ছেলেবেলার গল্প' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

আমার ছেলেবেলা কেটেছে সিলেটে। শহরটা ছিল ছিমছাম, ছবির মতো। পাড়ায় পাড়ায় খেলার মাঠ ছিল, মাঠেই কাটত সারা বিকেল, ছুটির দিন। পাড়ার বন্ধুরা ছিল, ছিল স্কুলের বন্ধুরাও। স্কুলের জীবনটাও ছিল আনন্দময়। যেসব শিক্ষককে আমরা পেয়েছিলাম স্কুলে, তাঁদের কোনো তুলনা হয় না। যেমন মঈনুদ্দিন স্যার। ধার্মিক মানুষ ছিলেন, কিন্তু মনটা খুবই উদার। মাঝেমধ্যে ক্লাসে আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, একটা ভালো কাজ আর একটা খারাপ কাজ। কে কি করেছিস এ কদিনে, সেগুলো নিয়ে বল দেখি? ভালো কাজের প্রশংসা করতেন, খারাপ কাজের কৃপণ বর্ণনা শুনে হাসতেন আর বলতেন, এমন কাজ আর করবি না। একদিন প্রদীপ জানাল স্যারকে, আজ ভালো একটা কাজ করেছি, স্যার।
কী কাজ?
মায়ের জন্য পূজার ফুল তুলে এনেছি।
বাহ্! স্যার বললেন, খুব ভালো। আর খারাপ কাজ?
ফুলগুলো চুরি করেছি, স্যার!
মঈনুদ্দিন স্যারকে একদিন জানাল হীরা। আমার মা অনেক উল্টাপাল্টা কাজ করেন, স্যার।
আচ্ছা!
রাতে যখন চোখে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না, তখন ঘুমাতে যেতে জোর করেন। আর সকালে যখন কিছুতেই চোখ খুলতে ইচ্ছে হয় না, তখন তুলে দেন। কী রকম উল্টাপাল্টা না, স্যার?
সাইফুলকে জন্মদিনে তার এক মামা একটা মাউথ অর্গান কিনে দিলেন। মাউথ অর্গানের তখন খুব চল। আরেক মামা দিলেন একটা কলম। আরও কে কী দিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, জন্মদিনের সবচেয়ে ভালো উপহার কোনটি রে?
সাইফুল বলল, অবশ্যই মাউথ অর্গান।
তা বটে। খুব সুন্দর জিনিসটা।
আরে না, সাইফুল বলল, এটি না বাজানোর জন্য আপা আমাকে সপ্তাহে আট আনা করে দিচ্ছে যে!
আমাদের অঙ্ক করাতেন আশরাফ স্যার। একদিন বললেন, আজ হালকা যোগ-বিয়োগের অঙ্ক। তোরা বেসিকটাই জানিস না। সব ইডিয়ট! ঠিক আছে বল দেখি, তিনটা গাধা আর তিনটা খচ্চর মিলে কত প্রাণী?
নোমানী বলল, স্যার, ছয়টা।
না। স্যার কঠিন হেসে বললেন। উত্তর হচ্ছে, তোদের ফার্স্ট বেঞ্চ। এরপর আমাদের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর তিনটা গরু আর তিনটা ছাগল মিলে?
আলমগীর বলল, অনেক দুধ, স্যার।
স্যারের মুখে আর কথা জোগাল না।
একদিন সিরাজ দুঃখ করে বলল, ইতিহাসটা বড়ই গোলমেলে। যদি এক হাজার বছর আগে জন্ম নিতাম, কত কম ইতিহাস শিখতে হতো, তাই না?
আমাদের বন্ধু বোগদাদী ছিল স্বাস্থ্যবান, মোটাসোটা কিন্তু অলস প্রকৃতির। তার স্কুল মোটেও পছন্দ হতো না। একদিন মান্নান স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কী রে বোগদাদী, তোর নাকি স্কুল পছন্দ না?
কথাটা ঠিক না, স্যার। স্কুল মাঝেমধ্যে আমার খুব পছন্দ।
কখন রে? স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
যখন বন্ধ থাকে, স্যার।
আমাদের স্কুলে একটা বিষয় চালু হলো একবার, যাকে সম্ভবত ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট বলা হতো। ওই ক্লাসে চামড়ার কাজ, কাঠের কাজ ইত্যাদি শেখানো হতো। একদিন একটা কাঠে পেরেক ঠুকছিল ফারুক। স্যার তাকে বললেন, সাবধান। পেরেকে হাতুড়ি পেটাতে গিয়ে আঙুল যেন থেঁতলে না যায়।
ফারুক বলল, তাহলে আলাউদ্দিনকে ডেকে আনি, স্যার? ও না হয় পেরেকটা ধরুক!
ফারুক আর আলাউদ্দিন প্রায়ই মারামারি করত। আমাদের রসায়নের শৈলেশ স্যার একদিন আলাউদ্দিনকে বললেন, তোর গার্জিয়ানকে একটা খবর দে তো। দেখি তারপর তুই কী করিস।
আলাউদ্দিন বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, আই অ্যাম মাই ওউন গার্জিয়ান স্যার। সেদিন স্যারের পিটুনি খেয়ে আলাউদ্দিনের কথার রসায়ন বদলে গিয়েছিল।
বদরের মাঝেমধ্যেই নতুন নতুন শখ চাপত মাথায় এবং সেগুলো যেভাবেই হোক সে মেটাত। একদিন সে রিকশা চালানো শিখছিল। পাড়ার রিকশাচালক বাবু ভাইকে আট আনা পয়সা দিয়ে রিকশাটা নিয়ে আমাকে সিটে বসিয়ে সে চালাচ্ছিল। হঠাত্ বদরের চিত্কার। মনজুর লাফ দে, লাফ দে। ওই ল্যাম্প পোস্টটা সোজা আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে।
বদর উঁচু দেয়ালের ওপর হাঁটছে দেখে খালাম্মা খুব রেগে গেলেন। ঠিক আছে, তিনি বললেন, পড়ে গিয়ে যদি পা দুটি ভেঙে ফেলো, আমার কাছে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসো না।
২.
