এনগুগি ওয়া থিওংগ্’ও-এর গল্প ‘ফেরা’

সে লম্বা পথ পাড়ি দিচ্ছিল। পা ফেলা মাত্র ধুলো লাফিয়ে উঠে তার পিছনে ছুটছিল, তারপর পুনরায় থিতিয়ে আসছিলো। তাসত্ত্বেও পাতলা পর্দার মত ধুলো বাতাসে ঝুলে ছিল এবং ধোয়ার মত নড়ছিল। ধুলো এবং পায়ের নিচের মাটির দিকে খেয়াল না করে সে তার হাঁটা অব্যাহত রাখে। তবে প্রতি পদক্ষেপে সে তার পায়ের তলার মাটির কাঠিন্য এবং আপাত বিদ্বেষের বিষয়ে ক্রমাগত ভাবে সচেতন হয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটে, বরং সে তার দৃষ্টি সামনের দিকে সোজা প্রসারিত করে রাখে যেন সহসাই সে এমন কোন বস্তু দেখতে পাবে যা তাকে বন্ধু বলে স্বাগত জানাবে এবং বলবে যে, সে বাড়ির কাছে এসে গেছে। কিন্তু রাস্তা শেষ হয় না।

সে দ্রুত এবং আলতো পায়ে হাঁটে, বাঁ হাতটা তার দেহের কোটের পাশে দোল খায়, যে কোটটা একদা সাদা ছিল, বর্তমানে ছিঁড়ে ক্ষয়ে গেছে। তার ডান হাত কনুইয়ের কাছে বাঁকা হয়ে ঈষৎ কুঁজো পিঠের ওপর রাখা একটি বোচকার দড়ির প্রান্ত ধরে রাখে। বোচকাটা একটি সুতি কাপড় দিয়ে ভালভাবে জড়ানো, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া যে-কাপড়ে একদা ছাপানো লাল ফুল ছিল; বোচকাটা তার চলার ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে দোল খায়। এই বোচকা বন্দি শিবিরে কাটানো তার বছরগুলোর তিক্ততা আর কষ্টের স্মৃতি বহন করে। বাড়ির পথে সে মাঝে মাঝে সূর্যের দিকে মুখ তুলে দেখে। কখনো কখনো সে দ্রুত বাঁকা চোখে নিচু ঝোপঝাড়ে পূর্ণ লম্বা চিলতে জমির দিকে তাকায়, এই জমি, জমির রুগ্ন দেখতে ফসল, ভুট্টা, শিম এবং মটরশুটিসহ অন্য সবকিছুর মতই লাগে — অবন্ধুসুলভ।

সমগ্র দেশটাকেই বিবর্ণ এবং ক্লান্ত দেখায়। অবশ্য কামাউ-এর কাছে এটা নতুন কিছু ছিল না। তার মনে পড়ে যে, এমনকি মাও মাও জরুরি অবস্থার আগেও বসতিপূর্ণ এলাকার বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের তুলনায় অতিকর্ষিত গিকুয়ু জমিগুলো দেখতে ছিল বিধ্বস্ত চেহারার।

রাস্তাটা দুভাগ হয়ে একটি শাখা বাঁ দিকে চলে গিয়েছিল। সে একমুহূর্ত ইতস্তত করে চিনতে পারে। প্রথমবারের মত তার চোখ দুটো কিঞ্চিত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যখন সে এই পথ ধরে, যে-পথ উপত্যকার ভেতর দিয়ে তাকে গ্রামে নিয়ে যাবে। অবশেষে বাড়ি নিকটবর্তী, এই বোধের ফলে তার চেহারা থেকে ক্লান্ত পথিকের আনমনাভাব কিছুক্ষণের জন্য দূর হয়। চতুর্পার্শ্বের জনপদের সঙ্গে দুই ধারে গাছপালাসহ উপত্যকাটির খুব বেশি পার্থক্য ছিল। এখানে সবুজ ঝোপঝাড় এবং গাছপালা সতেজভাবে বেড়ে উঠেছিল। এর একটিই অর্থ ছিল : হোনিয়া নদী এখনো প্রবহমান। সে তার পদচালনা দ্রুততর করে, মনে হয় যেন নদীর ওপর দৃষ্টি স্থাপনের আগে সে বিষয়টি একদম বিশ্বাস করতে পারছিল না। এটা এখনো রয়েছে; এটা এখনো প্রবাহিত হয়, যেখানে সে সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে এর জীবন্ত ঠাণ্ডা পানির ভেতর ডুব দিয়ে প্রায়ই গোসল করেছে, শিলার পাশ দিয়ে এর সর্পিল ভঙ্গিতে বয়ে চলা দেখে এবং মৃদু মর্মর ধ্বনি শুনে হৃদয় উষ্ণতায় ভরিয়ে নিয়েছে। তার অস্তিত্বের ওপর দিয়ে এক বেদনার শিহরণ খেলে যায়, এবং একমুহূর্তের জন্য সেসব দিন ফিরে পাওয়ার জন্য তার মন কেঁদে ওঠে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হয়তো নদী তার রুক্ষ হয়ে ওঠা চেহারার ভেতর থেকে সেই বালককে চিনে নিতে পারবে না, নদীপাড়ের পৃথিবী যার কাছে সবকিছু ছিল। তবু সে যখন হোনিয়ার নিকটবর্তী হয়, সে এর প্রতি এমন একাত্মতা বোধ করে যা সে মুক্তির পর থেকে অন্য কোন কিছুর প্রতি করে নাই।

