে তুমি হয়ে যায় ওরা জানে না। অনিক ভেবে পায় না লি'র জীবনে কোন গভীর শূন্যতা, যে কারণে বিয়ের মাত্র দেড় বছর যেতে না যেতে এমন গহন গোপন পরকীয়ার বিস্ময়কর একটা সম্পর্ক হয়ে গেল ওর সঙ্গে। একি অনিকের জীবনের রিক্ততায় করুণা, নাকি লি-ও ওর মতই গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলল অনিককে?
লিকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে চায় অনিক। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা মোটেও সুখের হয়নি। একবার ভরদুপুরে এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসেছিল ওরা। দেখতে না দেখতে আশপাশের টেবিলের সব চোখ লেহন করতে শুরু করে লি-কে। প্রায় পালিয়ে আসার মতো ওরা দ্রুত বেরিয়ে আসে। আর একবার তো মাস্তান টাইপের কয়েকটা ছেলে এক রেস্টুরেন্টে টার্গেটই করে ফেলেছিল ওদের। খুব কৌশলে একটা হলুদ ক্যাবে প্রায় ঝাঁপিয়ে উঠে সে যাত্রায় রক্ষা পায়। এরপর রাজুর বাসায় এক দুপুরে গিয়েছিল ওরা। রাজু একা থাকে। সে বলেছিল আসেন কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু ঐ বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে সে কি বিপদ! লাল কৃষ্ণচূড়ার মতো টকটকে পোশাকে জ্বলন্ত একটু করো অগি্নর মতো লি-র দিকে পুরো গলির সবার চোখ।
একদিন কী ভেবে লি বলে_ কাল সকালে তোমার বাসায় আসবো। অনিক যেন সারারাত ঘুমুতেই পারে না। দু'চোখ এক হয়নি। সকালে লি আসে। গেটের মুখে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে অনিক। কারণ বাড়ির সব ভাড়াটেই জানে ওর স্ত্রী গ্রামে বেড়াতে গেছে। সে একা। সুতরাং লির মতো একটি একুশ বছরের সুন্দরীকে যদি ওর বাসায় ঢুকতে দেখে, তা হলে আর ইজ্জত থাকবে না। লি ভেতরে ঢুকে সব ঘর ঘুরে ঘুরে দেখে। বেডরুমের আলনায় পুরনো শাড়ি, পেটিকোট, ম্যাক্সি দেখে আড়চোখে তাকায়_ কই, তোমার না বউ নেই। তাহলে এগুলো কার?
অনিক সত্যি বলেও বোঝাতে পারে না যে, পুরনো এসব কাপড়-চোপড় ফেলে গেছে তার স্ত্রী। লি' কেমন শীতল আচরণ করে। পালিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে দু'জন। গোপনে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে পাসপোর্টও করেছিল। সব স্বপ্ন, সব প্রতিজ্ঞা যেন মুহূতেই কাঁচের দেয়ালের মতো ভেঙ্গে পড়ে।
এরপর হঠাৎ যোগাযোগটা বন্ধ করে দেয় লি। শত চেষ্টাতেও লিকে বোঝাতে পারেনি যে, সত্যি সত্যি অনিক ছিল বিবাহিত ব্যাচেলর। তার স্ত্রী চলে গেছে কিন্তু ওকে আর বিশ্বাস করেনি লি। কখন কবে ওরা বাসা বদল করে চলে গেছে, তাও জানে না। অনেক খুঁজেছে কোথাও সন্ধান পায়নি অনিক। এতবড় শহরে সব আছে, শুধু নেই লি।
অনিকের জীবনের সব স্বপ্ন হারিয়ে গেছে। নিয়মিত নেশা করে করে এক সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃতু্যর কাছাকাছি চলে যায়। বন্ধু-বান্ধবরা অনেক চেষ্টায় জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করলে বেঁচে গিয়েছিল সে। কিন্তু জীবনটা একেবারে অর্থহীন হয়ে যায়। ছবি আঁকা ছেড়ে দেয়। চাকরিও ছেড়ে দেয়। অন্য এক জীবন এখন অনিকের। পৃথিবীটা অর্থহীন। প্রেম এক মিথ্যে মায়া। দু'বছর উদভ্রান্ত জীবন-যাপন শেষে বাধ্য হয় চাকরি নিতে।
বহুদিন সেই দহনজর্জর জীবন কেটে যায়। প্রায় ৫ বছর পর হঠাৎ লি'র টেলিফোন। নতুন কর্মস্থলে। চমকে ওঠে অনিক। লি সব ক্ষোভ-অভিমানের কথা বলে। এত বছর পরও বিশ্বাস হল না অনিককে। এরপর প্রায় প্রতিদিন কথা হয়। জানায়, বাসা নিয়েছে ধানমন্ডিতে, অনিক আগের বাড়িতেই আছে কি না, বউ ফিরেছে কি না, অনেক কিছু জানতে চায়। অনিকের নিজের ফ্ল্যাট হয়েছে, গাড়ি হয়েছে। সবকিছু জেনে লি বলে, ভালইতো। একদিন দেখা হতে পারে না? অনিক অভিমানে বলে, থাক না। কে চায় হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।' একদিন মহাখালী রেলক্রসিংয়ে বিস্ময়ে অনিক দেখে চারটা গাড়ির পরের গাড়িতে বসা লি। মোবাইলে কথা হয়। তবু দেখা হয় না। আবার বহুদিন যোগাযোগহীন। হঠাৎ একদিন ওভারসিজ কল। লি জানায় ওরা এখন অস্ট্রেলিয়ায়। একটা দীর্ঘশ্বাসে বুকটা বিদীর্ণ হয়ে যায়। সেই অস্ট্রেলিয়া-যেখানে যাওয়ার কথা ছিল। ওর একটি ছেলে হয়েছে। বয়স এখন পাঁচ। সব শুনে কেবল একটা কথাই মনে হলো, লি সত্যি সত্যি একটা পরী_ যে কেবল কল্পনার। বাস্তবের কেউ না।
==========================
গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন  গল্প- 'সুচ' by জাফর তালুকদার   গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান  গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার  গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল  গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ  গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত  গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া  গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী  গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায়  গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী  সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ নাসির আহমেদ


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.