নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী

দুলাল : ২৫/৩০ বছরের যুবক (গ্রামের পালা গানে প্রম্পট মাস্টার ছিল, পরে যাত্রাদলের বিবেক হয়।)
আসমা : ২০/২২ বছরের দুলালের প্রতিবেশীর চাচাতো বোন। দুলালকে আসমা ভালবাসে।
কুলসুম : ৪০/৪৫ বছরের আসমার মা।

রমজান : আসমার বাবা।
বিউটি : ২০/২২ বছরের যাত্রাদলের নায়িকা।
আশেক : ৪০/৪৫ বছরের প্রৌঢ়, গ্রামের পালা গানের প্রথম ম্যানেজার।
নিজাম : ৪০/৪৫ বছরের প্রৌঢ়, গ্রামের পালা গানের দ্বিতীয় ম্যানেজার।
মজিদ : ৩০/৩৫ বছরের আসমার বড় বোনের স্বামী যে তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আসমাকে বিয়ে করে।
শবদর : আসমাদের বাড়ির কাজের লোক।
বেলাল ও হেলাল : শিশু চরিত্র।
বজলু : যাত্রা দলের ম্যানেজার ১
বাদশা : যাত্রা দলের ম্যানেজার ২
নুরা : গ্রামের পালা গানের একজন সদস্য।
আরও কিছু গ্রামের লোক যাদের চরিত্রের পরিপূর্ণতা এই নাটকে নেই। তবে তাদের উপস্থিতি আছে।
দৃশ্য-১
বিকাল। আসমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল দুলাল। আসমা দুলালের জন্যই অপেক্ষা করছিল। দুলাল গান গাইতে গাইতে একটি আম গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। আসমা আমগাছটির পাশেই লুকিয়ে ছিল।
দুলাল : দাদা আর যাবো না ঐ ইস্কুলে তেঃ এ্যাঃ
আসমা : (গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে হাসতে হাসতে) তাইলে কই যাইবা? মাদরাসাত যাইবা?
দুলাল : (হাসে) এইটা হইল গুনাই বিবির গান। জানোস না?
আসমা : হ জানি। আমি কী গুনাই বিবির পালা দেহি নাই? তুমি প্রম মাস্টার অইয়্যা চকির কোণায় বইয়্যা পাট কইয়া দিলা। আমি দেহি নাই?
দুলাল : (হেসে) তুই দেখছিলে? আমারে তো আগে কস নাই।
আসমা : গুনাই বানানডা কেমনে করছিল?
দুলাল : (হাসে) এইডা সব জায়গায় কওন যায় না। হাসির কথা। পালা গানে এমন হাসির কথা কওন লাগে।
আসমা : থাক না কইলা। আমি তো জানিই। (অন্যমনস্কভাবে) একটা কথা কইলে রাখবা?
দুলাল : ক দেহি। তোর কোন কথাডা আমি রাহি নাই? তুই অইলে গিয়া
আসমা : থাওক এক কথা আর কতবার হুনবাম। আমার কথা হুনো। (মুখে মিষ্টি হাসি। মান অভিমান ভরা) তোমার গলাডা মাসালস্না খুব ভালা। প্রম মাস্টাররে কেউ ইসটেজে দেহে না। আমার ভাল লাগে না। ইসটেজে না উটলে গানের দলে থাইক্যা লাভ কী?
দুলাল : তা তো বুঝলাম, তয় আসল কথাডা কহ দেহি?
আসমা : তুমি বিবেকের পাট করতা ফারো না? বিবেকের গান আমার খুব ভালা লাগে। বিবেকের গান (অন্যমনস্ক হয়)
দুলাল : (অন্যমনস্কভাবে। আকাশের দিকে তাকায়। তার মধ্যে অজানা শিহরণ) আমার গান তোর কাছে ভালা লাগে?
আসমা : বুঝো না? সবকিছু কওন লাগে? বুঝো না? আচ্ছা যাইঃ আমি যাই। আমার কথাডা ভাইব্যা দেইখো।
দৃশ্য-২
রাত। দুলালের ঘর। একটা কুপি বাতি চকির পাশে জ্বলছে। দুলাল শুয়ে আছে। তার চোখে ভেসে আসছে বিকালের আসমার কথা বলার দৃশ্য।
আসমা : তুমি বিবেক হইত্যা ফারো না? বিবেকের গান আমার কাছে খুব ভালা লাগে।
(দুলাল গুনগুন করে একটা বিবেকের গানে টান দিবে যা স্পষ্ট হবে না) তার চোখে আবার ভেসে আসবে প্রম মাস্টারকে স্টেইজে দেহা যায় না। স্টেইজে না দেহা গেলে দলে থাইক্যা লাভ কী?
দৃশ্য-৩
রাত। আশেকের বাড়ির বৈঠকখানা। কয়েকজন গ্রামের লোক আড্ডা দিচ্ছে। দুলাল দূর থেকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকবে।
দুলাল : আশেক ভাই। ও আশেক ভাই।
আশেক : দুলাল নাহিরে? মনে খুব উলস্নাস মনে অইতাছে। আয় হুনি কী খবর?
দুলাল : (পাশে বসে) আশেক ভাই, আমি আর প্রম্পট মাস্টারি করতাম না।
আশেক : ক্যান্? তর আবার কী অইলো? তুই প্রম মাস্টারি না করলে আর কেউ আছে? গাঁওয়ে আর কেডা আছে?
দুলাল : এই চিন্তা ফরে অইবো। মানুষ খুঁইজ্যা দেহোন লাগবো। আমারে বিবেকের পাট দিলে আমি দলে আছি না অইলে দলে নাই।
আশেক : দলে নাই কইলেই অইলো? দল ছাড়ন কী সোজা কথা? গুনাই বিবির দল অহন গেরামের ইজ্জত। পাচ গাঁও তো মানুষ আইয়ে দল ভাড়া করতো। আর তুই অহন ছব্দি নব্দির কতা কস। আর বিবেকের গান গাইবিঃ তাইলে ছবেদ আলী বিবেক কী করবো?
দুলাল : হে গাইবো না। তারে অন্য ফাট দেও।
আশেক : তুই কইলেই অইবো? গাওয়ে থাকতে অইলে দশের কথা হুনুন লাগবো। নিজের মতে কিছু করলে গাওয়ে থাহোন যাইবো না? তাছাড়া গেরামে আর কোনো মানুষ নাই যে তর মত দুই অক্ষর ফড়ছে।
দুলাল : গাওয়ে থাহোন যাইবো না কেন? গাও কি তোমার একলার?