একদল মহিলা পানি ভরছিল। সে উত্তেজিত বোধ করে, কারণ সে দূর থেকে এদের দুই/একজনকে চিনতে পারে। এদের ভেতর ছিল মাঝ বয়স্ক ওয়ানয়িকু, যার বধির ছেলেকে সে নিজে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী হত্যা করে। এই মহিলা সবসময়ই ছিল গ্রামের সকলের প্রিয়, কারণ সকলের জন্য তার মুখে ছিল হাসি এবং আতিথেয়তার মন। তারা কি তাকে গ্রহণ করবে? তারা কি তাকে “বীরের অভ্যর্থনা” প্রদান করবে? সে এরকম চিন্তা করে। সে কি সবসময়ই এই উপত্যকার আশেপাশে সর্বত্র জনপ্রিয় ছিল না? এবং সে কি জমির জন্য লড়াই করে নাই? তার ইচ্ছা হয় দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে: “এই যে আমি, আমি এসে গেছি” কিন্তু সে নিজেকে নিবৃত্ত করে। কারণ সে পুরুষ মানুষ।

“তুমি ভাল আছ?” কেউ কেউ সাড়া দেয়। অন্যরা, তাদের ক্লান্ত এবং বিবর্ণ চেহারা নিয়ে তার দিকে বোবার মত তাকায়, যেন তার সম্ভাষণের কোন প্রভাব তাদের ওপর পড়ে না। কেন! সে কি ক্যাম্পে এত লম্বা সময় ধরে ছিল? তার উৎসাহ স্তিমিত হয়ে আসে এবং সে নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে: “আমারে তোমরা চিনতে পারতাছ না?” তারা পুনরায় তার দিকে তাকায়। তাদের দৃষ্টি শীতল এবং কঠিন, সবকিছুর মত, মনে হয় যেন তারা ইচ্ছাকৃতভাবে চিনতে পারে না এবং গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। ওয়ানয়িকু অবশেষে তাকে চিনতে পারে। কিন্তু তার কণ্ঠে কোন উৎসাহ অথবা উষ্ণতা দেখা যায় না যখন সে বলে “আরে তুমি, কামাউ? আমরা ভাবছিলাম যে তুমি — ” সে শেষ করে না। কেবল তখন সে কিছু একটা লক্ষ করে - এটা কি অবাক হওয়া? অথবা ভয়? সে বলতে পারে না। সে তাদের দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় লক্ষ্য করে এবং নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে যে, তারা এমন গোপন কিছু জানে, যা সে জানে না।

“হয়তোবা আমি আর ওদের একজন নই!” সে তিক্ততার সঙ্গে ভাবে। কিন্তু তারা তাকে নতুন গ্রামের খবর দেয়। উপত্যকা বরাবর হালকাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘরসহ পুরনো গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে।

সে তিক্ত এবং প্রতারিত বোধ করে এবং ওদের রেখে এগিয়ে যায়। পুরনো সেই গ্রাম তার জন্য অপেক্ষা করে নাই। তখন হঠাৎ সে তার পুরনো বাড়ি, বন্ধুবান্ধব এবং চতুর্পাশের জন্য স্মৃতির আকুলতা অনুভব করে। সে ভাবে তার বাবার কথা, মার কথা এবং — এবং — তার কথা চিন্তা করার সাহস তার হয় না। তাসত্ত্বেও, তার মনে পড়ে, পুরনো দিনের মুথোহনিকে। তার হৃদপিণ্ডের চলাচল দ্রুততর হয়। তার ভেতর কামনা জেগে ওঠে এবং একটি উষ্ণতার অনুভূতি তার ভিতর দিয়ে তরঙ্গায়িত হয়। সে তার হাঁটার গতি বৃদ্ধি করে। স্ত্রীর কথা মনে হওয়ার পর সে গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার বিষয়টি ভুলে যায়। সে তার সঙ্গে মাত্র দুসপ্তাহ ছিল; তখন ঔপনিবেশিক শক্তি তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। অন্য আরও অনেকের মত দ্রুত জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে বিনা বিচারে আটক রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এবং এই পুরোটা সময় সে কেবল তার গ্রাম এবং তার সুন্দরী নারীর বিষয়ে ভেবে কাটায়।

