বর্গাচাষিদের ঋণে দালালদের পুরো মাত্রায় প্রভাব আছে

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) সমীক্ষা করে দেখেছে, কৃষিঋণ বিশেষত বর্গাচাষিদের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এখনো স্থানীয় দালাল, টাউট ও সম্ভ্রান্তদেরই প্রভাব রয়েছে পুরো মাত্রায়। ঋণ পেতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষকদের এদের অবৈধ সুবিধা দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বেসরকারি ব্যাংকের কৃষিঋণ বিতরণের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এ তথ্য উপস্থাপন করেছে সংস্থাটি।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যে উদ্দেশ্যে বর্গাচাষিদের অর্থ জোগানের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা উচ্চসুদের হার ব্যাহত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর সুদের হার গিয়ে ঠেকেছে ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকগুলোকে এসব বিষয়ে তদারকির ব্যবস্থা জোরদার করারও তাগিদ দিয়েছে বিআইবিএম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান অবশ্য বলেছেন, পরীক্ষামূলকভাবে বর্গাচাষিদের কৃষিঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ভবিষ্যতে এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি কাটানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএমের মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বর্গাচাষিদের জন্য আর্থিক সহায়তা’ শীর্ষক সেমিনারে গতকাল মঙ্গলবার এ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়। আতিউর রহমান সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন।
নির্ধারিত আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত পরিচালক ও গবেষণা বিভাগের প্রধান উত্তম কুমার দেব।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক বন্দনা সাহা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল জলিল চৌধুরী।
প্রবন্ধে বলা হয়, উচ্চসুদে ঋণ নেওয়ায় তা পরিশোধে অনীহা দেখাতে পারেন বর্গাচাষিরা। আবার ঋণ বিতরণ ও পরিশোধে সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে বর্গাচাষিদের নিয়ে দল গঠনের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, ব্যাংকগুলো তা অনুসরণ করেনি। তাই বর্গাচাষিদের অর্থায়ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের ফলাফলটি সফল নাও হতে পারে।
সম্প্রতি বিআইবিএম বর্গাচাষিদের ব্যাংকঋণ বিতরণের ওপর একটি সমীক্ষা চালায়। এটি পরিচালনা করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল জলিল চৌধুরী, অনুষদ সদস্য শেখ নজিবুল ইসলাম ও প্রভাষক মোহাম্মদ শফিউল্লাহ।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ২০টি জেলার ৩৪৩ জন বর্গাচাষির সাক্ষাত্কার নেওয়া হয় এ সমীক্ষা চালাতে। আবার ঋণ নিয়েছেন এমন ১৫ জন ভূমিহীন বর্গাচাষি, ৭৩ জন ব্যাংক ও এনজিও কর্মকর্তা, ৫৯ জন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ১৬ জন সহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাক্ষাত্কারও সমীক্ষাকালে নেওয়া হয়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, জামানতবিহীন কৃষিঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ভূমিহীন বর্গাচাষিদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তাঁরা যথেষ্ট ঋণ পাননি। ঋণ বিতরণে প্রান্তিক চাষিরা অগ্রাধিকার পেয়েছেন।
সমীক্ষা অনুসারে কৃষি ব্যাংক বিতরণ করা ঋণের মাত্র ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ দিয়েছে ভূমিহীন বর্গাচাষিদের, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) দিয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ, উত্তরা ব্যাংক দিয়েছে ১০ শতাংশ আর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ভূমিহীন বর্গাচাষিদের ঋণ দিয়েছে ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ফলে ভূমিহীন বর্গাচাষিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়ন-সুবিধার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন বলে সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমীক্ষার সুপারিশে এসব অসংগতি দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা সংশোধন এবং ঋণ বিতরণ কার্যক্রম তদারক করার জন্য একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
অবশ্য আতিউর রহমান বলেন, নীতিমালায় সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। আগামী জুলাই মাসে কৃষিঋণনীতি (সংশোধিত) প্রকাশকালে গবেষণা থেকে যেসব সুপারিশ বেরিয়ে এসেছে, তা বিবেচনায় নেওয়া হবে। বিআইবিএম কৃষিঋণ বিতরণ নিয়ে যে সমীক্ষা করেছে, তা ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কৃষিঋণ বিতরণের জন্য অবশ্যই একটি তদারকি কাঠামো থাকতে হবে। ঋণ পরিশোধে সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে কৃষকদের নিয়ে দল গঠন করা আবশ্যক বলেও তিনি মত দেন।
তিনি সত্যিকার কৃষকদের চিহ্নিত করতে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের নেতৃত্বে গ্রামের সব পক্ষকে নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানোর আহ্বান জানান। ওই সমীক্ষার ভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের পরিচয়পত্র দেওয়া যেতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.