আশেক : একলার অইবো কেন? একলার অইবো কেন? তয় এই দলের গান অহন গাওয়ের ইজ্জত। তোরে যে কাম দেওয়া অইছে হেই কামই করবি। এর বেশি আর কোনো কথা নাই। এইডাই আমার শেষ কথা।
দুলাল : আমি বিবেকের ফাট ছাড়া প্রম মাস্টারি করুম না এইডাও আমার শেষ কথা। চিন্তা কইর্যা বেয়ান বেলা কইবা। আমি যাই। বেয়ানে না কইলে বৈহালে আমি মানিকগঞ্জ যাইয়াম। যাত্রা দলে যোগ দিবাম।
(দুলালের প্রস্থান দেখা যাবে। আশেক মুখ গোমড়া
করে বসে থাকবে।)
দৃশ্য-৪
সকাল। আসমা পুকুরের ঘাটে পানি আনতে গেছে। দুলাল পুকুরের পাড়ে চিন্তাযুক্ত অবস্থায় বসে আছে।
আসমা : (কলস হাতে) পেচার মত থোম ধইর্যা বইয়্যা আছো কেন্। কী অইছে তোমার?
দুলাল : আয়। বোহালে আয়। (আসমা গিয়ে দুলালের পাশে বসে) দল ছাইড়্যা দিতাছি।
আসমা : কেন, দল ছাড়বা কেন? দল ছাড়া তুমি বাঁচবা কেমনে? গান ছাড়া তুমি বাঁচবা কেমনে?
দুলাল : আমারে বিবেকের ফাট দিত না। অহন চিন্তা করতাছি মানিকগঞ্জ যামু, যাত্রাদলে।
আসমা : (চিন্তিত হয়ে পড়ে। চোখেমুখে কালো ছায়া) তুমি বাড়ি ছাইড়্যা যাইবা? তয় আমি থাকুম কেমনে?
দুলাল : আমি কী চিরদিনের লাইগ্যা যাইতাছি। যহন গান না অইবো তহন তো বাড়িতে থাকবাম।
আসমা : দল ছাড়লে দলের মাইনসে তোমার ক্ষতি করবো না?
দুলাল : ক্ষতি আবার কী? আমি কি কেউ'র রায়তে থাহি? আমার ক্ষতি করবো কেন?
আসমা : দলের কথা মত না চললে দলের মাইনসে কী ক্ষতি করে তুমি জানো না? তুমিও তো আগে করতা। ক্ষেতের ধান কাইট্যা লইয়্যা যাইতা, খাসী ধইর্যা লইয়্যা যাইতাঃ আরও কত কী?
দুলাল : (হাসে) হ যা। এইসব করলেও আমি বিবেকের ফাট করুম। তোর মনের আউশ যদি আমি মিডাইতে না ফারি তাইলে আমার কী দাম রইলো? আমার জীবনের দাম কী অইলো?
আসমা : আমার কথায় তুমি দল ছাড়বা, বাড়ি ছাড়বা? আমার কেমন লাগতাছে। তোমারে বাড়িত না দেখলে আমার কেমন লাগে আমি জানি না। অহন গেরাম ছাইড়্যা যাইবা? না, আমার কেমুন লাগতাছে।
দুলাল : বিবেক না অইলে মনে শান্তি ফাইতাছি না। তুই চিন্তা করিস না। সামনের বছর ঘরো ধান তুইল্যা তরেও ঘরে তুলাম। চাচা-চাচি তো রাজিই আছে।
আসমা : যাও সব কথা সব সময় কওন লাগে না। শরম লাগে। (আসমা চলে যায়। পুকুরের পানির দিকে চেয়ে থাকে দুলাল। দেখা যাবে দুলালের চোখের মত পুকুরের পানিও স্থির।)
দৃশ্য-৫
আসমার মা কুলসুম রান্না করছে। এই সময় আসমা পানির কলস নিয়ে বাড়িতে ঢুকবে।
দৃশ্য-৬
দুপুর। দুলাল নিজের ঘরে চকির ওপর বসে আছে। আসমার মা কুলসুম এই সময় গিয়ে উপস্থিত হয়।
কুলসুম : মানিকগঞ্জ যাও নাহি। আসমা কইলো।
দুলাল : হ। চাচি। মানিকগঞ্জ যাইতাছি।
কুলসুম : নিজের গাওয়ের দল ছাইড়্যা বিদেশে যাইবা। তোমার চাচা কইলো নিজের গাওয়ের দলেরই তো নাম অইতাছে। অহন হিরেবার বিদেশে যাওন লাগে কেন?
দুলাল : আশেক ভাইয়ের সাতে রাগারাগি অইলো। আমি হেরে শেষ কতা কইয়্যা আইলাম। গাওয়ের দলে থাকতাম না।
কুলসুম : গাওঅলার সাতে রাগ আছে। নিজের দলের মানুষ মাইন্যা নেওন লাগে।
দুলাল : হের সব কতা হুনন লাগবো। আমার দেমাগ কমনি। অহন দেহোক বই ফরনের মানুষ ফায়নি। অন্য গেরাম তো বিছরাইয়া আনন লাগবো।
কুলসুম : তুমি যা ভালা মনে কর তাই করো। তোমার চাচার সাতে একটু বুইজ্যা লইত্যা। বেয়ান থেইক্যা আসমার মন খারাপ। হের বিষয়ডাও তো দেহা দরহার।
দুলাল : আমি কি চিরজীবনের লাইগ্যা বিদেশে যাইতাছি। সবেমাত্র কিছু দিন।
কুলসুম : আচ্ছা যাও। যাত্রা দলে নারী পুরুষ এক সাতে থাহে। একটু দেইক্যা হুইন্যা থাইকো।
(কুলসুম চলে যায়। দুলাল স্থির হয়ে বসে থাকে।)
দৃশ্য-৭
দুপুর। আশেক আরও কয়েকজনের সাথে বসে তাদের পুকুর পাড়ে কথা বলছে।
আশেক : দুলালের ভাবসাব ভালা ঠেকতাছে না। হে আর আমার সাতে যুগাযুগ করল না। খবর ফাডাইলাম, তও আইলো না। ব্যাপারডা সুবিধার মনে অইতাছে না।
নিজাম : তুমি কইলে কয়েকটা ঘাড়ালি দিয়া লইয়া আই।
আশেক : না, ঘাড়ালি দেওন লাগবো না। নিজে নিজেই সিধা অইবো নে। লেহাফড়ার দেমাগ দেহাইতেছিনি তাও বুঝাতাছি না।
অন্যজন : চিন্তার কিছু নাই। কত ঘাড়তেড়া দলের ডলায় সিধা অইছে ঃ আর অহন দুলালঃ।
দৃশ্য-৮
দুলাল বাড়ি থেকে বের হবে। আসমা পথের দিকে চেয়ে থাকবে। তার চোখ টলটল করতে থাকবে।
দৃশ্য-৯
বিকাল। আশেকের বাড়ি। বজলু মানিকগঞ্জের একটি যাত্রাদলের ম্যানেজার।
দুলাল : আমার নাম দুলাল উদ্দিন। সাকিন নান্দাইল। আফনের কাছে আইলাম আফনের দলে একটা ফাট যদি দিতাইন। আমি যাত্রাদলে কাম করনের লাইগ্যা বাড়ি ছাইড়্যা আইলাম।
বজলু : যাত্রা দলে কাম করতে হলে এই রকম গেরাইম্যা ভাষায় কথা কইলে তো হবে না বাপু। তোমাকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। বলো দেখি তুমি কী অভিনয় করছো?
