২৪ বছর পর বিশ্বকাপ ব্রাজিলের

যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় বিশ্ব ক্রীড়ার সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন বাজার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবেও এ দেশটির পরিচিতি। তাই ফিফা ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর মার্কিন মুলুকে নিয়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলেছিল। তবে ফিফা চিন্তিত ছিল একটি ব্যাপারে, সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের জনপ্রিয়তা। যে দেশে খেলাটিকে ‘ফুটবল’ নামেই কেউ চেনে না, যে দেশের মানুষ ব্যস্ত বেসবল আর বাস্কেটবল নিয়ে—সে দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন একেবারেই সমালোচনা মুক্ত ছিল না। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ফিফার লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি।
তবে শুধু ফুটবলের প্রসার বাড়ানোর জন্যই যে ফিফা যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল, সে কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। দেশটিতে ১৯৮৪ সালে নর্থ আমেরিকান সকার লিগ নামে একটি পেশাদার প্রতিযোগিতা চালু হলেও সেটি তেমন জনপ্রিয় ছিল না। উপরন্তু মার্কিন সমাজে ফুটবলকে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ কোনো খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেখানে বিশ্বকাপ আয়োজন করার ঝুঁকি সম্পর্কেও ফিফাকে সাবধান করে দিয়েছিল অনেকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল প্রতিযোগিতা এমন একটি জায়গায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানকার অধিবাসীরা ফুটবল সম্পর্কেই কিছু জানে না। ব্যাপারটি অনেকটা বাংলাদেশে গলফ প্রতিযোগিতা আয়োজনের মতো। এমনকি ফুটবলের কোনো বড় তারকাকেও সে দেশের মানুষ নামে চেনে না। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা ফিফাকে সতর্ক করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপ আয়োজিত হলে প্রতিটি ম্যাচই অনুষ্ঠিত হবে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে—যেটা বিশ্বকাপ ফুটবলের ইমেজের জন্য মোটেও সুখকর কোনো ব্যাপার নয়। এত সাবধান বাণী, এত সতর্ক বার্তার পরেও ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি, ইতিহাসের অন্যতম সফল একটি বিশ্বকাপ আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করে দেয় তাদের যোগ্যতা।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ একটি সফল আয়োজন হলেও সেই ’৭০ ও ’৮৬-র মতো টেলিভিশন সম্প্রচারের ‘প্রাইম টাইম’ ধরতে ’৯৪-তেও বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো আয়োজন করা হয় সব ভরদুপুর বেলায়। জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে খেলতে গিয়ে আবার গলদঘর্ম হন বিশ্বের নামজাদা ফুটবলাররা। এ বিশ্বকাপেই যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি ইনডোর স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ম্যাচ আয়োজন করে। ডেট্রয়েটে এই ইনডোর স্টেডিয়ামে ‘কৃত্রিমভাবে উত্পাদিত’ প্রাকৃতিক ঘাসের মাঠে অনুষ্ঠিত খেলাগুলো বিশ্বকাপ ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে দলগুলোর অতিমাত্রায় রক্ষণাত্মক কৌশল ফুটবলের সৌন্দর্যহানি ঘটিয়েছিল। এবার ফিফা রক্ষণাত্মক ফুটবলের অপব্যবহার রোধ করতে কয়েকটি কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ব্যাকপাস আইন’। যে আইনের মাধ্যমে ব্যাকপাসের মাধ্যমে গোলরক্ষকের কাছে ফেরত যাওয়া বল হাত দিয়ে না ধরার নিয়ম করা হয়। আরেকটি হলো জিতলে ‘তিন’ পয়েন্ট ও ড্রর জন্য ‘এক’ পয়েন্টের বিধান। এর মাধ্যমে ড্র হয়ে পড়ে হারার কাছাকাছিই একটি ব্যাপার। এ দুটি নতুন আইনের প্রয়োগ ঘটানো হয় ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে। যার মাধ্যমে বিশ্বকাপে দলগুলো আবার আক্রমণাত্মক ফুটবল উপহার দেয়।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে বিশ্ব ফুটবলের অনেক ‘পাওয়ার হাউসখ্যাত’ দলের কোয়ালিফাই করতে না পারা। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও পর্তুগালের মতো দেশগুলো ’৯৪-এর বিশ্বকাপে না খেলায় এ বিশ্বকাপের সৌন্দর্য কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে যায়।
