মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও জীবনযুদ্ধের পরাজয় by আবুল মোমেন

ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। বিজয়ের সূত্রে আসে উত্সব। ডিসেম্বর উত্সবের মাস। যে বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এ অর্জন, তাকে ছাপিয়ে ওঠে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। এ নিয়ে মানুষের ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাসের যে বাঁধভাঙা জোয়ার প্রতিবছর দেখি, তাকে স্বাভাবিক বলে মেনেও মনের একটু খটকা যেন তাড়াতে পারি না।
ভাবতে থাকি বিজয়ের তাত্পর্য। স্বাধীনতার ভাবার্থ। দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, স্বাধীন মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করেছি, তা কি কেবল উদ্যাপনের বিষয়? ভাবাবেগ আর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উদ্যাপনের উপলক্ষ?
আমরা যে এর উত্তর জানি না, তা নয়। কিন্তু উত্তর মানি না। মানতে চাই না। স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ও মুক্তির গানগুলোকে আমরা যে ভুলিনি, বিস্মৃত হতে দিইনি, গানগুলো আজও আবেগাপ্লুত হয়ে গেয়ে থাকি, তাতে স্বাধীনতার চেতনা জাগরূক থাকে আমাদের মধ্যে। একইভাবে শিহরণজাগানো ভাবাবেগে, চোখের জলে আমরা বারবার শুনি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ, শুনি ‘আমার সোনার বাংলা’, কিংবা গণসংগীত ‘নোঙ্গর তোল তোল’। এমন আরও কত গান। এ সবই যে আমাদের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য, তাতে সন্দেহ নেই।
৩৮ বছর এভাবে চলেনি। জিয়া ও এরশাদের আমলে এই আবেগ ও চেতনা ভুলিয়ে দেওয়ার কাজ চলেছে। তা ছিল প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাঘাত, পেছনে চলার অপচেষ্টা। সেটি ছিল জাতীয় দুর্যোগের দুঃসময়। বাঙালি এবং জাতিগত সব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, সবারই জীবন তখন যেন থেমে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নতিও তখন সম্ভব হয়নি। সেই ধারাটা বিএনপি তার রাজনৈতিক চেতনা ও সংস্কৃতির শাঁস হিসেবে নিয়েছে। ফলে একটু তলিয়ে দেখলে বিএনপির মধ্যে কবর দিয়ে দেওয়া মুসলিম লীগ আর প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ভাবধারার ছায়া দেখা যায়। এরশাদ করেছেন সুবিধাবাদের রাজনীতি, যা থেকে ফায়দা অর্জন বিএনপির ছায়া অনুসরণ করেই সম্ভব ছিল।
এবার বিএনপি তথা বিএনপি ঘরানার রাজনীতির ভরাডুবি ঘটিয়েই ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে এরশাদ থাকলেও তাঁর সুবিধাবাদ ও আপসের রাজনীতি আপাতত বিএনপি থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
আওয়ামী লীগের আমলে বিজয়ের আনন্দে মানুষ বিভোর হবে বেশি, সেটাই যেন স্বাভাবিক। এবার সারা দেশে বিজয় মেলা ডিসেম্বর জুড়েই যেন চলছে। এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসে দেশের সব মানুষ যোগ দিতে পারছে, এমন কথা বলা যাবে না। আদর্শের কারণে বিমুখ থাকা মানুষের সংখ্যা কম বলেই মনে হয়। কিন্তু নিতান্ত অর্থনৈতিক কারণে ইচ্ছাকে দমন করে যোগ দিতে অপারগ মানুষের সংখ্যা অনেক।
বিজয়ের ৩৮ বছর পর দেখি, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক, হতদরিদ্র প্রচুর, শিক্ষাবঞ্চিত জনসংখ্যা বিপুল। যে শিক্ষা মিলছে, তার মান আশানুরূপ নয়। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। স্বার্থপরভোগী মানসিকতা বেড়েছে। অধিকাংশ মানুষ অসুখে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পায় না। প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও অদক্ষতা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চলছে। যুবসমাজের অবক্ষয় অব্যাহত আছে। নারী নির্যাতন বেড়েছে। এভাবে দেশের এক হতাশাজনক চিত্রই আমরা দেখতে পাব। অথচ এ পর্যন্ত ৩৯ বার আমরা বিজয় দিবস উদ্যাপন করলাম। তার মানে দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে ৩৮ বছর। এত বছরেও স্বাধীনতার সুফল মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হলো না।
দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন দারিদ্র্যের কাছে পরাভূত থাকে, যখন প্রশাসনিক অব্যবস্থা-অদক্ষতায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে নির্যাতিত হয় অধিকাংশ মানুষ, যখন অপরাধ ও দুর্নীতির কাছে সমাজ ও সরকার বারবার পরাস্ত হতে থাকে, তখন কি মনে হয় না আমাদের বিজয় কতটা অন্তঃসারশূন্য, অর্থহীন হয়ে আছে?