আমার মা খুব সংসারবিরাগী ছিলেন, কিন্তু সংসার কীভাবে যেন চালিয়েও নিতেন। ফেরিওয়ালারা নানা জিনিস নিয়ে আসতেন মায়ের কাছে। এক ডিমওয়ালা নিয়মমতো ডিম দিয়ে যেতেন। একদিন তিনি তিনটা ডিম দিয়ে এক হালি ডিমের দাম নিয়ে গেলেন।
মা প্রথমে খেয়াল করেননি। যখন খেয়াল করলেন, ডিমওয়ালা চলে গেছেন। পরে যখন তিনি এলেন, মা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনটা ডিম তিনি কেন দিয়েছিলেন।
একগাল হেসে ডিমওয়ালা বললেন, খালাম্মা, একটা ডিম পচা ছিল তো, সেটা আমি ফেলে দিয়েছিলাম।
আমাদের বাসার নারকেল গাছ পরিষ্কার করতে আসত গাছিরা। দুই পায়ে দড়ি লাগিয়ে দুই হাতে গাছ ধরে তারা উঠত। একদিন দুই গাছি এল। একজন খুব কাঁচা। মাত্র গাছ বাওয়া শিখছে। পাকা লোকটা ওপরে উঠে গেছে, কাঁচাজন একটু নিচে। তার দড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে সে বলল, দড়ি যদি ছিঁড়ে যায়, কী হবে?
কী হবে, অর্থাত্ নির্ঘাত পড়ে যেতে পারে। কিন্তু ওপরের পাকা লোক বলল, আরে ভয় পেয়ো না। আমার এক্সট্রা দড়ি আছে।
৩.
শহরের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ছিলেন কালা ডাক্তার সাহেব। তাঁর গাত্রবর্ণের জন্য এই নাম। রসিক মানুষ ছিলেন। একদিন এক লোক এসে তাঁকে বলল, ডাক্তার সাহেব, আমি চোর। আমাকে একটা ওষুধ দেন, যাতে চুরি রোগটা সেরে যায়।
ওষুধ বানাতে বানাতে ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী চুরি করো? যা সামনে পাই, সে বলল। তারপর অনেক দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার ওষুধে রোগটা যদি না সারে, ডাক্তার সাহেব?
তাহলে ওই যে ওইখানে, পপুলার ওয়াচ আছে, সেখানে ঢুকবে, ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আর একটা রোলেক্স ঘড়ি আমার জন্য নিয়ে আসবে।
সব শেষে মন্টু মামার গল্প। অকৃতদার মন্টু মামা ছিলেন আমাদের বন্ধু, অভিভাবক ও দার্শনিক। একদিন পাড়ার মাঠে মেলা বসেছে, আর একটা নাগরদোলা সব বাচ্চার আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা নাগরদোলায় উঠতে গিয়ে দেখি মন্টু মামা বসে আছেন একটা আসনে, পাক খাচ্ছেন আর ওয়াক ওয়াক করে অল্প অল্প বমি করছেন। অনেকক্ষণ ধরে এ রকম চলার পর যখন নাগরদোলাটা একটু থামল, আমরা মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী মামা, খারাপ লাগছে তো নেমে যান না কেন? শুধু শুধু বমি করছেন?
আরে নামব কী, আরও ১০ মিনিট আমাকে বসে থাকতে হবে না? এই ব্যাটা আমার কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়েছিল এটি বসানোর সময়। এখন বলছে ফেরত দিতে পারবে না। এখন এটিতে চড়ে আমার ১০ টাকা উসুল করছি।
======================
একটি ভাদ্র মাসের গল্প' by আতাউর রহমান  আলোচনা- 'কবিতার জন্মকথা' by আবদুল মান্নান সৈয়দ  কিশোর উপন্যাস- 'জাদুর পাখি' by সোলায়মান আহসান  সম্পূর্ণ কিশোর উপন্যাস- 'হলুদ পিশাচ' by রকিব হাসান কিশোর উপন্যাস- 'সূর্যোদয়ের দিনে' by জুবাইদা গুলশান আরা কিশোর উপন্যাস- 'জোলা পালোয়ান' by আতা সরকার  কিশোর উপন্যাস- 'আমাদের টম কে জানো' by আবদুল হাই শিকদার  মানসভ্রমণ- 'বেলবটম, পা ইত্যাদি' by আফজাল হোসেন  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ এক প্রসন্ন কল্লোল'  পল্লীভ্রমণ: 'দ্বীপ মনপুরার টানে' by মৃত্যুঞ্জয় রায়  তিনটি কবিতা by ওমর শামস  কবিতাত্রয়ী by টোকন ঠাকুর ও কামরুজ্জামান কামু  কবিতা- 'নিরাকারের মুখ' by সৈয়দ তারিক  ছয়টি কবিতা' by গোলাম কিবরিয়া পিনু  কবিতা- 'স্বর্ণজল্লাদ' by পিয়াস মজিদ




প্রথম আলোর সৌজন্যে
লেখকঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.