নারী অধিকার -পাহাড়ি নারীরা সম্পত্তিতে অধিকার পাবে কবে by ইলিরা দেওয়ান

সম্পত্তির ওপর নারীর উত্তরাধিকারের বিষয়টি বাংলাদেশে বরাবরই উপেক্ষিত ইস্যু হিসেবে দেখা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলেও এ অবস্থার ব্যতিক্রম নয়। অথচ সংবিধানের ২৮(১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো প্রকার বৈষম্য প্রদর্শন করা হবে না। নারী-পুরুষের এ সাম্যের বার্তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। সম্পত্তির ওপর নারীর বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকারই প্রমাণ করে যে নারী তার সংবিধানসম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত আছে। দেশে খ্রিষ্টান ও মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী নারীরা কিছু অংশ ভাগ পেলেও হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। বেশির ভাগ আদিবাসী পাহাড়ি নারী সম্পত্তিতে কোনো অধিকার পায় না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃ-গোষ্ঠীসমূহের সমাজব্যবস্থায় নারীরা এখনো ক্ষমতা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর প্রশাসনিকভাবে সীমিত সুযোগ/আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, শুধু আসন বরাদ্দের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার কাজের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে দেওয়া, যাতে নারী তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীরা তিনভাবে নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়। ১. জাতিগত, ২. সামাজিক ও ৩. লিঙ্গীয়ভাবে। জাতিগত বৈষম্যের কারণে পাহাড়ি নারীরা অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক বা মানসিকভাবে নিপীড়িত হয়ে থাকে। এ জাতিগত বৈষম্য দূর করতে সরকারকেই উদারভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং পার্বত্য অধিবাসীদের আস্থার ক্ষেত্রটি তৈরি করে দিতে হবে।
তুলনামূলক বিচারে পাহাড়ি সমাজব্যবস্থা অন্যান্য সমাজ থেকে উদার, অর্থাত্ এখানে লিঙ্গীয় বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম। তবে সম্পত্তির ওপর নারীর উত্তরাধিকার প্রশ্নে পাহাড়ি সমাজকাঠামো একই রকম রক্ষণশীল। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় পুরুষেরা সম্পত্তির একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ায় পুরুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর এখানে সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানকার প্রথাগত সামাজিক আইন নারীকে কোণঠাসা করে রেখেছে। পাহাড়ি সমাজব্যবস্থায় নারীরা সবচেয়ে বেশি উত্পাদনশীল কাজে নিয়োজিত থাকে বটে, কিন্তু সম্পত্তির ওপর তাদের কোনো অধিকার থাকে না। অনুরূপভাবে সন্তান ধারণ ও লালন করলেও সন্তানের অভিভাবকত্ব তাঁরা পান না। আগের বারের শেখ হাসিনার সরকার (১৯৯৮) বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম লেখার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নারীদের দীর্ঘদিনের অপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছিল। আমরা আশা করছি, এ স্বীকৃতির সুফল দেশের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রথাগত আইনেও বিশেষ প্রভাব ফেলবে। সরকার যদি অভিন্ন উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত প্রশাসনিক পদসমূহে যোগ্যতার ভিত্তিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে। যেমন, রাজা, হেডম্যান বা কার্বারির পদে ছেলেসন্তানের পাশাপাশি মেয়েসন্তানকেও উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচন করা সহজ হবে। বর্তমানে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে মাত্র দুজন নারী হেডম্যান আছেন, যাঁরা প্রথাগত আইন ভেঙে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীগুলো চাকমা, মং ও বোমাং—এ তিনটি সার্কেলের অধীন। এ তিন সার্কেলের মধ্যে শুধু বোমাং সার্কেলের অধীন মারমা সমাজের নারীরা সম্পত্তির ওপর এক-চতুর্থাংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু চাকমা ও মং সার্কেলাধীন নারীরা, এমনকি এ সার্কেলের অধীন মারমা নারীরাও প্রথাগত আইনের কারণে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন (সূত্র: মারমা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন, কপো সেবা সংঘ, ২০০৭)।
নারী অধিকারের সঙ্গে সম্পত্তির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাই তার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। কাজেই সম্পত্তির ওপর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে নারী তার আত্মবিশ্বাসও অনেকখানি ফিরে পাবে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্ধেক অংশই নারী। তাদের পেছনে ফেলে রেখে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কখনো প্রগতিশীলতার পথে এগোতে পারবে না। আমরা বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে দেখি, পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেই সম্পত্তির ওপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কিছু অঞ্চল (মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র প্রদেশ ইত্যাদি), শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে অভিন্ন উত্তরাধিকার আইন চালু রয়েছে। তাই গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দেশেও নারী অধিকার নিশ্চিত করে একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করা যেতে পারে।
একবিংশ শতকে এসে আমরা সাম্য, সভ্যতা, প্রগতিশীলতার কথা বলছি, আর অন্যদিকে নারীর প্রতি অন্যায় বৈষম্যগুলো জিইয়ে রেখেছি, তা তো হতে পারে না। এখন পরিবর্তনের সময় হয়েছে। বর্তমানে যে বিষয়টির দিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে তা হলো, বাংলাদেশে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে একটি অভিন্ন উত্তরাধিকার আইন প্রতিষ্ঠা করা, যাতে নারী অধিকারের বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে।
যদি একটি অভিন্ন উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন করা যায়, তাহলে দেশের অপরাপর নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ওপরও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। কেননা আমরা মাতৃতান্ত্রিক ও মাতৃসূত্রীয় সমাজব্যবস্থাগুলোর (গারো, মারমা, খাসি) দিকে তাকালে দেখি, প্রথাগতভাবে তারা সম্পত্তির ওপর উত্তরাধিকারী হলেও রাষ্ট্রের মূল স্রোতোধারা পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় তারাও সমাজের মূলধারায় আসতে পারছে না। কাজেই সবার আগে রাষ্ট্রের মূলধারায় পরিবর্তন আনা জরুরি। এতে সমাজে প্রচলিত ভিন্ন ধারাগুলোর মধ্যে পরিবর্তন আনা অনেক সহজ হবে।
আমরা আশাবাদী যে বর্তমান সরকার নারী অধিকারের বিষয়ে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে বাবার সমান্তরালে মায়ের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রোকেয়া পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৭ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এ নীতিতে পাহাড়ি নারীদের কোনো কথা নেই। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, মহাজোট সরকার যেন নারী উন্নয়ন নীতিতে দেশের সব জাতি-ধর্মের নারীদের বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার ব্যবস্থা রাখে।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
iliradewan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.