আনন্দ-উত্সবের বিরুদ্ধে নই আমি। এ রকম আয়োজন আমিও করে থাকি। কিন্তু পুরো জাতি যদি কেবল এর মধ্যেই বিজয় ও স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে আত্মকেন্দ্রিক সুবিধাভোগী মানসিকতা নিয়ে চলতে থাকে, তাহলে কীভাবে বিজয় ও স্বাধীনতা অর্থবহ হবে জাতীয় জীবনে? সবার জন্য?
এসব আনন্দ-আয়োজন কি তখন দেশের বিপুল অভাগা-অভাজনের জন্য উপহাস হয়ে দাঁড়ায় না? কিন্তু হায়! এ উপহাস আমরা নিরন্তর করে চলেছি। আমার মনে হয়, অন্তত এখন একটু থেমে ভাবা দরকার; সবটা ভেবে, মূল্যায়ন করে সঠিক পথে এগোনো উচিত।
সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, সবার জন্য সুপেয় পানি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, সবার জন্য আবাসন, সবার জন্য দুবেলা দুমুঠো খাবার ও পুষ্টি অর্থহীন স্লোগানে পরিণত হয়েছে। বারবার আমরা লক্ষ্য অর্জনের টার্গেট পিছিয়ে দিই। এমনকি আগের অর্জন পরে আর ধরে রাখতে পারিনি, যা ঘটেছে জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। সবার জন্য শিক্ষা বা সবার জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার টার্গেট বহুবার পিছিয়ে এখন সম্ভবত ২০১৫। সবাই জানি, ১৯৯০ থেকে যা অধরা রয়েছে, তা এখনো অধরাই থাকবে। এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও আমরা ভুলতে পারি না, সাম্প্রতিক এক জরিপে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা। তাতে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ৭০ ভাগ ছাত্রই ন্যূনতম অর্জনলক্ষ্য পূরণ করে না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্বলতা থাকার কারণে পরবর্তী উচ্চতর সব ধাপেই শিক্ষার মান খারাপ হয়ে পড়ছে। দুর্বল বুনিয়াদ নিয়ে উন্নত শিক্ষা অবাস্তব ব্যাপার বৈকি।
এই আবেগপ্রবণ হুজুগে জাতিকে কীভাবে উত্সব আর মেলার সংস্কৃতি থেকে বা তার পাশাপাশি কাজের সংস্কৃতিতে টানা যাবে, তা ভাবতে হবে। জাতি গঠনের ও জাতীয় উন্নয়নের কাজগুলো চিহ্নিত করে তাতে যোগ্য ব্যক্তিদের অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
এখন বিজয় দিবসে ও স্বাধীনতা দিবসে যেভাবে ইতিহাসচর্চার নামে ফি বছর কিছু মানুষের একাত্তরের স্মৃতিচারণা আর রাজনৈতিক দলীয় বক্তৃতা-বুলি কপচানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তাতে না ইতিহাস বোঝা যায়, না ইতিহাসের সঠিক চর্চা সম্ভব।
একইভাবে টিভিতে টক শোর নামে চলছে কথার ফুলঝুরি। শিক্ষিত, যোগাযোগসম্পন্ন বাকপটু মানুষজন যে যেভাবে পারছেন, যেন মঞ্চ ও টিভিতে কথামালা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। এসব দেখে মাঝেমধ্যে মনে সংশয় জাগে, এত সব মানুষ কি ভাবছেন, কথা বলে বলেই জাতিকে জ্ঞান-বুদ্ধিতে সমৃদ্ধ করা যায়? তার সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?
