রবাণিজ্যে জঞ্জালে দূষিত দুনিয়া -কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে by আমিরুল আলম খান

কপোতাক্ষে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ! অবিশ্বাস্য! কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাটিই ঘটেছিল ২০০৭ সালে। ২৩ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে কপোতাক্ষ নদে। সে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, ঢাকা থেকে মাছ ব্যবসায়ীরা ছুটে আসেন সাতক্ষীরায়, ট্রাক ভরে ইলিশ কিনতে।
‘কপোতাক্ষে ইলিশ’ খবরটা শুনে প্রথমে অনেকেই খুশি হলেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় বেরিয়ে আসে এক ভয়ংকর তথ্য: কপোতাক্ষের পানিতে পাওয়া গেছে অতিমাত্রায় বিষাক্ত অ্যালকোহল! বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকার পানিতে অ্যালকোহলের মাত্রা এত বেশি হয়ে পড়ে যে প্রাণ রক্ষার্থে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ সাগর থেকে নদীতে উঠে এসেছিল। জোয়ারে সেই বিষাক্ত পানি ঢুকেছিল কপোতাক্ষে। সপ্তাহখানেক ধরে কপোতাক্ষের পানি ছিল একেবারে আলকাতরার মতো কালো। গবেষকেরা ধারণা করেন, বঙ্গোপসাগরে কোথাও হয়তো মারাত্মক বিষাক্ত কোনো বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, যার বিষক্রিয়ায় ঘটে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা। সংবাদটি তখন গণমাধ্যমে ঝড় তুলেছিল।
গবেষকদের অনুমান, বঙ্গোপসাগরে এমন কোনো মারাত্মক বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, যার প্রতিক্রিয়ায় মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রাণ বিপন্ন হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। প্রথম প্রশ্ন, কী ধরনের রাসায়নিক বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হয়েছিল সাগরে? বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণার যে প্রতিবেদন তখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তাতে এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর মেলেনি। খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া গবেষকদের বরাত দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত খবরে শুধু বলা হয়, ‘সুন্দরবনসংলগ্ন সাতটি নদীর পরিবেশগত ইকো-সিস্টেম ভেঙে পড়েছে বলে ধারণা করছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁরা একে বঙ্গোপসাগর ও উপকূলভাগের জন্য মহাবিপর্যয়ের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন।...ওয়ার্কিং গ্রুপ মনে করছে, বঙ্গোপসাগরের কোনো না কোনো অংশে টক্সিক কেমিক্যাল বা বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয়েছে। জোয়ারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা উপকূলের নদীতে প্রবেশ করেছে। প্রেস কনফারেন্সে অধ্যাপক মো. সালেকুজ্জামান বলেন, সার্বিক পর্যালোচনা থেকে তাঁরা ধারণা করছেন, বঙ্গোপসাগরে টক্সিক কেমিক্যাল বা রাসায়নিক বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যাতে ছিল উচ্চমাত্রার বিষাক্ত উপাদান। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে সৃষ্ট বিষাক্ত পরিবেশ সহ্য করতে না পেরে উপকূলভাগে ছুটে এসেছে। যে কারণে অতীতে কখনো এসব নদীতে ইলিশ মাছ দেখা না গেলেও গত ২৩ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়েছে।’ (যায়যায়দিন, ৭ জুলাই, ২০০৭)।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কারা এই বর্জ্য নিক্ষেপ করেছিল? কী উদ্দেশ্য ছিল তাদের? তৃতীয় প্রশ্ন, এ ধরনের দুষ্কর্ম নিরোধে আমরা কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছি? পরিবেশবিদেরা একে ‘মহাবিপর্যয়ের ইঙ্গিত’ বলে আখ্যায়িত করলেও পরবর্তী সময়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা আমাদের অজানা।
বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় এখন দুনিয়ার পরিবেশবিদদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মতো মাত্র দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বসবাসকারী ১৫ কোটি মানুষের পরিবেশগত সমস্যার শেষ নেই। দারিদ্র্য, পরিকল্পনার অভাব, আইন লঙ্ঘনের মাত্রাতিরিক্ত প্রবণতা, দুর্নীতি এ দেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো অব্যবস্থাপনা। অব্যবস্থাপনা প্রকৃতপক্ষে অদক্ষতাকেই নির্দেশ করে। স্বীকার করতেই হবে, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা আমাদের জাতীয় জীবনকেই গ্রাস করতে চলেছে। তাই তো নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন নির্মল পানির সবচেয়ে বেশি অভাব। নদীগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রতিদিন দখল হয়ে যায়, নির্বিচার বর্জ্য নিক্ষেপে পানি দূষিত হয়। মানুষের বিবেকহীন কর্মকাণ্ডে নদীমাতৃক একটি দেশ ক্রমশ জাহান্নামে পরিণত হয়ে পড়ছে। শুধু কপোতাক্ষ নয়, রাজধানীর চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগের পানি এখন পরিশোধনেরও অযোগ্য! পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, মধুমতী, কর্ণফুলী—কোন নদী আজ দূষণমুক্ত? নদী আমাদের জীবন, অথচ নদীর প্রতি এ কী নিষ্করুণ আচরণ আমাদের?