অন্য বন্দিরাও তার মতই ছিল। তারাও কেবল তাদের গ্রামের কথা বলতো। একদিন সে মুরাঙ্গার এক বন্দির পাশে কাজ করছিল। হঠাৎ এই বন্দি লোকটি, এনইয়োরোগে, তার পাথর ভাঙার কাজ থামায় এবং সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার বিবর্ণ চোখে বিমর্ষতা লেগে থাকে।

“সমস্যা কী হে? কী হইছে তোমার?” কামাউ জিজ্ঞেস করে।

“আমার বউ। আমি তারে পোয়াতি রাইখা আসছি। তার কী হইল কিছুই বুঝতে পারতাছি না।”

অন্য একজন বন্দি বলে: “আমার কথা ধর, আমার মেয়েলোকটারে আমি রাইখা আসছি একটা বাচ্চাসহ। বাচ্চাটা কেবলই হইছিল। আমরা সুখেই ছিলাম। কিন্তু সেই একই দিনে আমারে গ্রেপ্তার কইরা… ”

এবং এভাবে তাদের আলাপ অব্যাহত থাকে। তাদের সকলের প্রত্যাশা থাকে একটি দিনের — তাদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের দিনের। তখন জীবন আবার শুরু হবে নতুন করে।

কামাউ তার স্ত্রীকে যখন ছেড়ে যায় তখন তাদের কোন বাচ্চা ছিল না। সে এমনকি তার কনে পণ পরিশোধ করাও শেষ করে নাই। তবে সে এখন যাবে, নাইরোবিতে কাজ খুঁজবে, এবং কনে পণের অবশিষ্টাংশ মুথহোনির পিতাকে পরিশোধ করবে। বস্তুত জীবন নতুন করে শুরু হবে। তাদের একটি ছেলে হবে এবং তাকে তারা তাদের নিজের বাড়িতে বড় করে তুলবে। এইসব সম্ভাবনার বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে তার পথ চলা দ্রুততর করে। তার দৌড়াতে ইচ্ছা করে — না, প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করার জন্য তার উড়ে যেতে ইচ্ছা করে। সে তখন পাহাড়ের চূড়ার কাছে পৌঁছে যায়। তার মনে হয় যে, সে হঠাৎ করে তার ভাই অথবা বোনের দেখা পেয়ে যেতে পারে। তারা কি তাকে প্রশ্ন করতে থাকবে? সে অবশ্য তাদেরকে সবকিছু বলবে না : মারধোর, জিজ্ঞাসাবাদ, সঙ্গে একজন আসকারি নিয়ে রাস্তা অথবা খনিতে কাজ করা, যে আসকারি কাজে ঢিলে দিলেই লাথি মারার জন্য সর্বদা মুখিয়ে থাকতো। হ্যাঁ। সে অনেক অপমান সহ্য করেছে, প্রতিরোধ করে নাই। তার কি কোন প্রয়োজন ছিল? কিন্তু তার অন্তরাত্মা এবং পৌরুষ প্রবল ক্রোধ এবং তিক্ততায় উন্মত্ত এবং রক্তাক্ত হয়ে উঠতো।

একদিন এই ওয়াজুংগুদের চলে যেতে হবে!

একদিন তার লোকেরা মুক্ত হবে! তখন — সে জানে না কী করবে। তবে, সে তিক্তভাবে নিজেকে এভাবে আশ্বাস দেয় যে, আর কখনো কেউ তার জীবনকে বিপন্ন করবে না।