অতি ব্যবহারে বুদ্ধিও চালাকিতে পরিণত হয়। আর বারবার একই আবেগে মজতে চাইলে তারও পরিণতি করুণ। একই গান বাজাতে বাজাতে তার আবেদন যায় কমে। সেই যে একাত্তরে অসংখ্য অসাধারণ সব দেশাত্মবোধক গান তৈরি হয়েছে, তারপর আর কই? হয়নি; কারণ আমাদের আবেগের শুদ্ধতা হারিয়ে গেছে, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থবুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে ভোগসর্বস্বতার অনলে সৃজনী ক্ষমতাকে বিনষ্ট করেছে। আজ আমরা নানাভাবে যেকোনো সুযোগকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত লাভালাভের স্বার্থেই বিচার করি, ব্যবহার করি।
বিজয়, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু—সবই সমগ্র জাতির অর্জন ও উত্তরাধিকার হিসেবে সবার হয়ে উঠতে পারেনি। নানা জন নিজস্ব ও ক্ষুদ্র স্বার্থে এ সবই ব্যবহার করেছে। তাই বিজয় মেলা ছিনতাই হয়, দখল হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে পড়েন। ফলে বিজয়কে নানা কাজের মধ্য দিয়ে আপামর জনগণের জীবনে বাস্তব করে তোলা ও সত্য প্রমাণ করার মতো বড় কাজ আজও আরাধ্য রয়ে গেছে। তবেই সবার জীবনে বিজয়ের ছোঁয়া লাগবে।
এত আয়োজন-উত্সব-উচ্ছ্বাসের ঢক্কানিনাদ আর এত কিছু অর্জনের বুলিবিস্তার সত্ত্বেও সত্য হলো, বহু মুক্তিযোদ্ধা জীবনযুদ্ধে পরাজিত। দেশের সিংহভাগ মানুষের জীবন দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কারণে পরাজয়ের গ্লানিতে ম্লান।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কেমন বিজয় দিবস চাই? কীভাবে বিজয়ের আনন্দকে উপভোগ করতে চাই? দরিদ্রের জন্য কিছু করা কেবল সরকারের কাজ নয়, সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা এককভাবে সরকার করতে পারবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টির দায় একা সরকারের নয়। এভাবে সব বিষয়েই বলা যাবে।
বিজয় দিবসে আমরা যদি সাধারণ মানুষকে প্রতিদিনের পরাজয়ের গ্লানি ও গ্লানিময় বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে পারি, তাহলে তা-ই হবে সবচেয়ে ভালো কাজ। কাজের কাজটি না করে কেবল ইতিহাস শুনিয়ে আর ভাবাবেগ ছড়িয়ে তাকে ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়ে রাখতে পারব মাত্র। কিন্তু ঘোর কাটলেই ব্যর্থতা ও পরাজয়ের ক্ষোভ-দুঃখই তাকে গ্রাস করবে। বরং সাধারণের জীবনে ইতিহাস-চেতনা যাথার্থ্যভাবে গেঁথে দিতে হলে তাকে প্রতিদিনের পরাজয়ের ফলে সৃষ্ট দিনযাপনের গ্লানি থেকে উদ্ধার করতে হবে। বর্তমানে যেভাবে চলছে তাতে ভয় হয়, বিজয় ও স্বাধীনতার আবেগ না আমাদের হাতে আফিমের মতো ব্যবহূত হয়। বেঁচে থাকার ব্যবস্থাই হবে তাদের জন্য আদর্শিক প্রেরণা—তা সবাইকে জীবন গড়ে তোলার উদ্দীপনা দেবে।
বিজয় এক প্রেরণাদায়ী শব্দ, যা থেকে আশা, স্বপ্ন, সদিচ্ছা, উত্সাহ, উদ্দীপনার মতো ইতিবাচকতার আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। কিন্তু আমাদের কিছু মানুষের মজ্জাগত অসচেতন আত্মকেন্দ্রিক তত্পরতার ফলে এই অসাধারণ জাদুকরী সম্ভাবনাময় শব্দটি তার সব জৌলুশ হারিয়ে বসেছে। দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনে ‘বিজয়’ শব্দটি যখন কোনো দ্যোতনা দেবে না, ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে না, যখন এ শব্দটি দ্যোতনা-প্রেরণাবিহীন মূক-বন্ধ্যা শব্দে পরিণত হয়, তখন তো বুঝতে হবে, বাইরের এসব জৌলুশ ও হইচই অন্তরের দীনতা ঢাকতে পারছে না। বরং এসবই বিদ্রূপের মতো মনে হবে। বস্তুত কখন আমাদের অজান্তে বিজয় ও পরাজয়ে ভাবগত তাত্পর্য ঘুচে যায়, আমরা বুঝতেই পারি না।
কিন্তু আমাদের তো ভাগ্যহত মানবতার জন্য বিজয়ের কথা ভাবতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.