দুলাল : (অফ ভয়েস) শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা দরহার। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারবো তো। আমি গান গাইতে পারি। বিবেকের গলা খুব ভালা।
বজলু : ভালা মানে কী? বলতে হবে ভাল।
দুলাল : জে ভাল।
আশেক : একটা গানে টান দাও দেখি তোমার গলা ঠিক আছে কি না?
দুলাল : (গানে টান দেয়) ভোলা মন মন রে আমার ঃ
আশেক : গলা ভাল। কিন্তু তোমার আরও প্র্যাকটিস করা দরকার। যাত্রা দলের বিবেক হল একটা ইমপরটেন্ট ক্যারেক্টার। তারপর আমার দলে যে বিবেক আছে তারে বাদ দিয়ে তোমাকে নেওয়া সম্ভব না। (একটু কী যেন চিন্তা করে।) শুনো দুলাল উদ্দিন। আমার এক বন্ধু আছে নরসিংদির। তার সঙ্গে একটু আলাপ করে দেখো। তার একজন ভাল বিবেক দরকার। আমার কথা বলবে।
দুলাল : তাইলে আমি নরসিংদী যাই। তানার নাম টিকানা একটু লেইক্যা দেন।
দৃশ্য-১০
বিকাল। মজিদ তার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছিল। পথে আশেকের সঙ্গে মজিদের দেখা।
মজিদ : সস্নামুলাইকুম। ভাইছাব ভালা আছুইন?
আশেক : মজিদ না? ভাল আছেন নি জামাই? অনেক দিন পরে দেহা। ছেরা দুইডা কেমন আছে?
মজিদ : জী ভাই ছাব। ভালা আছে।
আশেক : মা মরা এতিম বাচ্চারা ভাল থাহে কেমনে? (অফ ভয়েস: একটা বুদ্ধি দেওয়া যায়) বিয়া সাদীর চিন্তা ভাবনা করতাছেন নি?
মজিদ : জী না ভাইছাব। সৎ মায়ের কাছে ছেলে দুইডারে তুইলা দিতে মন চায় না। আদরের বদলে বে-আদর অইলে জানে সইতো না।
আশেক : সৎ মা কী সবাই খারাপ অয় নি? দুনিয়াতে যেমন ভাল মানুষ আছে আবার খারাপ মানুষও আছে। আমি একটা কথা কই। আসমা তো নিজের মানুষই। নিজের বইনের সন্তানরে তো আদর না কইরা ফারতো না। তার ব্যাপারে চিন্তা কইর্যা দেহেন না।
মজিদ : এইডা তো বেসম্ভব ব্যাফার। আসমা অহনো ছোড। আমার বয়স বেশি। বয়সের একটা মিল তো থাহন লাগে।
আশেক : পুরুষ মাইনসের আবার বয়স কী? আসমা ছোড এইডাও ঠিক না। আফনে চিন্তা কইর্যা দেহেন ঃ আমরা আফনেরে সাহায্য সহায়তা করার লাগলে করাম নে। রমজান চাচারে রাজি করনের দায়িক্ত আমি নিমুনে।
মজিদ : (অফ ভয়েস) কথাটা খারাপ কয় নাই। আমি তো চিন্তাই করি নাই। নিজের মানুষ, বোনের সন্তান তো নিজেরই সন্তান। হে তো কুলেফিডে কইরা বড় করছে।
আশেক : কী চিন্তা করতাছেন? এত চিন্তা করনের কিছু নাই। আফনে চেষ্টা কইর্যা দেহেন ঃ তারা রাজি না অইলে আমরা তো আছি। রাজি করানোর দায়িত্ব আমার উপরে ছাইড়্যা দেন।
দৃশ্য-১১
রাত। তার শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে কথা বলে।
মজিদ : জিলু আর বেলালের দেখশন কে করে? আমি তো মহা বিপদে ফরছি বাছাব।
রমজান : তোমার তো অহন বিপদই দেখতাছি। হেরারে এইহানে রাইখ্যা যাও। আর হোনো মজিদ। তুমি আমার নিজের সন্তানের মত। আমার মেয়ের কপাল খারাপ মারা গেছে। তার আয়াত নাই। কি করবা বাবা? তোমার আর বয়স কী অইলো? তুমি আর একটা বিয়া সাদীর চিন্তা করো।
কুলসুম : তাই করো বাজান। আমার মাইয়্যার আয়ু নাই কি করবা? চিকিৎসার তো আর অভাব রাহো নাই। তুমি একটা বিয়া সাদী করো। জিলু আর বেলালের মুখের দিকে চাওন যায় না। ছেওড়া পোলা দুইডার দেখশন অহন বড় দায়িত্ব অইছে।
মজিদ : আম্মাছাব, মনে বেশি সায় দেয় না। সৎ মা জিলু আর বেলালরে যদি ঠিকমত দেখশন না করে তাইলে কী অইবো? অনেক সংসারে তো দেখলাম। সৎ মায়ের যন্ত্রণায় পোলাপান নষ্ট অইয়্যা যায়।
রমজান : সব সৎ মা কী আর এক রহম অয়? ভালা বংশ দেইক্যা একটা মেয়ে দেহো। আমরা তো তোমার আত্মীয় হিসাবে একটা দায়িত্ব নিবুই।
মজিদ : আচ্ছা একটু চিন্তা করি আগে। অহন জিলু আর বেলাল আফনেরার কাছে থাহুক কিছু দিন। পরে দেহা যাইবো। বাছাবঃ
রমজান : কও। কি চিন্তা করোঃ কও হুনি।
মজিদ : আসমা তো নিজের মানুষই। আফনেরা যদি আসমারে ঃ
রমজান : (চিন্তাযুক্ত। কিছুক্ষণ কেটে যায়)ঃ আসমা কী রাজি অইবো?