সে পাহাড়ের ওপর ওঠে এবং তারপর থামে। সমগ্র সমতলভূমি নিচে শুয়ে ছিল। তার সামনে ছিল নতুন গ্রাম — সারির পর সারি শক্ত মাটির কুঁড়েঘর, যেন দ্রুত বিলীয়মান সূর্যের নিচে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। বিভিন্ন কুঁড়েঘর থেকে ঘননীল ধোঁয়া পাক খেয়ে উপর দিকে উঠে ঘন কুয়াশা তৈরি করে গ্রামের ওপর ভেসে ছিল। দূরে, গভীর রক্ত-লাল অস্তগামী সূর্য আঙুলের মত আলোর রশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, যা প্রান্তের দিকে পাতলা হয়ে দূরবর্তী পাহাড় ঢেকে রাখা ধূসর কুয়াশার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। গ্রামের ভেতর সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, অনেক নতুন মুখের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে তাদের কাছে বিভিন্ন বিষয় জানতে চায়। অবশেষে সে তার বাড়িতে পৌছয়। সে উঠোনের প্রবেশমুখে দাড়িয়ে লম্বা এবং গভীর করে শ্বাস নেয়। তার গৃহে প্রত্যাবর্তনের সেই সময়টি শেষ পর্যন্ত আসে। তার পিতা একটি তেপায়া টুলের ওপর পা তুলে জড়সড় হয়ে বসে ছিল। সে অনেক বুড়ো হয়ে গিয়েছিল, এবং বুড়ো লোকটির জন্য কামাউ-এর করুণা হয়। তবে তার তখন বোধশক্তি ছিল না — হ্যাঁ, তার ছেলের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে পারার মত বোধশক্তি ছিল না তার।

“আব্বা — ”

বুড়ো লোকটা উত্তর দেয় না। সে অদ্ভুত ফাঁকা চোখে কামাউ-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। কামাউ-এর অস্থির লাগে। সে বিরক্ত এবং রুষ্ট বোধ করে। সে কি তাকে দেখে নাই? সে কি সেই সব মেয়েলোকদের মত আচরণ করবে যাদের সঙ্গে কামাউ-এর নদীর পাড়ে দেখা হয়েছিল?

রাস্তায় পরস্পরের দিকে ধুলো ছুঁড়ে ন্যাংটো এবং আধ-ন্যাংটো ছেলেমেয়েরা খেলা করছিল। সূর্য ইতিমধ্যে অস্ত গিয়েছিল এবং মনে হচ্ছিল যেন চাঁদের আলো বেরুবে।

“আব্বা, আমারে চিনতে পারতাছেন না?” তার আশা নিভে আসছিল। সে ক্লান্ত বোধ করে। তখন সে দেখে তার পিতা হঠাৎ চমকে উঠে পাতার মত কাঁপতে থাকে। সে তাকে দেখে, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতে। সে চোখে ভয় পরিষ্কার দেখা যায়। তখন তার মা আসে, এবং তার ভাইয়েরাও। তারা তাকে ঘিরে ধরে। তার বৃদ্ধা মা জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে ফোঁপায়।

“মুথহোনি চইলা গেছে।”

কামাউ অনুভব করে যে তার পেটের ভেতরটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে গ্রামের বাড়িঘর এবং জমির ধূসরতার দিকে তাকায়। আর অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কিন্তু সাহস হয় না। তার বিশ্বাস হতে চায় না যে, মুথহোনি চলে গেছে। কিন্তু নদীপাড়ের মেয়েলোকদের দৃষ্টি, তার বাপ-মার দৃষ্টি তাকে বলে দেয় যে, সে নাই।

“হ্যায় আছিল আমাগো মাইয়ার মত”, তার মা ব্যাখ্যা করে বলে। “হ্যায় তর লাইগা অপেক্ষা করতাছিল আর দেশগেরামের সব অপমান সইহ্য করতাছিল। তখুন একদিন কারানিয়া আইলো, আর কইলো যে, তুই মইরা গেছস। তর বাপে অরে বিশ্বাস করলো। মুথহোনিও অরে বিশ্বাস কইরা একমাস ধইরা শোক করল। তখন কারানিয়া আমাগো বাইতে সবসুময় আইতে লাগল। হ্যায় আছিল তর মতই, তুই জানস। তখন মুথহোনির একটা বাচ্চা হইল। আমরা অরে রাখতে পারতাম। কিন্তু জমি কই? খাওন কই? ছুটো ছুটো জমি একখানে করনের পরথন আমাগো শেষ সম্বল গেছে গা। আমরা মুথহোনিরে অর লগে যাইতে দেই। অন্য মায়ালোকেরা আরও খারাপ কাম করছে — শহরে গেছে। শুদু বুড়া আর লুলারা এইখানে পইড়া রইছে।”

