প্রধান বিচারপতির ১৯ মাস -সরল গরল by মিজানুর রহমান খান

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ২২ ডিসেম্বর বিদায় নিচ্ছেন। প্রায় ১৯ মাস আগে যেদিন দায়িত্ব নিলেন, তার পরপরই শুনলাম, জিএ কমিটির কাজে তিনি পরিবর্তন এনেছেন। এটা ছিল সম্ভবত তাঁর প্রথম সংস্কার। জিএ কমিটি মানে জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটি। সবশেষ ১৯৫৯ সালে সংশোধিত হাইকোর্ট রুলসে এই কমিটি গঠনের বিধান আছে। কমিটি দেশের প্রায় এক হাজার ২০০ বিচারকের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাবিধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের অপর তিন বিচারপতি নিয়ে এই কমিটি গঠিত। প্রধান বিচারপতির একক পছন্দে তিন বিচারপতি বাছাই হন। বিচারক-বদলি প্রতি মাসেই লেগে থাকে। হঠাত্ বদলি একটি তাত্ক্ষণিক তিরস্কার। উচ্চ আদালতের শৃঙ্খলাবিধানে এমন কিছু টোটকা দাওয়াই নেই। শুনেছি, বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে সরকারের পক্ষ থেকে কাউন্সিল সক্রিয় করার বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি দালিলিক প্রমাণ চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটা কথা এখানে বলতেই হয়। সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়। শুধু সমস্যা হলো অদক্ষতা ও অযোগ্যতাকে অসদাচরণ এমনকি দুর্নীতি হিসেবে স্বীকার করার মানসিকতা। এ রকম ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের কাছে মজুদ আছে, যা আদালতের রেকর্ডেও সংরক্ষিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অদক্ষতা, অযোগ্যতা কিংবা কর্তব্যে গাফিলতি দৃশ্যত এতটাই সীমাহীন যে তার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কাছে আর্থিক অনিয়ম নস্যি। আর এই সব দালিলিক প্রমাণের মুখ্য হেফাজতকারী হলেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি বিচারকের আসনে বসেন বটে, তিনি নিয়মিতভাবে জজিয়তি না করলেও ক্ষতি নেই। প্রধান বিচারপতি মুনিম বিচার করেননি বললেই চলে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির প্রধান পরিচয়, তিনি বিচার বিভাগের প্রধান প্রশাসক।
নিম্ন আদালতের ব্যবস্থাপনায় বর্তমান প্রধান বিচারপতির নতুন নিয়ম কিছুটা সফলতা বয়ে এনেছে। কিন্তু বিচারক-বদলির চলতি কায়দাকানুন এখনো ভীষণ গোলমেলে মনে হয়। এটা যে একটা ন্যূনতম লিখিত নীতিমালার ভিত্তিতে হতে পারে, সেটা নীতিনির্ধারকেরা অক্লেশে মানতে নারাজ। পাঁচ বছরের বেশি সময় টানা ঢাকায় আছেন এমন বিচারকদের সবাইকে সরাতে পারেননি প্রধান বিচারপতি। আইন মন্ত্রণালয় বাধা দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে। প্রধান বিচারপতির চিঠির দাম নেই। কিন্তু মন্ত্রীরা মুখে বলবেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় তাঁদের আস্থা ভয়ানক! আমাদের হাতে বেশ কয়েকটি চিঠি রয়েছে, যা থেকে দেখা যাচ্ছে, তিনি আইন মন্ত্রণালয়কে আইন মানাতে সতর্কতার সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু বুনো ওলের জন্য চাই বাঘা তেঁতুল, তা তিনি দিতে উদ্যোগী হননি বা বাস্তবসম্মত মনে করেননি।