মজিদ : আমার সন্তানের দায়িত্ব যদি হে নিতো তয় নিচিন্ত অইতাম। আসমাও তো কুলেফিডো কইর্যা বড় করছে এরারে। তার কি একটু দুগ-দরদ নাই? আমার নিষ্পাপ পোলা দু'ইডারে কার আতো তুইলা দেই? কার উফরে ভরসা আছে?
কুলসুম : কথাডা ফালাইনা না। আমরা একটু চিন্তাভাবনা কইর্যা দেহি। তুমি যাও। অনেক রাইত অইলো। ঘুমাও গেয়া।
দৃশ্য-১২
রাত। বাদশার বাড়ির বৈঠক ঘর। আরও কয়েকজন তার পাশে বসে আছে। বাদশা নরসিংদির একটি যাত্রাদলের ম্যানেজার।
বাদশা : তোমার গলা ভাল। আমার পছন্দ অইছে। তবে তোমার প্র্যাকটিস করন লাগবো। আর শুনো দুলাল।
দুলাল : জে বলেন।
বাদশা : যাত্রা শুরু হয় কার্তিকের শুরু থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত চলে। আমরা যারা দল করি ছয় মাস গান গাই আর ছয় মাস বাড়িতে থাকি। আশ্বিন মাস থেকে বায়না শুরু হয়। এই পর্যন্ত তুমি আমার এখানে থাকবা। গলা ঠিক করবা। কী রাজি আছো?
দুলাল : জে রাজি আছি।
বাদশা : তাহলে কথা শেষ। তুমি আমার এখানেই থাকবা। দলের আরও কয়েকজন এখানে আছে, তাদের সঙ্গে থাকবা, গান করবা, রিহার্সাল দিবা।
দুলাল : জী আচ্ছা।
দৃশ্য-১৩
রাত। রমজান আর কুলসুম ঘরে। কুলসুম রমজানের হাতে পানের খিলি তুলে দিচ্ছে।
কুলসুম : জামাইয়ের কথাটা কিছু ভাবতাছো?
রমজান : হা। ভাবতাছি। আসমা রাজি অইবো কি না হেইডাই বড় কথা। দুলালের সাথে তার ভাব ছোড বেলা থেইক্যা। আমার ইচ্ছা আছিল দুলালের সাথে বিয়া দেওনের।
কুলসুম : জিলু আর বেলালের চিন্তা অহন বড় চিন্তা। ছেলে দুইডা আর ফর না। ছোডটা তো আসমার হাতেই বড় অইলো। তুমি রাজি অইলো আমি আসমার সাথে কথাডা কইয়্যা দেহি। কি কও?
রমাজন : হুম। আচ্ছা। কও দেহি। তার মত কী?
দৃশ্য-১৪
দুপুর। বাদশার বাড়ির বৈঠকখানায় অনেক লোক এসেছে। তারা যাত্রার রিহার্সাল দিবে। তাদের মধ্যে বিউটিও আছে।
বিউটি : নতুন বিবেক। নিজের বিবেক ঠিকঠাক আছে তো?
দুলাল : বিবেকের বিবেক ঠিক থাকবো না তয় ভিলেনের বিবেক ঠিক থাকবো?
ভিলেন : দেখেন দুলাল ভাই, ভিলেনরা মঞ্চে খারাপ হলেও আসলে কিন্তু ওরা খুব ভাল মানুষ। যাত্রার চরিত্র দিয়া কিন্তু আসল চরিত্র বোঝা ঠিক না।
দুলাল : তা ঠিক।
বিউটি : কী ঠিক? অন্য মানুষে যা কয় সাথে সাথে ঠিক কন কেন? একটু চিন্তা করে কথা বলবেন না?
(সবাই হেসে উঠে। বাদশার আগমন)
বাদশা : এত হাসি কেন? নে রিহার্সাল শুরু কর। সাতটা বইয়ের রিহার্সাল। গোলাম-এ-আজম শেষ করলি?
বিউটি : এইডা তো এক মাস আগেই শেষ। আপনের তো কিছুই মনে থাকে না দেখছি।
বাদশা : মনে ঠিকই আছে। নতুন পেস্নয়ার আসছে। তারে নিয়ে আবার নতুন করে কর। নতুন পেস্নয়ারের একটা মর্যাদা আছে না?
বিউটি : নতুন পেস্নয়ার নিজে নিজে করুক। একজনের জন্য এতজনের খাটানি ঠিক না।
বাদশা : (মুখে হাসি) খাটানি না রে বিউটি। রিহার্সাল যত বেশি হবে পালা তত জমবে। নে শুরু কর। জমা পালা জমা টাকা। হে হে হেঃ।
দৃশ্য-১৫
রান্না ঘরে আসমা তার মা'র পাশে বসে আছে। তার মা তরকারি কুটছে।
কুলসুম : পোলা দুইডা অহন বিষ ফোড়া অইলো? নাড়ির রক্তের এতিম দুইডা দুয়ারে দুয়ারে কান্দিয়া ঘুরে। মা'র অভাব কেমনে ফুরন অয়? সংসারে সৎ মা আইবো, কেমন মা আইয়ে কে জানে? জামাইও বিয়া করতো রাজি অইতাছে না। অহন এই পোলা দুইডা কী মরবো?
আসমা : মরবো কেন? দুলা ভাইয়ের কও আর একটা বিয়া করতো। দুনিয়াতে ভালা মানুষ নাই? মা, বেলালের মুখটা দেখলে আমার মনডা কেমন যেন করে। কষ্টে বুকটা ফাইটা যায়।
কুলসুম : হে হওয়ার পর থাইক্যা তো তোর হাতেই এইটুকু অইলো। কষ্ট তো লাগবোই রে মা। বইনের সন্তান আর নিজের সন্তান তো একই। (কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে যায়) মারে একটা কথা কই?
আসমা : কী, মা?
কুলসুম : জামাইয়েরে আমরা দেখলাম এত বছর। নিজের সন্তানের মত। মজিদ কেমন তুইও তো জানোস। তার বিপদে আপদে আমরা যদি কাছে না দাঁড়াই তাইলে মনিস্যির পরিচয় অইলো?