সে এসব শুনছিল না; তার পেটের ঠাণ্ডা অনুভূতি ক্রমান্বয়ে তিক্ততায় রূপান্তরিত হয়। সে তিক্ত অনুভব করে সকলের প্রতি। তারা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা সকলে তার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে, এবং কারানিয়া সবসময় ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী। স্বীকার করতে হয় যে, পাঁচ বছর অল্প সময় ছিল না। কিন্তু সে চলে গেল কেন? এরা ওকে চলে যেতে দিল কেন? তার এসব কথা বলতে ইচ্ছে করে, হ্যাঁ, বলতে এবং নিন্দা করতে ইচ্ছে করে সব কিছুর — নদীপাড়ের মেয়েদের, গ্রাম এবং গ্রামে যারা বাস করে তাদের। কিন্তু সে পারে না। এই তিক্ততা তার বাকরুদ্ধ করে।

“তোমরা — তোমরা আমার নিজেরটা দিয়া দিলা?” সে বিড়বিড় করে বলে।

“শোন, বাবা, বাবা…।”

একটা বড় হলুদ চাঁদ দিগন্তের ওপর প্রবল হয়ে উঠেছিল। সে তিক্ত এবং অন্ধ হয়ে দ্রুত বের হয়ে যায়, এবং কেবলমাত্র হোনিয়া নদীর পাড়ে এসে থামে।

পাড়ে দাঁড়িয়ে সে নদী দেখে না, বরং তার চোখে পড়ে মাটির ওপর পড়ে থাকা তার বিচূর্ণ বাসনা। নদী দ্রুত প্রবাহিত হয়, এবং ক্রমাগত একঘেয়ে মর্মর ধ্বনি ওঠে। বনের ভেতর ঝিঁঝিপোকা এবং অন্যান্য পতঙ্গ একটানা শব্দ করে চলে। এবং মাথার ওপর চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে। সে তার কোট খুলে ফেলার চেষ্টা করে, এবং তখন শক্ত করে ধরে রাখা তার পোটলাটা পড়ে যায়। এটা নদীর পাড় ধরে গড়িয়ে নামে এবং কী ঘটছে কামাউ তা বুঝে ওঠার আগেই, নদীর স্রোতে দ্রুত ভেসে যেতে থাকে। সে এক মুহূর্তের জন্য ধাক্কা খায় এবং এটা উদ্ধার করতে চায়। সে কি দেখাবে তার — আহ্, সে কি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল? তার স্ত্রীতো চলে গেছে। এবং টুকিটাকি জিনিসগুলোও গেল, যেসব জিনিস অদ্ভুতভাবে তার কথা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে এবং এতগুলো বছর সে যেসব সংরক্ষণ করেছে। সে বুঝতে পারে না কেন, তবে কোন কারনে তার নির্ভার লাগে। তার ডুবে মরার ইচ্ছে দূর হয়। সে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে কোট পড়তে শুরু করে, “আমার জন্য হ্যায় অপেক্ষা করব ক্যান? এইসব পরিবর্তন আমার ফিরা আসার জন্য বইসা থাকব ক্যান?”
==================
আফ্রিকান সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক এনগুগি ওয়া থিওংগ্’ও

Ngugi wa Thiong’o (জন্ম: ৫/১/১৯৩৮)
এনগুগি ওয়া থিওংগ্’ও-কে সমসাময়িক আফ্রিকান সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর জন্ম কেনিয়ায়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত বইয়ের নাম হচ্ছে: Weep not, Child; The Rivers Between, Petals of Blood ইত্যাদি। মাও মাও আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা তাঁর বিখ্যাত বই হচ্ছে Petals of Blood। ‘ফেরা’ গল্পটি নাদেঝদা অবরাদোভিচ কর্তৃক সম্পাদিত আফ্রিকান গল্প সঙ্কলন Looking for a Rain God গ্রন্থ থেকে নেয়া। 


এই ওয়েব্লগের আরো গল্প....
পিটার নাজারেথ-এর গল্প 'মালদার'    ইতালো কালভিনোর গল্প : ‘জেদ’   হারুকি মুরাকামির গল্প 'উড়োজাহাজ'  হার্টা ম্যুলার-এর গল্প 'আমার পরিবার'  হার্টা ম্যুলার-এর গল্প 'অন্ত্যেষ্টির বয়ান'  আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প 'ঈশ্বরণ'  স্টিভেন মিলহসার-এর গল্প 'বহির্জাগতিক আক্রমণ'  আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প 'মাসে পঁয়তাল্লিশ টাকা'  এনগুগি ওয়া থিওংগ্’ও-এর গল্প ‘ফেরা’  আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প 'বাবার সাহায্য'  মানুয়েল মুহিকা লাইনেস-এর গল্প ‘গুরুত্ব’


bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: শহীদুল জহির


এই গল্পটি পড়া হয়েছে....

free counters

No comments

Powered by Blogger.