প্রবৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশের বেশি হবে না

বিনিয়োগ বৃদ্ধি, খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস এবং সুশাসন অর্জন—এই পাঁচটি এখন দেশের অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে বিশ্বমন্দায় শুধু রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। এতে সমাজের ওপর কী পরিমাণ প্রভাব পড়েছে, তা এখনো নির্ণয় করা হয়নি।
এই বাস্তবতায় চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ৫ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি হবে না।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) যৌথ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব পর্যালোচনা ও অভিমত প্রকাশ পেয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তবে তিনি অভিযোগ করেন, বাজার সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে।
বাজারে চালের দাম অহেতুক বাড়ার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের (মুষ্টিমেয় লোক) নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সরবরাহের অভাব না থাকা সত্ত্বেও বাজারে সব ধরনের চালের দাম বাড়ছে, যার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান। বিআইডিএসের মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী ও গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান এতে যৌথভাবে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আনিসুল হক ছিলেন সেমিনারের সঞ্চালক।
প্রবন্ধের সারকথা: মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্বমন্দা, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার আঘাতের প্রভাব মোকাবিলা এবং নতুন নির্বাচিত সরকারের প্রথম বাজেট—এসব বিবেচনায় চলতি অর্থবছরটি অন্য সব বারের তুলনায় একটু আলাদা। পাশাপাশি রয়েছে বিনিয়োগে মন্দা, রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবণতা, বড় আকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি।
এতে বলা হয়, দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ। জ্বালানি-সংকট এর অন্যতম কারণ। তবে ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগটি ভালো।
এতে বলা হয়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এ অঞ্চলের কোনো উন্নতিই হচ্ছে না। বিআইডিএস পরিচালিত এক জরিপের ফল উদ্ধৃত করে বলা হয়, এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে জানিয়েছে।
প্রবন্ধে তিনটি বিষয়কে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—প্রথমত, বিশ্বমন্দার কারণে অসুবিধা তৈরির পাশাপাশি যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তা কাজে লাগানো যাচ্ছে কি না, তা জানা। দ্বিতীয়ত, যদি সুযোগ কাজে লাগানো হয়, তাহলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে কীভাবে যাওয়া যায়, তা জানা।
চালের ৫৫ শতাংশ বোরো থেকে পাওয়া গেলেও এবার বোরোর পরিবর্তে আমনের ওপর নির্ভর করতে হবে বলে মূল প্রবন্ধে আশঙ্কা করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, সামনে রয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ, যা সইতে হলে মুদ্রানীতি ও এর বাইরের অন্য নীতিগুলো জনকল্যাণমুখী হওয়া দরকার।
আলোচনা: বিআইডিএস চিহ্নিত পাঁচ চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিকেও আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় এবং অধিক পরিমাণ সম্পদ সংগ্রহের পরামর্শও চান।
কৃষিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সেচের পানির জন্য বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ কৃষক বলছেন, ভর্তুকির দরকার নেই। কৃষিমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগের সঙ্গে জ্বালানির সম্পর্ক রয়েছে। তবে সংকট থেকে মুক্তি পেতে দরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি। আয়বৈষম্য বাড়া প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে নজর দিলেই এ থেকে খানিকটা উত্তরণ সম্ভব।
ব্যাপক দুঃশাসন থাকা সত্ত্বেও দেশটি দেউলিয়া হয়ে যায়নি উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগের পরিমাণ বর্তমানের ২৪ শতাংশ থেকে ৩৬ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এ জন্য দরকার ৯৫০ কোটি ডলার।
মশিউর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি শুধু দেশীয় কারণ অর্থাৎ সরকারের ত্রুটির জন্যই হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে সার ও তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। এ জন্য সরকারকে দোষারোপ করা হলে নীতিনির্ধারণে প্রভাব পড়ে।
উপদেষ্টা আরও বলেন, অতি দরিদ্রদের বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণের প্রতি জোর দিয়ে বিআইডিএসের এযাবৎকালের সুপারিশ বা পরামর্শগুলো কতটা সত্য হয়েছে, তার একটি মূল্যায়ন করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
ফারুক খান বলেন, মন্দার মধ্যে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানি খাতকে সহযোগিতা করা হয়েছে। রপ্তানির বাজারের জন্য নতুন নতুন জায়গা খোঁজা হচ্ছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, রাজনীতি কেমন—বর্তমানে তা নির্ধারিত হয় অর্থনীতির মাধ্যমে। তাই অর্থনীতি ভালো রাখার জন্য কাজ করে যাবে সরকার।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির নানা দিক তুলে ধরা হলেও মূল প্রবন্ধে উপেক্ষা করা হয়েছে ব্যাংকিং খাতকে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা আনা দরকার।
সাইদুজ্জামান আরও বলেন, ‘সরকার প্রায়ই বলে থাকে যে, ব্যাংকের সেবা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। আদতেই কাজটা জরুরি। তবে তার আগে তদারক ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার।’ এ জন্য ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বেসরকারি সংস্থা থেকে শিক্ষণীয় রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন সাবেক উপদেষ্টা রোকেয়া আফজাল রহমান, এম হাফিজউদ্দিন খান, বাংলাদেশ চেম্বারের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, ঢাকা চেম্বারের সাবেক পরিচালক শহিদুল হক, এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.