আসমা : কেন আমরা তো আছিই। সব সময় দেখাশোনা করতাছি। বেলালরে দু'বছর আমি পালছি। আর কী?
কুলসুম : বেলালের কষ্ট কী তর ভালা লাগে? পেটের ক্ষিধায় নাহি কানতে থাহে। একটা মানুষ নাই তারে খাওয়ায়।
(কিছুক্ষণ নীরবতা, কুলসুম চোখ মুছে) কইছিলাম কিঃ তুই যদি রাজি থাহোস মজিদের কাছেঃ
আসমা : আমারে বিয়া দিবাঃ তাই না? এইডা অইবো না মা। দুলা ভাইয়ের কাছে আমার বিয়া অইবো না।
কুলসুম : এমন শক্ত কথা কইস না তো। বেলাল নাহি সাত দিন দইর্যা জরে ফইর্যা রইলো। মুখে যে একটু ফানি দিবো এমন মানুষটাও নাই।
আসমা : মা, এমন কথা কইবা না তো। দুলা ভাইয়ের বিয়ার লাইগ্যা অন্য মাইয়্যা দেহো।
দৃশ্য-১৬
(এক বছরেও দুলাল আসমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। আসমার মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে থাকে। আসমা একটা গাছের নিচে বসে আছে। সে ভাবছে দুলালের কথা।)
আসমা : মানুষটা এক বছর অইলো গেলঃ আছে না মরছে? একবারও বাড়িত আইলো না? যোগাযোগ করল না?
( চোখের সামনে ভাসছে সে বিবেকের গান গাইছে)
দৃশ্য-১৭
মজিদ তার ছোট ছেলে বেলালকে কাঁধে করে নিয়ে আসমাদের বাড়ি আসে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখা যাবে। ক্লোজ শটে শেষ হবে।
দৃশ্য-১৮
আশেকের বাড়ির আঙিনা। কয়েকজন বসে আছে। তাদের চোখেমুখে হতাশা।
নুরা : আশেক ভাই, প্রম মাস্টারের লাইগ্যা কি পালা বন্ধ অইয়্যা যাইবো? এইডা কেমন কথা? গাওয়ের দুন্মাম অইবো না।
নিজাম : আরে আশেক ভাই, গয়েসপুরের মঞ্জুরে দলে নেন তো। হে খুব ভালা প্রম মাস্টার।
নুরা : হা। তাই করেন। দুলালের লাইগ্যা দল ভাঙবো এইডা কেমুন কথা? মাইনসের কথা গায়ে সয় না।
আশেক : কথা ঠিকই কইছিস। আমি মনে করছিলাম দুলাল ফিইর্যা আইবো। হে তো আইলো না। অহনঃ ঠিক আছে, দেখ দেহি কী করন যায়? মঞ্জুর সাথে যোগাযোগ কইর্যা দেখ।
দৃশ্য-১৯
দুপুর। আসমাদের বাড়ির বারান্দা। আসমা বসে আছে। আসমার পাশে পাশে মজিদের ছোট ছেলে। দাঁড়িয়ে আছে।
মজিদ : তোমার ভাইগ্না তুমি দেখ। আমি আর পারছি না। খালি কান্দে। কী করবা করো? এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য, সংসার- অন্য দিকে এই ছেরা দুইডারে লইয়্যা ছিদ্দতের শেষ নাই।
আসমা : আমারে দাবি ছাইড়্যা দিয়া দেন তাইলে তো অয়। এত ছিন্তা করন লাগে না। হি হি হি ঃ
মজিদ : দিয়া তো দিলাম। তোমার কাছে তো দিয়া দিতেই চাই। তুমি তো নিতা চাও না।
আসমা : মতলবী কথাবার্তা মনে অইতাছে।
মজিদ : মতলবী অইবো কেন? তোমার বইনের ছেরা তোমার কী এটকু দরদ লাগে না? শুধু আমারই দরদ আর কষ্ট?
আসমা : থাকুক আমার কাছে। ফরে বড় অইলে নিয়া যাইবাইন। আর কথা কীয়ের?
মজিদ : তা তো বুঝলাম। কিন্তু বড়ডার কী অইবো? হের অহন স্কুলে যাওয়া লাগবো। কে দেহে?
আসমা : নিজের চিন্তা করুইন। সব চিন্তা আমার করন লাগবো?
মজিদ : তুমি কিছু ভাবছো? বাছাব কিছু কইছে? আম্মাজান?
আসমা : কইছে। তয় আমার উপরে চোখ পড়লে চোখ গাইল্যা দিমু কিন্তু। হি হি হি ঃ
দৃশ্য-২০
বিকাল। মজিদ আশেকদের বাড়ির সামনে দিয়ে নিজের বাড়িতে যাচ্ছিল। পথে আশেকের সঙ্গে দেখা।
মজিদ : সস্নালামু আলাইকুম। কেমন আছেন ভাইছাব?
আশেক : ভাল। ভাল আছি ভাই। আপনে কেমন আছেন?
মজিদ : জী ভালা।
আশেক : আসমার ব্যাপারে কিছু অইলো? আপনি কি কথা বলছেন?
মজিদ : জী বলছি। কিন্তু আসমা রাজি অইতাছে না।
আশেক : রাজি অইতাছে না কেন? কী কয়?
মজিদ : কী আর কয়। কয় তার দিহে না তাহানোর লাইগ্যা।
আশেক : (অফ ভয়েস) মনে হয় অন্য পথ ধরতে হবে। (মজিদের দিকে ফিরে) আফনে যান। আমি একটা ব্যবুস্থা করবো।
মজিদ : জী।
আশেক : (অফ ভয়েস) কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। হঠাৎ কিছু করলে সন্দেহটা বাড়বে।
দৃশ্য-২১
বিকাল। দুলাল আর বিউটি কথা বলছে ম্যানেজারের বাড়ির বৈঠকখানায়। সামনে একটা ঢোল, হারমোনিয়াম।
বিউটি : গানের গলা তো ভালই মাশালস্না। দলে চিরদিনের জন্য চলে আসেন। নাকি মাছরাঙ্গা পাখির মত ফুরুৎ করে ডুব দিয়ে মাছ ধরে আবার চলে যাবেন?
