চিনির সিন্ডিকেটের সন্ধানে

দি সুগার সিন্ডিকেট নামে একটি স্পেশাল ব্র্যান্ড দুই বছর আগে শিকাগোতে সাড়া ফেলেছিল। ক্রেতার পছন্দমতো, দেয়ালঘড়ি, বাইবেল বা ইংরেজি বর্ণমালা—এমন হাজারও ডিজাইন ও ভিন্নস্বাদের কেক এবং বিস্কুট সরবরাহ করে আমেরিকানদের মন জয় করেছিলেন শেফ, ক্যাথি রাইহিল। ক্যাথি কি জানতেন চিনি সিন্ডিকেট বাংলাদেশে আতঙ্কের নাম?
সিন্ডিকেট সংবাদমাধ্যমের প্রিয় শব্দই নয়, বাজার স্থিতিশীল রাখার ব্যর্থতা ঢাকতে বাংলাদেশের মন্ত্রী-আমলাদের বক্তৃতারও প্রিয় অনুষঙ্গ।
ক্যামব্রিজ অভিধানে সিন্ডিকেট হলো গুটিকয়েক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন একটি নির্দিষ্ট ব্যবসার বিরাট তহবিল সংগঠনে একতাবদ্ধ হয়। মানবিক যোগাযোগ বিষয়ের এক বিখ্যাত পণ্ডিত বলেছিলেন শব্দের অর্থ থাকে না, যে অর্থ আরোপিত হয়, তাই তার অর্থ। সত্যিই তাত্ত্বিক পণ্যবাজারে সিন্ডিকেট নেই—বাংলাদেশে এটি বলতে যা বোঝায় তা সেখানে অলিগোপলি। অলিগোপলি হলো মুষ্টিমেয় বিক্রেতার বাজার, তারা পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে।
এমনকি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এসব কথা এখন বললেন। গত সপ্তাহে তিনি বলেছেন, ‘বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি—চিনির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র পাঁচজন, ভোজ্যতেলেও এমনই কয়েকজন।’ সিন্ডেকেটের প্রভাব সরকারের ভেতরেও—বলেছেন এই প্রভাবশালী মন্ত্রী। তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন ভাঙা যায়নি সিন্ডিকেট? সিন্ডিকেটের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণের মতো অপকর্মগুলো কি তদন্ত করে প্রমাণসহ শনাক্ত করেছে সরকার?
২০০৩ সালে চিনি আমদানি উন্মুক্ত হয় বেসরকারি খাতে। যুক্তি ছিল—ক্রমবর্ধমান চাহিদা, অন্যদিকে সরকারি মিলগুলোতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন ও অস্থির বাজার। মনে করা হয়েছিল, বেসরকারি খাতের আমদানিতে সরবরাহ বাড়বে আর প্রতিযোগিতায় পণ্যটির দামও ভোক্তার অনুকূলে থাকবে।
চিনির বাজার এর পরই আমদানিকারকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এরপর বলা হলো, আমদানিকারকেরা বাজার নিয়ে খেলেন। ট্রেডার থেকে চিনির বাজার ইন্ডাস্ট্রির হাতে দিতে অপরিশোধিত চিনির উচ্চ আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনা হয়। আমদানিকারকদেরই কয়েকজন পরিশোধন কারখানা করলেন, যেগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের চাহিদার কমপক্ষে চার গুণ।
তবে পরিশোধন কারখানাগুলো চোরাচালানি হয়ে আসা এবং ভর্তুকিমূল্যে আমদানি করা ভারতীয় চিনির সঙ্গে লড়াই করে দুই বছরেই অবস্থা কাহিল। একটি মিল উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, আরেকটি যন্ত্রপাতি স্থাপন করেও দুই বছর বসে থাকে। পরিস্থিতি পাল্টায় ২০০৮-এর শুরুতে ভারতে উৎপাদন মার খেয়ে চিনি চোরাচালান ও রপ্তানি বন্ধ হলে।
এরপর অবশ্য সারা দুনিয়ার চিনির বাজারই মাঝেমধ্যে অস্থির হতে থাকে। শীর্ষ রপ্তানিকারক ব্রাজিলে কিছু একটা সংকটের আঁচ দেখা দিলেই বিশ্ববাজার অস্থির। অস্থিরতায় ঝুঁকি যেমন থাকে, তেমনি থাকে বেশি মুনাফার সম্ভাবনাও। তাই বিশ্বজুড়ে ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, ব্যাংকসহ বিভিন্ন বিনিয়োগকারী ঢুকে পড়ে চিনির বাজারে।
আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের চিনি পরিশোধনকারীরাও এই অধিক ঝুঁকি ও অধিক মুনাফার দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছেন। তাঁরা কখনো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাচ্ছেন, কখনো হারাচ্ছেন।
আবার মিলারদের নিজেদের মধ্যেও লড়াই হয়। একজনের স্টক কমলে আরেকজন দাম বাড়ান। কখনোবা আমদানি-মূল্যের চেয়ে কম দামে চিনি বিক্রি করে অন্যকে কাহিল করেন।
এমন বাজারে সরকার কী করবে? দেশের চিনির চাহিদা ১৪ লাখ টন আর সরকারি মিলগুলোর গতবারের মোট উৎপাদন ৬২ হাজার টন। অথচ গত দশকে বাৎসরিক উৎপাদন আড়াই লাখ টনও হয়েছিল।
ভারত ও পাকিস্তানেও সরকারি উৎপাদন ও মজুদ চাহিদার ১৫-২০ ভাগ। তার পরও বাজার সামলাতে নাকাল তারা। আর বাংলাদেশে প্রায় শূন্য মজুদ নিয়ে সরকার পার করছে বছরের পর বছর।
সিন্ডিকেট বুলির গোলকধাঁধায় ভোক্তা এখন বিরক্ত। বিএনপির মন্ত্রীরা একসময় বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা বলেছেন, এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা বলছেন। কেউই সশরীরে সিন্ডিকেট ধরতে পারছেন না। যদি সত্যিই থেকে থাকে, তাহলে সিন্ডিকেটের মূল উৎপাটিত হোক, নয়তো সরকার তার মজুদ শক্তি বাড়িয়ে পাইকারি বাজারে থাকুক।

No comments

Powered by Blogger.