একটি মর্মান্তিক ঘটনা ’৯৪-এর বিশ্বকাপকে আচ্ছন্ন করে রাখে। প্রথম রাউন্ডে যুক্তরাষ্ট্র-কলম্বিয়া ম্যাচে কলম্বিয়ার রক্ষণভাগের খেলোয়াড় এসকোবার একটি আত্মঘাতী গোল করলে তাঁকে জীবন দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়। প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়ে কলম্বিয়া দেশে ফিরে গেলে রাজধানী বোগোটায় এসকোবারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফুটবল মাঠে একটি ভুলের মাসুল যে কোনো খেলোয়াড়কে এভাবে দিতে হবে—সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না বিশ্ববাসীর।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ অন্তত একটি ব্যাপারে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর্জেন্টিনার অযুত-নিযুত সমর্থকদের জন্য ব্যাপারটি অবশ্য বেশ বিব্রতকর ও দুঃখজনক। ফুটবলের বরপুত্র ডিয়েগো ম্যারাডোনা এ বিশ্বকাপেই নিষিদ্ধ মাদক সেবনের দায়ে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আগে আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যারাডোনা দুটি ম্যাচে অধিনায়ক হিসেবেই মাঠে নেমেছিলেন। প্রথম ম্যাচে গ্রিসের বিপক্ষে একটি গোলও করেছিলেন। দ্বিতীয় ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয়ে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের পরেই ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়ে ম্যারাডোনা নিষিদ্ধ ‘এফিড্রিন’ ওষুধ খেয়ে খেলতে নেমেছিলেন। আর্জেন্টিনা ম্যারাডোনাকে বহিষ্কার করার ফিফার এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানায়। আর্জেন্টিনা ম্যারাডোনার এই এফিড্রিন ওষুধ সেবনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলে, এটা নিষিদ্ধ কি না—ম্যারাডোনা তা জানতেন না। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কিন্তু ফিফা স্পষ্টতই জানিয়ে দেয়, ‘ম্যারাডোনা জেনে খান অথবা না জেনে খান এফিড্রিন একটি নিষিদ্ধ ওষুধ। এবং এই ওষুধ সেবনে একজন ক্রীড়াবিদের শরীরে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়, যা ডোপ পাপের পর্যায়ে পড়ে।’
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে দীর্ঘ ২৪ বছর পর চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে ব্রাজিল। বেবেতো, দুঙ্গা, ব্র্যাংকো, রোমারিও, মাওরো সিলভা, তাফারেলের সমন্বয়ে গড়া ব্রাজিল দল পুরো টুর্নামেন্টেই ছন্দময় ফুটবল খেলে সবার মন জয় করে। এ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সেরা ম্যাচটি অবশ্য কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে। সে ম্যাচে ৩-২ গোলে ব্রাজিল জয়লাভ করে সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা তারকা ইতালির রবার্তো ব্যাজ্জিও। তিনি প্রায় একক নৈপুণ্যে ইতালির ভঙ্গুর দলকে উজ্জীবিত করে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যান। সেমিফাইনালে তাঁর দেওয়া দুই গোলেই বুলগেরিয়াকে পরাজিত করে ইতালি।
বুলগেরিয়া ছিল ’৯৪-এর বিশ্বকাপের আরেক বিস্ময়। বিশ্ব ফুটবলের একেবারে অখ্যাত এই দলটি অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বুলগেরিয়ান স্ট্রাইকার রিস্টো স্টইচকভ সেবার ছয়টি গোল করে রাশিয়ার ওলেগ সালেঙ্কোর সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এ বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো রাশিয়া খেলতে আসে। রাশিয়া অবশ্য প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেয়।