দুলাল : চিরদিনের জন্যই তো চলে আসলাম। চলে যাবো না। আছি।
বিউটি : আপনে যদি চিরদিনের জন্য চলে আসেন তাহলে এমন বিবেক বানাইবো যা আর কোনো দলে নাই। দুলাল বিবেকের নাম শুনলেই দলের ম্যানেজার পাগল হয়ে যাবে।
দুলাল : আমি তো এমন একজন বিবেকই হইতে চাই।
বিউটি : তাহলে আমার কথা মতো চলবেন। আপনার গলার মত কোনো বিবেকের গলা হয় না।
দুলাল : তাই হবে বিউটি। আমি বড় স্বপ্ন নিয়া বাড়ি থেকে বের হইলাম। আমার স্বপ্ন তুমি পূরণ কইরা দিও।
বিউটি : এখন যান। রাতে আবার রিহার্সাল হবে। রাত জাগতে জাগতে এখন নিশাচর পেঁচা হয়ে গেছি। হি হি হি ঃ।
দৃশ্য-২২
রাত। আসমা বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে একটি কুপি বাতি জ্বলছে।
আসমা : মানুষটা কী অইলো? এত দিন কী কইর্যা আমারে না দেইক্যা থাহেঃ। কেমনে পারেঃ? আসমা চোখ মুছে। কিছুক্ষণ পরে সে বাতিটি নিভিয়ে দেয়।
দৃশ্য-২৩
সকাল। বিউটি আর দুলাল একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বিউটির মাথায় লাল ফিতের দুটি বেণি। কাঁধের দু'পাশ দিয়ে দু'টি বেণি পড়ে আছে।
বিউটি : মনে হয় সারাক্ষণ কী যেন ভাবেন। কী চিন্তা করেন এমন মশগুল হয়ে।
দুলাল : অনেক কিছু চিন্তা করি। তবে আমার মাথায় এখন শুধু গান আর গান। বিবেকের গান। এই গান আমি শুনাবো ঃ
বিউটি : তা পারবেন। তবে কঠিন হূদয়ের মানুষে গান গাইতে পারবে কি না আমার সন্দেহ আছে।
দুলাল : কী বললা? কালকে কী বললা আর আজকে কী বললা। এর মানে কী?
বিউটি : বুঝেন না। সেদিন চাঁদনি রাতে বললাম বাইরে গিয়ে বসি পুকুরে ঘাটে। আপনি গেলেন না। যাত্রা দলে কাম করলে এত দেমাগ থাকলে চলে। আচ্ছা বলেন তো, আপনে বিবেকের পার্ট নিতে আইলেন কেন? আপনে তো নায়কের পার্টও নিতে পারেন।
দুলাল : (লজ্জিত মুখে) আরে আমার চেহারা নিয়ে নায়ক হওয়া যায় নাকি? পাগল।
বিউটি : আর্ট ফিলিমের নায়কের চেহারা কী আপনের চেয়ে ভাল? ফিলিম দেখেন না?
দুলাল : তুমি বড় বেশি জ্ঞানের কথা কও। আমি এসব বুঝি না। বিবেক অইলাম অন্য কারণে।
বিউটি : কী কারণে? কী কারণে? বলেন না?
দুলাল : না, বলা যাবে না। সব কথা বলা ঠিক না। একটা কথা জিগ্যেস করবো?
বিউটি : করেন।
দুলাল : তুমি আমার বালিশের নিচে সেদিন ফুল রাখছিলা না?
বিউটি : যে ফুলের মর্যাদা দিতে জানে না তার কাছে ফুল দিতে যাবো কেন? আচ্ছা আপনের কাউকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে না? প্রেমে না পড়লে যেমন কবিতা লিখা যায় না ঠিক তেমনি প্রেমে না পড়লে ভাল গায়কও হওয়া যায় না। শুধু শুধু কষ্ট করে লাভ নাই। বাড়িতে চলে যান।
(বিউটি চলে যায়। দুলাল তার দিকে তাকিয়ে থাকে।)
দৃশ্য-২৪
বিকাল। আশেকের বাড়িতে নুরা।
আশেক : নুরা একটা কাজ করতে হবে। পারবি তো।
নুরা : না পারার মত কাম নি? কন দেহি পারি কি না?
আশেক : আসমার বাপের গিয়া কইয়্যা আইবি, দুলাল যাত্রার নায়িকারে বিয়া করছে। হে আর দেশে আইবো কি না সন্দে। নিজের চোখে দেখা। নরসিংদী জেলায় বর্তমান ঠিহানা।
নুরা : এইডা কোনো কাম অইলো। আফনে বইন দেহি অহনি কইয়া আই।
আশেক : তুই কইবি নিজের চোখে দেহা। আমার কথা কইতে পারবি না কিন্তু।
নুরা : নুরারে চিনলেন না অহনও। মনে অয় আফনের জরম্মই অয় নাই। খালি চাইয়্যা চাইয়্যা দেহেন কি অইতাছে।
দৃশ্য-২৫
বিকাল। আসমাদের বাড়ি। বাড়ির আঙ্গিনায় দেখা যাবে আসমার বাবার সঙ্গে নুরা কথা বলছে। আসমা পাশে দাঁড়িয়ে শুনছে। কিছুক্ষণ পর আসমা দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যাবে। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে বেলাল। সে বেলালকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভিতরে ঢুকে যাবে। দরজা বন্ধ হয়। ক্লোজ শট হবে বন্ধ দরজায়।
দৃশ্য-২৬
দুলাল বাজার থেকে আসবে। তার হাতে তাঁতের শাড়ি। বিউটি তার পাশে এসে দাঁড়াবে।
দুলাল : দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। সময় কীভাবে চলে যায়। সময়ের পিছে দৌড়েও পারা যায় না। (একটু থেমে) দেখো তো শাড়িটা কেমন হলো? খুব সুন্দর না?
বিউটি : আমার জন্য আনলেন? শুধু শাড়ি? আর কিছু না?
দুলাল : না, তোমার জন্য না। শাড়ি আনছি অন্য এক মানুষের জন্য। যে আমারে তোমাদের নাম করা বিবেক বানাইলো তার জন্য। যে আমারে বিবেক হওয়ার স্বপ্ন দেখাইলো তার জন্য।
বিউটি : নাম করা বিবেক তো হলেন। এখন তার জন্য আর কিছু আনবেন না।
দুলাল : আর কী বলে তো?