কয়েক মাস আগে সুন্দরবনে গিয়ে দেখি, যাঁরা সুন্দরবন ভ্রমণে যান, তাঁরা পলিথিন প্যাকেট, পানির খালি বোতল, খাবার প্যাকেট ইত্যাদি নির্বিচারে নদীতে, সাগরে নিক্ষেপ করছেন। তাঁদের প্রতি কোনো নির্দেশনা পর্যন্ত নেই, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থাও বাণিজ্যিক তরীর মালিকেরা রাখেননি। তীরে যাঁরা ইজারা নিয়ে ব্যবসা করছেন, তাঁরাও নির্বিকার। এ বিষয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়েরও কোনো নির্দেশনা আছে বলে মনে হয়নি। ব্যবসা কি তবে শুধুই লাভের জন্য? পরিবেশ রক্ষার কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না?
যন্ত্রযুগে প্রবেশ করে মানুষ ভীষণভাবে পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। পুুঁজিবাদের ঊষালগ্নে দূষণ সীমাবদ্ধ ছিল শিল্পসমৃদ্ধ শহরগুলোয়। কিন্তু শিল্পবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় অধিক কাঁচামাল সরবরাহ। পাল্লা দিয়ে তা প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস শুরু করে। জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা, তেল, গ্যাস) ব্যবহার, বন উজাড়, জলাভূমি ভরাট পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সর্বোপরি বিংশ শতাব্দীতে যান্ত্রিক যানবাহন হিসেবে মোটরগাড়ি আবিষ্কার ও সড়ক যোগাযোগের অভাবনীয় বিস্তার, কোটি কোটি মোটরগাড়ির ধোঁয়া দূষণের মাত্রা যেমন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, তেমনি তা ছড়িয়ে দেয় এমনকি দুর্গম অঞ্চলেও।
পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান বস্তু হলো পলিথিনসমগ্রী। প্লাস্টিক আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে যেমন অগ্রগামী করেছে, তেমনি তা দূষণের কারণও হয়ে ওঠে অতি দ্রুত। এর ক্ষতিকর প্রভাব মানুষ টের পেতে শুরু করার পর থেকে পশ্চিমা দুনিয়ায় তার ব্যবহার সীমিত করা হয়। কিন্তু এই জঞ্জাল উৎপাদনে ও ব্যবহারে আমাদের দেশের উৎসাহে কোনো ভাটা পড়েনি। অথচ এই দেশেই রয়েছে বিশ্বের সর্বোত্তম প্রাকৃতিক তন্তু পাট, যার অধিক ব্যবহার আমাদের দূষণমুক্তিতে সহায়তা করতে পারে।
১৯৭০-এর দশকে পুঁজিবাদ যখন করপোরেট যুগে প্রবেশ করে, গড়ে ওঠে বহুজাতিক কোম্পানি, তখন মুক্তবাজারের সঙ্গে আরও একটি নতুন উৎপাত বিশ্বপরিবেশ ধ্বংসে নতুন মাত্রা যোগ করে। প্রয়োজন থাক বা না-থাক, দুনিয়ার ভুখা মানুষকেও শোষণ করতে সক্ষম করপোরেট পুঁজির এমন এক অভিনব আবিষ্কার হলো ওয়ানটাইম পণ্য। ওয়ানটাইম গেজেট সারা দুনিয়াকে শুধু গ্রাসই করেনি, বরং মানব জাতিকেই পরিণত করেছে পণ্যদাসে। একই সঙ্গে শুরু হলো দুনিয়াব্যাপী দূষণ বিস্তারের সর্বাধুনিক জঞ্জাল-আগ্রাসন।
বাংলাদেশের মতো গরিব, পিছিয়ে থাকা দেশকে দূষণমুক্ত রাখতে তাই গ্রহণ করা প্রয়োজন বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল। না হলে বাংলাদেশ পরিণত হবে বিশ্ব করপোরেট পণ্যের বর্জ্য-ভাগাড়ে। তাতে পরিবেশ আরও দ্রুত ধসে পড়বে। এ দেশের মাটি, পানি, বাতাস আজ করপোরেট পণ্যের জঞ্জালে অতি দ্রুত দূষিত হয়ে পড়ছে। যত দ্রুত আমরা তা উপলব্ধি করব, যত দ্রুত তা নিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারব, ততই মঙ্গল।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষক।
amirulkhan7@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.