এশিয়ার প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পর হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে সৌদি আরব। সৌদিরা বেলজিয়ামকে ১-০ গোলে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। এই ম্যাচে সৌদি স্ট্রাইকার সাঈদ আল ওয়াইরান পাঁচজন বেলজিয়ান খেলোয়াড়কে কাটিয়ে একটি অসাধারণ গোল করেন। ’৮৬-তে ছয় ইংলিশ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে ম্যারাডোনা যে গোলটি করেন, সেটা যদি শতাব্দীর সেরা গোল হয় সাঈদ আল ওয়াইরানের গোলটিকে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই হবে।
১৯৯০ সালের ‘অদম্য সিংহ’ ক্যামেরুন ’৯৪-এ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। রাশিয়ার সঙ্গে গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে তারা ৬-১ গোলে পরাজিত হয়, যা ’৯৪-এর বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয়। এই ম্যাচে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে নেমে রাশিয়ার ওলেগ সালেঙ্কো একাই পাঁচ গোল করেন। পরের ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে সালেঙ্কো আরও একটি গোল করেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সালেঙ্কোর মতো কোনো অখ্যাত খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ড নেই। মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেই সালেঙ্কো এই রেকর্ড গড়েন। বিশ্বকাপ ফুটবলে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান পাওয়ার অনন্য নজির তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল রোমারিওর দেওয়া গোলে সুইডেনকে ১-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। অপরদিকে ইতালি বুলগেরিয়াকে ২-১ গোলে পরাজিত করে ফাইনালের টিকিট হাতে পায়। ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় লস অ্যাঞ্জেলসের প্যাসিডেনা রোজ বোল স্টেডিয়ামে। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের নিষ্ফলা খেলাটি গড়িয়ে যায় টাইব্রেকারে। ফাইনালে ইতালি তাদের চিরাচরিত ‘ঘর বাঁচিয়ে খেলো’ নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ২৪ বছর পর বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় ব্রাজিলও ছিল ফাইনালে অতিমাত্রায় সাবধানী । সব মিলিয়ে একটি ভালো ফাইনালের জন্য যেসব অনুষঙ্গ প্রয়োজন, তার অনেক কিছুই অনুপস্থিত ছিল ’৯৪-এর ফাইনালে।
টাইব্রেকারে ব্রাজিল ৩-২ গোলে ইতালিকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ‘ফিফা বিশ্বকাপ’ ট্রফিটি হাত দিয়ে ধরার সুযোগ পায়। ব্রাজিলের এর আগের তিনটি শিরোপাই ছিল জুলেরিমে ট্রফির। টাইব্রেকারে ইতালির পক্ষে পেনাল্টি মিস করেন সেই রবার্তো ব্যাজ্জিও। যিনি ইতালির ফাইনালে ওঠার পেছনে রেখেছেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা। আরও দুটি পেনাল্টি মিস করেন মাসারো ও ফ্রাঙ্কো বারেসি। ব্রাজিলের পক্ষে অবশ্য একজন পেনাল্টি মিস করেন, তাঁর নাম মার্সিও সান্তোস। ব্রাজিলের গোলরক্ষক তাফারেল মাসারোর পেনাল্টি ঠেকিয়ে দুই যুগ পর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ে রাখেন অনন্য ভূমিকা।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে ব্রাজিলের দীর্ঘ ২৪ বছরের খরা কাটে। ১৯৮২, ১৯৮৬ কিংবা ১৯৯০-এর মতো অল আউট ফুটবল না খেলে এবার ব্রাজিল উপহার দেয় সম্পূর্ণ অন্যমাত্রার ফুটবল। নিজেদের ঘর বাঁচিয়ে আক্রমণ করার এ খেলার মাধ্যমে ব্রাজিল ফলনির্ভর ফুটবলের জগতে প্রবেশ করে। জয়ের নেশায় বিশ্ব ফুটবলের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় লাতিন ফুটবলের ছন্দের আনন্দে উদ্ভাসিত সাম্বা নৃত্যের দেশ ব্রাজিল।

No comments

Powered by Blogger.