বিউটি : আর কী? একটা টিকলি। সোনা দিয়ে বানাইতে না পারলে রূপা দিয়ে। আর কিছু লাগবে না। হিন্দু হলে বলতাম শাঁখার চুড়ি আর সিঁদুর।
দুলাল : হবে হবে। সব হবে। একদিন সব হবে। বিউটি একটা কথা তো বলা হল না। আগামী শুক্রবার বাড়িতে যাবো। এক সিজনের গান তো শেষ হল। আগামী সিজনের জন্য আবার তিন মাস পরে আসবো।
দৃশ্য-২৭
দুপুর। রমজান আর মজিদ পাশাপাশি বসে কথা বলছে। তাদের কথা আর কিছুই না। আসমা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে সে খবরটা দিতেই আসছে।
রমজান : জামাই বাবা, আসমা যখন নিজেই কইলো বিয়ার কথা তয় আগামী শুক্রবারেই বিয়ের কাজটা শেষ কইর্যা ফেলো। বেশি ঝামেলা না কইর্যা কয়েকজন নিয়ে চলে আসবা। আর আমরা আত্মীয়-স্বজন কয়েকজনকে বলবো।
মজিদ : বাছাব, ঝামেলা করলেও হয় না করলেও হয়। আমার ভাগ্য খারাপ আমি আবার বিয়া করতাছি। কিন্তু আসমার তো প্রথম বিয়া। তার তো একটা স্বাদ আহলাদ আছে। আফনে চিন্তা করবেন না। বিয়ের সব ব্যবস্থা আমি করতাছি।
রমজান : না, আমিও যা পারি খরচাপাতি করবো। তোমার সব ব্যাফারে দায়িত্ব নেওন লাগবো না।
মজিদ : না, বাছাব, আমি সব ব্যবস্থা করবো। আফনের কিছুই করন লাগবো না।
রমজান : ঠিক আছে, আমি অহন যাই। আগামী শুক্রবারেই দিন তাহলে ধার্যত হইলো।
দৃশ্য-২৮
বিকেল। দূর থেকে দেখা যাবে দুলাল আসছে। তারপর ক্যামেরা আসমাদের বাড়ির আঙ্গিনার শট নিবে। দুলাল ধীর গতিতে ফুরফুরে মেজাজে আসতে থাকবে। তার কাঁধে একটা পুটলা। বাড়ির কাছে এসে সে চমকে দাঁড়াবে। চারটি কলা গাছ দিয়ে বিয়ের গেইট বানানো। একটা বাঁশের খাপ দিয়ে বাঁকা করে দু জোড়া কলাগাছের সঙ্গে লাগানো। তার উপর লিখা আছে "আসমার শুভ বিবাহ"। দুলাল আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকবে। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। লিখাটির উপর ক্লোজ শট হবে। দুলাল ঘুরে দাঁড়াবে।
(পাঁচ বছর পর।)
দৃশ্য-২৯
গভীর রাত। চারদিকে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে। দুলাল দৌড়ে আসবে। তার গলায় একটা সাদা চাদর দুদিকে ঝুলানো। মুখে মেকআপ। মাথায় সাদা পাগড়ী। সে যাত্রাদলের বিবেক। যাত্রাদলে কিছু লোকের আক্রমণে সে পালিয়ে এসেছে। দুলাল আসমাদের বাড়ির বাইরে ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করে। ঘরের ভিতর থেকে একজন লোক ডেকে ওঠে। তার নাম শবদর। সে আসমাদের বাড়ির কাজের লোক।
শবদর : কে, কে? এত রাইতে কেডা গো?
দুলাল : ভাই ঝাপটা একটু খুলেন। আমি খুব বিপদে পইড়্যা আইছি। ঝাপটা খোলেন।
শবদর : (ঝাপ খুলে) ঘরে আইয়েন। আফনে কেডা?
দুলাল : (হাঁপাতে থাকে। শবদর বাতি জ্বালায়।) আমি যাত্রাদলের বিবেক। দলে মানুষে আক্রমণ করছে। সব তছনছ। ভাই একটু আশ্রয় দেন। কাইল সকালেই চলে যাইমু। আপনার পায়ে পড়ি। আমার জীবন বাঁচান।
শবদর : আরে আফনে যাত্রাদলের বিবেক! খুবই আচার্য কথা। এমুন মানুষরে জাগা দিমু না? কি কইলাইন ভাই? আফনে আমার সাতে থাহেন। আফনার কোনো ভয় নাই।
দুলাল : (বিছানার পাশে বসে) একটু পানি দিবেন ভাই।
শবদর : আরে বিবেক ভাই? আফনেরে একটু ফানি খাওয়ানো আমার যে ভাগ্যি। (শবদর তার মাথার দিকে লক্ষ্য করে দেখে কপাল বেয়ে রক্ত বের হচ্ছে।) আরে বিবেক ভাই, আফনের মাথাত তো রক্ত বার অইতাছে? ঘটনা কী?
দুলাল : হ ভাই। মানুষে ইট দিয়া ঢিল দিল। একটা ঢিল মাথায় লাগলো। জানের ভয় থাকলে এই সব ঢিল শরীরে লাগলে বোঝা যায় না। তহন টেরই পাই নাই। অহন পাইতাছি।
শবদর : আরে বিবেক ভাই। আফনে কোনো চিন্তা করবাইন না। আমি থাকতে আফনের কোনো ভরসা নাই।
দৃশ্য-৩০
শবদর একটা এ্যালুমিয়ামের জগ দিয়ে দুলালকে পানি দিবে। দুলাল জগ ঢেলেই ঢকঢক করে অনেকটা পানি খেয়ে নিবে। দুলালের মাথায় একটা পট্টি দিবে শবদর। একটু পরে শবদর দুলালকে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শোবে। কুপি বাতিটা নিভে যাবে।
দৃশ্য-৩১
সকাল। বাড়ির লোকজন এখনও জেগে ওঠে নি। দুলাল জেগে উঠেছে। শবদরও জেগে উঠেছে। দুলাল বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দুলাল : আপনেরে অনেক ধন্যবাদ। আপনে আমার জীবন বাঁচাইলেন। এখন যাই।
শবদর : আরে, বলেন কী? গিরস্থের বাড়িত থাইক্যা মুখে কিছু না দিয়া চইল্যা যাইবাইন, গিরস্থের অমঙ্গল অইবো না? কুষাইট লাগবো না? নাস্তা পানি খাইয়্যা আস্তে ধীরে যাইবান। দেহি মাথার ব্যবস্থা কী (সে দুলালের কপালে হাত দেয়)? আরে জরে তো শইল পুইর্যা যাইতাছে। আফনের আইজ যাওয়া অইবো না।
দুলাল : দলের মানুষের কী অবস্থা তা না জানলে নিমক হারামী হবে ভাই। আমি তো বিবেক। আমার বিবেক আছে না?