প্রধান বিচারপতি তাঁর ১৯ মাসে নিম্ন আদালতের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার (সিআরও) দুই ভলিউমে প্রকাশ করেছেন। এই সংস্কারটা আসলে ছিল ১০০ বছরের বকেয়া বিষয়। বিচার বিভাগ পৃথক করার ফলে এটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মান্ধাতার আমলের হাইকোর্ট রুলসের খোলনলচে বদলানোর যে প্রক্রিয়া এর আগে শুরু হয়েছিল, তিনি তাতে গতি আনেন। এটা এখন প্রায় চূড়ান্ত। কাজটা হওয়ার কথা ছিল তিন দশক আগেই।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ছে কি কমছে, তা গতিময়তা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে মনিটর করার মতো কোনো উপায় এখনো তৈরি হয়নি। খুব যে চেষ্টা আছে, তাও মনে হয় না। একটি ওয়েবসাইটকে পূর্ণতা দিতে প্রধান বিচারপতিরা অব্যাহতভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদ হাইকোর্টের বিচারক থাকাকালে ওয়েবসাইট-সংক্রান্ত একটি কমিটিতে কাজ করেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা অতিশয় তিক্ত ছিল বলেই জানি। সেই তিক্ততার হেরফের ঘটেনি।
আমরা আমাদের মন্তব্য বিনীতভাবে প্রধানত প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক এখতিয়ারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছি। তবে বেদনাশ্রয়ী অভিজ্ঞতা আমাদের শেখাচ্ছে যে, একজন প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও ব্যাপকমাত্রায় তাত্পর্যপূর্ণ। বিচারপ্রক্রিয়ায় এর প্রভাব ও ফলাফল অসামান্য ও অবধারিত হতে বাধ্য। এর মধ্যে বেঞ্চ গঠন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান প্রধান বিচারপতিকে বেঞ্চ গঠনে একক দায়িত্ব দিয়েছে। ঘন ঘন বেঞ্চ ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতিদের কারও কারও আমল কলঙ্কিত। গত ১৯ মাসে এ নিয়ে বিতর্ক-গুঞ্জন হয়নি বললেই চলে। কিন্তু তার অর্থ অবশ্যই এই নয় যে, তিনি যাঁদের যেসব দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁদের কারও কারও কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কিছুমাত্র কম।
২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনের শর্ত মেনে সুপ্রিম কোর্টে জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়োগ বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অভিজ্ঞতা জানিয়ে রেজিস্ট্রারকে চিঠি দিয়েছি। জরুরি অবস্থায় দুদকের চাপে সংগ্রহ করা নিম্ন আদালতের বিচারকদের সম্পদের বিবরণী পোকায় কাটছে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের সম্পদের বিবরণী চাওয়ার দায়িত্ব আইনে প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া রয়েছে। প্রধান বিচারপতিরা অব্যাহতভাবে ও সুচিন্তিতভাবে তা উপেক্ষা করে চলেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এমন অবস্থান নিয়ে টেকাতে পারেননি। সম্প্রতি তাঁরা তাঁদের সম্পদের বিবরণী ওয়েবসাইটে দিয়েছেন। এসব অগ্রগতি জানিয়েও রেজিস্ট্রারের দপ্তরকে চিঠি দিয়েছি। নীরবতা ভাঙেনি।
গত ২৩ নভেম্বর ১১ নম্বর কোর্টে বেঞ্চ অফিসারদের দুর্নীতির বিষয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ উঠল। কিন্তু ওই বেঞ্চ উপেক্ষা করলেন, প্রধান বিচারপতিও নীরব থাকলেন।
সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন দুর্বল, অগোছালো, অনেক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যহীন। এই প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নানা মাত্রায় ক্ষোভ আছে। সার্বিকভাবে যদি বলি, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যার কারণে সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তাহলে অত্যুক্তি হবে না। একটি রিটে কতিপয় কর্মকর্তা পদোন্নতি পান। তাঁদের দেখাদেখি বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পৃথক আরও তিনটি রিটে এখন অভিন্ন প্রতিকারপ্রার্থী। এটা একটা ভয়ানক উদ্বেগের বিষয়। এই বিশৃঙ্খলার একটা নেতিবাচক প্রভাব বার-বেঞ্চ ও বিচারপ্রার্থীদের প্রাত্যহিক জীবন ও কাজের ওপর পড়ছে। এসব নিরসনে প্রধান বিচারপতিদের ইতিবাচক উদ্যোগগুলো খণ্ডিত ও অপ্রতুল বলা যেতে পারে। এখানে দরকার এখন একটি শক্তিশালী সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সংস্কার কমিশন।
