এই তো স্পেন

গ্যালারি ভরছে না। ফাঁকা পড়ে থাকছে আসন। পরশু ৫২ হাজার ধারণক্ষমতার লফটাস ভার্সফেল্ড স্টেডিয়ামে দর্শক হলো ঠিক ১০ হাজার কম।
মনও ভরছে না। ফুটবল খেলাটার আনন্দ হেরে গেছে সাফল্যতৃষ্ণার কাছে। কোনো দলের কাছেই ভালো খেলাটা গুরুত্ব পাচ্ছে না, যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে যেনতেনভাবে পরাজয় এড়ানো। সমর্থকেরাও আনন্দ করতে ভুলে গেছে। প্রথম দিকে শীতের কবলে পড়ে ব্রাজিলের সাম্বা ঢেউ তুলতে পারল না, মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু এখন অতটা শীত নেই, তবু সাম্বা লুকিয়ে থাকবে কেন?
আসলে সাফল্যতৃষিত ফুটবল-দুনিয়ায় দল-সমর্থকের মনোজগৎ একই তারে বাঁধা পড়ে গেছে। দল সাফল্য, প্রত্যাশা আর পরাজয়ের ভয়ে থাকে ভীত। আর সমর্থকেরাও তাদের হয়ে গ্যালারিতে ইস্ট নাম জপে। চারদিকে তাকিয়ে স্পেনের খয়েরি-লাল-হলুদ পতাকা কম দেখা গেল না। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি উড়ল চিলির লাল পতাকা। যেমন করে তারা হাওয়ায় উড়ছিল দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার সম্ভাবনার আনন্দে। কোনোমতে ড্র করলেই দ্বিতীয় রাউন্ড। লাল পতাকাই উড়ল বারবার। ‘চিলি’ ‘চিলি’ বলে চিৎকার করল তারাই। ভয় তরাসে ‘এল মাতাদোর’দের হাতের ভয়ার্ত পতাকাগুলো উড়ল লুকিয়ে চুরিয়ে। ২৪ মিনিটে ডেভিড ভিয়ার দুর্দান্ত এক বুদ্ধিদীপ্ত গোলে স্পেন এগিয়ে যাওয়ার পরও। ৩৭ মিনিটে মার্কো এস্ত্রাদা ফার্নান্দো তোরেসকে ফাউল করে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে চিলিকে বানিয়ে দিলেন ১০ জনের দল। মুহূর্তেই টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা গোলে স্পেনকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিলেন ম্যাচের সেরা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। এই প্রথম স্পেনের লাল-হলুদ জাগল, মনে হলো ক্যামোফ্লেজ থেকে বেরিয়ে এল ‘এল মাতাদোর’রা। মুখ খুলল তাদের শীতনিদ্রার গুহার। তবু স্বতঃস্ফূর্ত নয়। তবু ইতিউতি তাকানো সতর্ক প্রতিক্রিয়া।
এমনটা হবেই বা না কেন? রক্ষণের সামান্য ভুলে বিরতির পর ২ মিনিট না যেতেই তো একটা গোল ফিরিয়ে দিল চিলি, লাতিন আমেরিকার ‘এল মাতাদোর’। তবে কি ১০ জনের দল নিয়েই তারা স্বপ্ন ভেঙে দেবে ইউরো চ্যাম্পিয়নদের? প্রথম ৩৭ মিনিটের চিলি যেমন দুর্দান্ত, দুর্বিনীত ভঙ্গিতে চেপে ধরেছিল স্পেনকে, তাতে সেই শঙ্কাটা জেগেছিল। মাঝমাঠে জাভির ভুল পাসগুলো ধরে যেভাবে তারা পাল্টা আক্রমণে উঠছিল লাল রুমাল দেখা ষাঁড়ের মতো, স্পেন শিবিরের ওপর ভয়ের একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। এরপর স্পেন তূণ থেকে বের করল তাদের মূল তীরটিকে। পাসিং ফুটবল। নিজেদের মধ্যে অসংখ্য ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ গড়ে বল দেওয়া-নেওয়া করলেন জাভির সঙ্গে ইনিয়েস্তা, বুসকেটের সঙ্গে তোরেসের বদলি ফ্যাব্রিগাস কিংবা রামোস। শেষ ১৫ মিনিট স্পেন বলই ধরতে দিল না চিলিকে। চিলির আর্জেন্টাইন কোচ মার্সেলো বিয়েলসা চিৎকার করে যান, ভুভুজেলার আওয়াজে তা হারিয়ে যায়। যেমন করে অবশেষে স্পেনের পাসিং ফুটবল আর সময়ে সময়ে জ্বলে ওঠা নৈপুণ্যের ঝলকে হারিয়ে গেল চিলির ড্র অথবা জয়ের সম্ভাবনা।
স্পেনের স্বপ্ন ভাঙতে পারেনি চিলি। এখন উল্টো একটি দুঃস্বপ্নই তাদের দিকে ধেয়ে এল। আগামীকাল জোহানেসবার্গের এলিস পার্কে শেষ ষোলোতে তাদের পরীক্ষা হবে ব্রাজিলের বিপক্ষে। হয়তো এবারের বিশ্বকাপের শেষ পরীক্ষা। বিয়েলসা মুখ ভার করে এলেন সংবাদ সম্মেলনে।
স্পেন খুশি দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে। তারা আনন্দিত ব্রাজিলকে এড়াতে পেরে। কিন্তু স্পেনের খেলোয়াড়েরা খুশি হতে পারছে না নিজেদের খেলায়। মিক্সড জোনে দাঁড়িয়ে জাভি হার্নান্দেজ বলে গেলেন, ‘আমরা মোটেই ভালো খেলতে পারিনি। এখন সামনে পর্তুগাল, ঠিক মুদ্রা নিক্ষেপের মতো এপিঠ অথবা ওপিঠ বলার মতো অবস্থা।’ ম্যান অব দ্য ম্যাচ ইনিয়েস্তার কণ্ঠেও অস্বস্তি, ‘আমাদের অনেক লড়াই করে জিততে হলো। তবু ভালো যে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলাম। এখন পর্তুগালের সঙ্গে আমাদের লড়াইটা জীবন-মৃত্যুর।’
স্পেন কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক ভাবুক টাইপের লোক। ভাবতে ভাবতেই এলেন মিক্সড জোনে। কাঠের প্যাসেজে বাধা পেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন, শেষ পর্যন্ত সামলে নিলেন। যেমন করে অন্তত দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত নিজেদের সামলে রাখলেন ভিয়া-জাভি-ইনিয়েস্তারা। কিন্তু পর্তুগাল যে ব্রাজিলের চেয়ে কম বড় বাধা নয়! তা ছাড়া গত দুটি বিশ্বকাপেই স্পেনের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। ‘আমরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। পর্তুগাল কঠিন প্রতিপক্ষ, তবু সামনে এগোনোর প্রত্যাশায় আছি’—আত্মবিশ্বাসের কথা বললেন বটে বস্ক, তবুও কণ্ঠের কোন তারে যেন আত্মবিশ্বাসের অভাব।

No comments

Powered by Blogger.