(হাসতে চেষ্টা করে কিন্তু হাসতে পারে না।)
শবদর : আফনের কোনো কথাই আমি হুনতাম না। জীবন বাঁচলে বিবেক, না বাঁচলে কিয়ের বিবেক। (শবদর বের হয়ে যায়।)
দৃশ্য-৩২
সকাল। আসমা রান্নাঘরে নাস্তা বানানো নিয়ে ব্যস্ত। শবদর আস্তে আস্তে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায়।
আসমা : কী কিছু কইবা শবদর?
শবদর : জে, চাচি জী। বাড়িতে একজন মেমান আছে। দু'জনের নাস্তা লাগবো।
আসমা : এত বেয়ানে মেমান আইলো কইতো? কেডা?
শবদর : যাত্রাদলের বিবেক। (আসমার মুখ হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে যায়)। রাইতে যাত্রাদলে গণ্ডগোল অইলো। দলের মাইনষেরে মানুষরে মারলো। হে মাইর খাইয়্যা পলাইয়্যা শেষ রাইতে এইহানে আশ্রয় লইল।
আসমা : যাত্রাদলের বিবেক! (তার চোখে-মুখে বিস্ময়) তোমার চাচা বাড়িত নাই। মেমানরে নাস্তা খাওয়ায়া বিদায় দেও। তুমিও তো কামে যাইবা।
শবদর : হ চাচি জী। আমিও কামে যাইয়াম। তয় লোকটারে বিদায় দেওন যাইতো না। হের মাথা ফাডা। শইলো খুব জর। মানুষটারে এমনে ছাড়ন ঠিক অইবো না।
আসমা : খালি বাড়ি (বিস্ময়)! অসুখ থাকলে যাইবোই কেমনে? আগে নাস্তাফানি খাওক ফরে জ্বর কমলে যাওনের কথা। জ্বর না কমলে যাওন ঠিক অইবো না।
দৃশ্য-৩৩
সকাল। শবদর দুলালকে নাস্তা খাওয়ায়। দুলাল এতটা অসুস্থ যে, সে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। সে একটু সামান্য পিঠা মুখে দিয়েই আবার শুয়ে পড়ে।
শবদর : অহন একটা ঘুম দেন। জ্বর কমলে যাইবাইন। আর হুনুইন। আমি একটু ফরে গঞ্জে যাইতাছি। আমি গেলে চাচা বাড়িত আইবো। তয় আফনের কোনো ছিন্তা নাই। চাচি খুব ভালা মানুষ। দেখশোন করবে নে। যাই অহন।
(দুলাল শুয়ে পড়ে)
দৃশ্য-৩৪
রাত। আসমা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে। সে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে ঘরের মধ্যে ব্যাকুল হয়ে ঢুকে পড়ে।
আসমা : তাইলে তুমি অহনও বাইচ্যা আছো?
দুলাল : হা। কে, কে গো? (চোখ বন্ধ)। তোমার কথা তো খুব চেনা মনে অইতাছে, কে গো তুমি?
আসমা : আর কে? তুমি কি আর আমারে অহন চিনবা? যাত্রাদলের নায়িকারে বিয়া করলা, সংসার করলা। অহন কী আর আসুরে চিনবা?
দুলাল : (চোখ খুলে) আসু! তুই আসমা? (বিস্ময় ভরা চোখ)। আমি যাত্রাদলের নায়িকারে বিয়া করলাম, সংসার করলাম এই সব কী কইতাছোস রে আসমা? তোর কি মাথাডা ঠিক আছে? তরে কেডা কইলো?
আসমা : ক্যান নুরা কইলো। নুরা নিজের চোখে দেখছে তুমি যাত্রাদলের নায়িকারে বিয়া কইর্যা সংসার করছো।
দুলাল : নুরা দেখলো? নুরা কইলো? এসবের তো আমি কিছুই জানি না।
আসমা : মিছা কতা কওনের সময় মানুষ এমুনই কয়। কিছুই জানে না। ফরে আস্তে আস্তে সব সইত্য বাইর অয়।
দুলাল : নারে আসমা মিছা কথা কই নাই। আমি বিয়া করি নাই। (কিছুক্ষণ থেমে) আমি নিজের সাফাই গাইতে এইহানে আই নাই। এইডা তোর বাড়ি রাইতে চিনতে ফারি নাই। চিনলে কী আর এই বাড়িত আইতাম? মনে অয় কানাওয়লা লইয়্যা আইছে। দেহা যহন অইয়্যাই গেল তয় হোন সব কথা। তুই বিশ্বাস কর, আমি বিয়া করি নাই। তোর স্বপ্ন সাধ পূরণের লাইগ্যা বিবেক অইলাম আর তোরেই আমি ফাইলাম না। এই দুঃখে অহন আর বাড়িমুহা অই না। তুই ভালা আছোস আসমা?
আসমার স্বামী মজিদ এই সময় বাড়ি এসে ঢুকে। সে গঞ্জে কাজ করে। সে ঘরের আলাপ আলোচনা শুনে।
আসমা : তাইলে নুরা এমুন মিছা কতাটা কইল? হায়রে কপাল আমার! বিয়ার ফর থাইক্যা একটা রাইত শান্তিতে ঘুমাইতা ফারি না। খালি শনায় দেহি তুমি বিবেকের গান গাইতাছো। আর হেই গানের মধ্যে আমার কথা। কানে বাজে তুমি আমারে লইয়্যা গান বানছো। (আসমার চোখে পানি, কণ্ঠে আড়ষ্টতা) সফন ভাঙলে ছায়া দেহি তুমি নাই। তহন মনে অয় বুহের ভিতরটা ভাইঙ্গা যাইতাছে। এমুন কইর্যাই কতডি বছর গেল গা। (আসমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।) কেমনে কি অইয়া গেল কিছুই বুঝি নাই। কিছুই বুঝি নাই।
আসমা চোখেমুখে কাপড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়। ঘরের দরজায় ঠিক দাঁড়িয়ে আছে মজিদ। আসমা নির্বাক হয়ে যায় তার স্বামীকে দেখে। সে তার স্বামীর দিকে তাকায়। শট আস্তে আস্তে ক্লোজ হবে। আসমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এরপর ফ্রিজ হবে।
============================
গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন  গল্প- 'সুচ' by জাফর তালুকদার   গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান  গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার  গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল  গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ  গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত  গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া  গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী 


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ মোজাম্মেল হক নিয়োগী


এই নাটক'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.