সুন্দরবন ও মোহাম্মদ তোহা খান by খসরু চৌধুরী

১৯৭০ সালে এএফএম জলীল সাহেবের চার খণ্ডে লেখা সুন্দরবনের ইতিহাস বইটি পড়ে শিহরিত হয়ে সুন্দরবনে শিকার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি। ১৯৭৪ সালে সুন্দরবনে ঘুরে এসে সতীশচন্দ্র মিত্রের অনন্য সাধারণ বই যশোর খুলনার ইতিহাস বইটি পড়ার সময় টের পাই, জলীল সাহেবের বইটি কিছুটা জলীয় লাগছে। মনে হয়েছে, জলীল সাহেব সতীশচন্দ্র মিত্রের বই থেকেই বেশি মালমসলা সংগ্রহ করেছেন। দুজনের বইয়ের পার্থক্যটা অনেকটা এ রকম—সতীশচন্দ্র দেখানোর চেষ্টা করেছেন সুন্দরবনের ইতিহাসে হিন্দু সম্প্রদায়ই প্রধান ভূমিকাভিনেতা, জলীল সাহেব চেষ্টা করেছেন মুসলমানদের ভূমিকাই প্রধান। তবে জলীল সাহেবের বইয়ে ১৯৪৭ সালের আগে-পরের ইতিহাস সন্নিবেশিত হয়েছে, স্থানীয় শিকারিদের সম্পর্কে সমসাময়িক তথ্য দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে মনোজ বসুর দুটো উপন্যাস, কিছু ছোটগল্প পড়ে মোহিত হয়েছি। এগুলোতে সুন্দরবনের গন্ধ পাওয়া যায় যেন। অসাধারণ দক্ষতায় লিখেছেন সতীশচন্দ্র মিত্রের ছেলে শিবশঙ্কর মিত্র সুন্দরবনের আর্জান সরদার, বেদে-বাউলে, বনবিবি ইত্যাদি বই।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর কোনোটাই প্রামাণ্য বই নয়। এগুলোর ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক মূল্য অসাধারণ, কিন্তু সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কোনো বই হাতে পেলাম না। আমার এই দুঃখ ঘোচাতেই পঁচাত্তর সালে হাতে এসে পড়ল ১৯৭১ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত একটি বই রূপসম্পদ ও রহস্যঘেরা সুন্দরবনের কথা, লেখকের নাম দেখলাম মোহাম্মদ তোহা খান।
সুন্দরবনে দু-চারবার ঘুরেছেন, শিকারটিকার করেছেন—এমন দু-একজনের দু-একটি বই পড়েছি ইতিমধ্যে। তাই কিছুটা অবহেলায় বইটি পড়া শুরু করেছিলাম। বইটির ইলাস্ট্রেশনের ছবিগুলো অস্পষ্ট। কিন্তু পড়তে শুরু করেই আর থামতে পারলাম না। যাকে বলে গোগ্রাসে গেলা, সেভাবেই পড়তে লাগলাম। মনে হতে লাগল, এত দিন এ বইটিরই অপেক্ষায় ছিলাম। এ যেন বাদায় বসেই লেখা, সেই জলকাদার বনভূমির গন্ধ পাচ্ছি, বনভূমির বর্ণ পাচ্ছি, বনচারীদের যেন দেখতে পাচ্ছি। তারা ‘দককিনি’ বাংলায় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় ভাসে, জোয়ার-ভাটায়, গোনে-বেগোনে আন্দোলিত হয়। জেলে, বাউলে, মউলে, গুণীন পিটেল বাবুদের কথা, জংলি জীব, পাখপাখালি মায় জলের কামট, কুমির, শুশুকের কথাও বাদ যায়নি। বাদ যায়নি লোকালয়ের দুর্ধর্ষ মানুষ, শিকারি ও ডাকাতদের কথা। জঙ্গলের শুলো, বেড়ে পোকা, মশার দুর্দমনীয় উৎপাতের কাহিনিও আছে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার কাছারি, খাদ্যগুদাম, করুণ বন বিভাগের অফিস, বিপৎসংকুল