আমরা যদি সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের সৃষ্টি এবং সংবিধানকেই প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন মানি, তাহলে তা লঙ্ঘনের দায় প্রধান বিচারপতি এড়াতে পারেন কি না, তা এখন একটা খতিয়ে দেখার মতো প্রশ্ন। যুক্তির বিচারে তাঁকে যদি অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে মানবাধিকার প্রসঙ্গেও সে প্রশ্ন তোলা যায়। কীভাবে, সেটা খুলে বলা দরকার।
২০০৮ সালের সুপ্রিম কোর্ট বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য হলো, এক লাখ ৭০ হাজার ৩৭১টি ফৌজদারি আপিল পেন্ডিং বা অনিষ্পন্ন রয়েছে। কোনটি কেমন ধরনের আপিল তা প্রতিবেদনে নেই। তবে বোঝা যায়, এর মধ্যে জামিন ও নিম্ন আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত করা থেকে শুরু করে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল রয়েছে। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে মানবাধিকারের দুই তরফা প্রশ্ন জড়িত। দণ্ডিত ব্যক্তির আছে দ্রুত বিচারলাভের অধিকার। ভুক্তভোগীর রয়েছে দোষীর চূড়ান্ত বিচারিক পরিণতি দেখার অধিকার। উভয় ক্ষেত্রে মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত।
১৮ ও ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের মাত্র একটি বেঞ্চে এ রকম এক হাজার একটি জামিন আবেদন জমা পড়ল। শিগগির শুনানি হবে না, তাই জামিন চাই। প্রথমত, এটি একটি ব্যবস্থাপনাগত বিপর্যয়। দ্বিতীয়ত, এই বিপর্যয়ের সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটা সম্পর্ক থাকে বা সৃষ্টি হতে বাধ্য। উল্লেখ্য, ওই আপিলগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই পেপারবুক প্রস্তুত হয়নি। হাইকোর্টের আইনে বলা আছে, আপিলের পেপারবুক তৈরি ও তদারকের দায়িত্ব রেজিস্ট্রারের। অথচ নির্বিচারে তার ব্যত্যয় ঘটছে। এর জন্য আমরা কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলকে দোষারোপ করতে পারি না। যদি ভ্যাট-কাস্টমস মামলার দ্রুত সুরাহার জন্য পৃথক বিশেষ বেঞ্চ চলমান থাকতে পারে, তাহলে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের হাজার হাজার আপিল মামলার বিচার নিষ্পত্তি করতে প্রধান বিচারপতিরা কেন বিশেষ বেঞ্চ গঠনে উদাসীন থাকবেন?
বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে গত ১৯ মাসে রক্ষণশীল, সংস্কারে সীমিত উত্সাহী কিন্তু সাবধানী, ধারাবাহিকতার প্রতি অনুগত কিন্তু নিজেকে প্রভাবমুক্ত রাখতে সচেষ্ট বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুনতে তিনি বিব্রত হন। কিন্তু আইনসচিবের মামলায় তাঁর বিব্রত হওয়া ছিল বড় পীড়াদায়ক। বিচারপতি নিয়োগে তিনি বিচারপতি আবদুর রশিদের অগ্রসর রায় উল্টে কেবল প্রধান বিচারপতির পরামর্শনির্ভর যে সনাতন ব্যবস্থা রেখে গেলেন, তা দুর্ভাগ্যজনক। সুপ্রিম কোর্টের বেহাল বার সম্ভবত তাঁকে সন্তুষ্টির সঙ্গেই মনে রাখবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.