জোয়ার-ভাটায় উদ্দাম যাত্রাপথের কথাও আছে। আছে গ্রামীণ অবিচারের কাহিনি, অপরিকল্পিতভাবে বেড়িবাঁধ বাঁধায় নাব্য নদী সরে যাওয়ার কথা, মাছের আকালের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে বনদরদি মানুষের কথা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকের পশ্চিম সুন্দরবন ও আশপাশের লোকালয়ের অবস্থা তাঁর লেখনীতে প্রামাণ্য উঠে এসেছে। শিকার ছিল তাঁর কাছে বন ভ্রমণের বাহানা মাত্র। সুন্দরবনের জাতীয় গুরুত্ব, সম্যক অবস্থা, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ তাঁর কলমে উঠে এসেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। দাঁড়, বৈঠায় চলা টাবুরে নৌকায় দিনের পর দিন বন ভ্রমণ যে কী কষ্টসাধ্য, তার কিছুটা অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে। তাঁর ভ্রমণসঙ্গী সাহাবুদ্দিন, রঞ্জু, আলী, আহমদ, শিকারি শহর আলী ডাক্তার—তারা এত জীবন্তভাবে উঠে এসেছেন যে বইটি পড়লে মনে হবে পাঠকও তাঁদের চেনেন। ভ্রমণ বৃত্তান্তের মাঝেমধ্যে অনবদ্য দক্ষতায় তিনি শুনিয়েছেন সুন্দরবনের ইতিহাস, পুরাকীর্তি, মিথ, লিজেন্ড ইত্যাদি। এ বইটিরই আরেকটি সংস্করণ বের হয়েছিল রূপসী সুন্দরবন নামে। সেটিও পড়েছিলাম। তাতে শিকারি পচাব্দী গাজী, মনিরুদ্দিনের সঙ্গে শিকারযাত্রার বর্ণনা আছে। তিনি লিখেছিলেন, পচাব্দী গাজীসহ সুন্দরবনের শিকারিদের ওপর একটি বই লিখবেন, সেটি সম্ভবত আর লেখা হয়ে ওঠেনি।
সুন্দরবনকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র নির্মাণের ইচ্ছা ছিল তাঁর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। তথ্যচিত্র নির্মাণকালে অভিজ্ঞতার ওপর বাঘের সন্ধানে সুন্দরবনে শীর্ষক একটি চমৎকার বইও লিখে গেছেন তিনি। এ তথ্যচিত্রটির কিছু অংশ দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।
১৯৮৬ সালে শিকারি পচাব্দী গাজী ঢাকায় এসেছিলেন। থাকতেন বলধা গার্ডেনে। পচাব্দী গাজী আমার মামা আকতারুজ্জামানের শিকারসঙ্গী ছিলেন। আমাকেও ১৯৮৫ সালে কলাগাছিয়ার জঙ্গল ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। পচাব্দী গাজীর সঙ্গে মামাসহ আমরা দয়াগঞ্জের বসুবাজারে এক সন্ধ্যায় তোহা খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই। লোডশেডিং চলছে। অসুস্থ দীর্ঘদেহী মানুষটি একটি ছড়িতে ভর দিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। শারীরিক কারণে অনেক অপূর্ণ স্বপ্নের কথা বলছিলেন।
সুন্দরবন-তপস্বী এ মানুষটি আর বেশি দিন বাঁচেননি। ১৯৯৬ সালের ১৪ এপ্রিল তিনি মারা গেছেন। এই মনীষীর স্মৃতি তর্পণের এ লেখায় একটি আবেদন জানাচ্ছি। আজ যাঁরা সুন্দরবনে যাচ্ছেন বা যাবেন, তাঁরা যেন তাঁর রূপসী সুন্দরবন বইটি একবার পড়ে নেন।

No comments

Powered by Blogger.